Published : 12 Jan 2020, 05:37 PM
ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে দেশের প্রচলিত আইনে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে আমাদের আন্দোলন করতে হয়। আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা বের হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে বিচারের দাবিতে কখনোই আন্দোলনের প্রয়োজন পড়ে না। আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য থাকে-অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা।
কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতির এই হীরকরাজ্যে সরলমনে বিচার পাওয়ার চিন্তা মানেই আকাশকুসুম কল্পনা। ফলে বিচার আমরা পাই না; আদায় করে নিতে হয়। যার যা সামর্থ্য আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। ভিক্টিমের ঘণিষ্ঠজনের তালিকায় কোনো রাঘববোয়াল থাকলে বিচার ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ 'চাপ' দেওয়া হয়। আর যার রাঘববোয়াল টাইপের কেউ নেই তাদের পাশে থাকা বন্ধু-বান্ধবরা আন্দোলনে নামে; সমস্বরে বিচারের দাবি তোলে। জনরোষের মুখে অনেক সময় অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়; বিচার আদায় করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের ইতি টানা হয়।
আন্দোলনের অনেক ভালো দিক আছে; বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ঘটনায় জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়; ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু প্রদীপের নিচে খানিকটা অন্ধকারও আছে; সেটা নিয়ে খুব একটা আলাপ হয় না। একটার পর একটা খুন-ধর্ষণ ঘটছে আর একটার পর একটা আন্দোলন করে আমাদের বিচার আদায় করে নিতে হচ্ছে। আপনি না চাইলেও বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে বিচার পাওয়ার অন্যতম 'মানদণ্ড' হয়ে উঠেছে আন্দোলন। রাষ্ট্রযন্ত্রও অলিখিতভাবে আন্দোলকে বিচারের তারতম্যের পারদমিটার হিসেবে ধরে নিয়েছে। যে ধর্ষণের ঘটনায় যত বেশি আওয়াজ আর মিডিয়াবাজি হবে সেই বিচার দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তি হবে আর যে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে জনরোষ তৈরি হবে না সেটা নিয়ে পুলিশ রা করবে না।
"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তিন দিনের মাথায় সহপাঠীর ধর্ষক গ্রেপ্তার হওয়ায় আদালতপাড়ায় এসে নিজের মামলা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন এক প্রতিবন্ধী তরুণী।" সেই তরুণী বলেন, "বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি। এমনকি গ্রেপ্তারের কোনো চেষ্টাও করেনি। আমরা গরিব, ভার্সিটিতে পড়ি না। তাই পুলিশ আমাদের কথাও শোনে না।"
(সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
প্রতিবন্ধী সেই তরুণীর জন্য কেউ আন্দোলন করেনি; দেশের সব ধর্ষণকাণ্ডে আন্দোলন হবে এটা ভাবাও বোকামি। তাহলে প্রশ্ন তাহলে আন্দোলন কি খারাপ? আন্দোলন খারাপ না; কিন্তু আন্দোলনই যদি বিচারের একমাত্র 'মানদণ্ড' হয়ে উঠে তাহলে সেটা অ্যালার্মিং। দিনের পর দিন শ্রেণি বিভাজনকে উসকে দিচ্ছে; যার আকুতিই ফুটে উঠেছে সেই প্রতিবন্ধী তরুণীর কণ্ঠে। আন্দোলনের নিরিখে তার মতো হাজারো সামর্থ্যহীনদের বিচার কীভাবে হবে?
তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে রোজ বাংলাদেশে খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধ সংগঠিত হয়। প্রত্যেকের বিচারের দাবিতে আন্দোলনের সামর্থ্য আমাদের নেই; এটা সম্ভবও না।
তাহলে আমরা কী করব?
আন্দোলনই করব কিন্তু সেটা শুধু বিচারের দাবিতে নয়। বিচারের দাবিতে আন্দোলন করা মানে গাছের ডাল ধরে নাড়ানো; এতে শুধু পাতাই ঝরে কিন্তু গাছটিকে কখনও উপড়ে ফেলা যায় না। রোজ রোজ ডাল ধরে না ঝাঁকিয়ে গাছের গোড়া ধরে সম্মিলিত চেষ্টা করলে মূলোৎপাটন করাটা জরুরি।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করে প্রচলিত আইনে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বিচারের সংস্কৃতির বীজ বপনের আন্দোলন করতে হবে।