‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’ উপন্যাসের জন্য এবছর বুকার পুরস্কার পেয়েছেন শ্রীলঙ্কান লেখক শেহান করুণাতিলক। এটি ছিল তার দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস ‘চায়নাম্যান’, যেটিকে উইজডেন ক্রিকেটের উপর লেখা দ্বিতীয় সেরা বই হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এ সাক্ষাৎকারটি বুকার পুরস্কার পাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে নেওয়া। পুরো আলোচনা ঘিরেই ছিল তার নতুন উপন্যাসটি। সূত্র: দ্য বুকার প্রাইজেজ ডটকম
Published : 20 Oct 2022, 12:35 PM
বুকার পুরস্কার-২০২২ এর দীর্ঘ তালিকায় জায়গা পেয়ে কেমন লাগছে? যদি জিতে যান তাহলে কেমন হবে?
যে কোনো দীর্ঘ তালিকায় জায়গা করে নেওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যুক্তরাজ্যে উদ্বোধনের আগেই যখন আপনার বইটি দীর্ঘ তালিকায় জায়গা করে নেয় তখন তা আলাদা ব্যাপারই। পুরো পৃথিবী যখন শ্রীলঙ্কার বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখছে তখন তার অতীতের অস্থির সময় নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার জন্য সেই অন্ধকার সময়টা চিহ্নিত করা প্রয়োজন, আমার প্রধান চরিত্র মালি আলমেদার বিপরীতে। আমি এখানে জুয়া খেলছি না, তাই দুটি ছক্কা হাঁকানোর আশা করি না, যদি করি তবে আমিও খুশিতে চিৎকার করে উঠবো।
‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’র শুরুর দিকটা কেমন? এটা কী ধীরগতির কোনো ধারণা নাকি স্বচ্ছ কোনো মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়েছে? এখন আপনাকে কেন এই নির্দিষ্ট বইটি লিখতে হলো?
গৃহযুদ্ধ শেষের পর আমি এটার ব্যাপারে ২০০৯ সাল থেকেই ভাবছিলাম। যখন এতে সাধারণ মানুষ মারা গিয়েছিল এবং ভুল কার ছিল তা নিয়ে বির্তক উঠেছিল তখন থেকেই। এমন একটি ভূতের গল্প লিখতে চেয়েছিলাম যেখানে মৃতেরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিনিময় করতে পারে। এটিকে আইডিয়ার দিক থেকে ভাবতে গেলে অদ্ভুত বলেই মনে হয়, কিন্তু আমি অতটা সাহসী ছিলাম না যে বর্তমান সময় নিয়ে লিখবো। তাই আমি ২০ বছর আগের ১৯৮৯ সালের ওই অন্ধকার দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম।
আপনার লেখার প্রক্রিয়া কেমন? টাইপ নাকি হাতে লিখেন? অনেকগুলো খসড়া বা দীর্ঘ বিরতি থাকে নাকি হঠাৎ কাজে নেমে পড়েন? ‘দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা’ লিখতে কতদিন লেগেছিলো?
অনেকদিন লেগেছিল। আমি ২০১৪ সালে এটি লেখা শুরু করেছিলাম এবং অনেকগুলো খসড়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হতে পারে এটি প্রকাশ হতে এই পরিমাণ সময়ও প্রয়োজন ছিল। প্রথমত আমি ১৯৮৯ সালে এ নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। অতিপ্রাকৃত ফোকলোর নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। ভূতের গল্পগুলো সংগ্রহ করেছিলাম এবং কাগজ-পেন্সিল দিয়ে নোট করে ভরে ফেলেছিলাম। তারপর আমি এর রূপরেখা টাইপ করলাম। প্রতি অধ্যায়ের জন্যই এটি করেছিলাম। অবশ্যই রূপরেখাটি পাল্টাতে লাগলো। স্বরকম্প এবং ধারণাগুলোও পাল্টাতে লাগলো। কিন্তু মালির কণ্ঠস্বরটি জলদি সামনে আসতেই গল্পটি নিজেই তার তাল খুঁজে পেল, এবং পাঁচবছর পর এটি পড়ার জন্য প্রস্তুত হলো।
দীর্ঘ তালিকায় থাকা কয়েকজন লেখকের মধ্যে আপনি হলেন অন্যতম লেখক যার বই কিনা যুক্তরাজ্যের ছোটখাটো এক প্রকাশকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী এবং একজন লেখক হিসেবে এটি আপনার মধ্যে কেমন প্রভাব ফেলেছে?
এমন প্রকাশকের সঙ্গে থাকা সত্যিই আনন্দের ব্যাপার যে কিনা কাজটি যত্ন করতে পারে এবং জটিল মুহূর্তে গল্পটির যে ভালোবাসা প্রয়োজন তা দিতে পারে। আমি নিশ্চিত নই যে বড় প্রকাশকরা ততটা ধৈর্যশীল ও উদার হতেন কিনা যতটা ‘সর্ট অব বুকসের’ নাতানিয়া জানস এবং মার্ক এলিংহাম সেভেন মুনস এবং তার লেখকের প্রতি হয়েছিলেন। অদ্ভুত প্রেক্ষাপট ও জানাশোনা চরিত্রগুলো সহজে হজম করার জন্য আমরা মহামারীতে একটানা কাজ করেছি। তারপর পিটার ড্রায়ার চমৎকার প্রচ্ছদ তৈরি করে দিয়েছেন। এটা ছিল সত্যিকারের দলগত প্রচেষ্টা এবং আমরা সবাই এর সাফল্য ভাগ করতে পেরে আনন্দিত।
একজন রিভিউয়ার দ্য সেভেন মুনসকে… আংশিক ভৌতিক, আংশিক গোয়েন্দা গল্প এবং আংশিক রাজনৈতিক স্যাটায়ার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এটা কি ঠিক, অথবা সম্ভাব্য পাঠকদের এর গুরুত্বপূর্ণ অংশের ব্যাপারে আরও কিছু কি জানানো উচিত বলে মনে করেন?
তিনটিই বিভ্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট। হ্যাঁ, আমাদের কাছে রহস্য, পরকাল ও রাজনীতিকে ভারসাম্য আনার জন্য আখ্যান ছিল। তবে এটার কেন্দ্রে কিন্তু ত্রিকোণ প্রেমও রয়েছে, কিছু স্নিগ্ধ সম্পর্ক এবং ভৌতিক দর্শনের নমুনাও রয়েছে। যদিও আশা করা যায় পাঠকেরা গল্পের মধ্যে এমনভাবেই আটকে থাকবে যে এর ছোট ছোট চলমান অংশগুলো খুব কমই তাদের চোখে ধরা পড়বে।
যারা শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সঙ্গে পরিচিত নন, কোন বিষয়টি ভেবে প্রেক্ষাপট হিসেবে ১৯৮৯ সালকে বাছাই করেছেন? এই সালটির গুরুত্ব কী? তখনকার ও এখনকার শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্কই বা কী?
আমার স্মৃতিতে ১৯৮৯ সাল ছিল সবচেয়ে অন্ধকার দিন। যেখানে জাতিগত যুদ্ধ, মার্ক্সবাদীদের বিদ্রোহ, বিদেশি সামরিক শক্তির উপস্থিতি এবং রাষ্ট্রের কাউন্টার-টেরর স্কোয়াড ছিল। এটা হত্যার, গুমের, বোমা মারার ও লাশের সময় ছিল। কিন্তু ১৯৯০-এর শেষে অনেক বিরোধী মারা গিয়েছিল, তাই আমি যারা বর্তমানের খুব কাছাকাছি তাদের থেকে এইসমস্ত ভূতদের নিয়ে লিখতে নিরাপদ মনে করলাম। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে শ্রীলঙ্কার এই প্রতিবাদ, পেট্রোলের সংকট এবং প্রেসিডেন্টের পালানো নিয়ে বহু উপন্যাসই লেখা হবে। কিন্তু সেখানে সহিংসতা সৃষ্টির বিচ্ছিন্ন ঘটনা যদিও থেকে থাকে তবু আজকের এই অর্থনৈতিক কষ্টের সঙ্গে ১৯৮৯ সালের সন্ত্রাসের অথবা ১৯৮৩ সালে তামিল-বিরোধী দাঙ্গার ভয়াবহতার সঙ্গে কোনো তুলনা হয় না।
যদিও বইটি আপনার প্রথম উপন্যাসের মতো সহিসংতার বিরুদ্ধে পটভূমি তৈরি করে, কিন্তু ‘চায়নাম্যান’ খুব ফানি। বুকার বিচারকরা এটিকে ‘রাগান্বিত কমিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই সুরটি ধরাই কী আপনার লক্ষ্য ছিল, যদি তাই হয়, কেন?
একটি নির্মম ইতিহাস ও বর্তমানে একটা সমস্যায় থাকলেও শ্রীলঙ্কা কোনোমতেই ‘হতাশার দেশ’ নয়। আমরা রসিকতা করতে খুব পটু, সংকটের মুখেও আমরা রসিকতা করি। বেশি কিছু নয় শুধু ৯ জুলাইয়ের রাষ্ট্রপতির মজার ফুটেজ এবং ‘আরাগালায়া’ নিয়ে বানানো মিমসগুলো দেখুন। হাসি স্পষ্টতই কোনোকিছু মোকাবেলা করার প্রক্রিয়া। ‘চায়নাম্যান’ উপন্যাসে আমি মাতাল চাচার এবং সেভেন মুনসের জন্য সমকামী চরিত্রের আর্কিটাইপ ব্যবহার করেছিলাম। দুটি চরিত্রই মজার, অন্ধকার এবং নিষ্ঠুর অনুভূতির জন্য পরিচিত।
আপনি কি আপনার পরকাল কল্পনা করতে পারেন? যদি পারেন, তাহলে এখানে যার পরকালটি আপনি তৈরি করলেন তার সঙ্গে পার্থক্য কোথায়?
এটা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কোনো ভূতের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কিংবা পরকাল নিয়ে কোনো বিশ্বাসযোগ্য এপিফিনি পাইনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই যে এর মধ্যে কোনো ভূত শিকারি কিংবা বিখ্যাত অধ্যাত্মবাদ আছে কিনা। কে সঠিক বলে দেবে ঈশ্বরের অনুপস্থিতিতে পরকালে আমরা অসংগঠিত আমলাতান্ত্রিক সংস্করণই পাবো কিনা!
২০২০ সালে ভারতে ‘দ্য সেভেন মুনস…’ ‘চ্যাটস উইদ দ্য ডেড’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল, যদিও এটির আন্তর্জাতিক পাঠক খুঁজে পেতে বেগ পোহাতে হয়েছে। আপনার মতে এটি কেন হয়েছে এবং কীভাবেই বা এটি ‘দ্য সেভেন মুনস…’ হয়ে ওঠেছে?
দুটো একই বই, যদিও মুনস পশ্চিমা পাঠকদের কাছে সম্ভবত কম রহস্যময় ঠেকবে এবং যারা শ্রীলঙ্কা বা এর ভূতদের সম্পর্কে কিছুই জানে না তাদের কাছে এটি বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।
আপনি শিশুদের নিয়েও বই লিখেছেন এবং উইজডেনের মতে দ্বিতীয় সেরা বই যা ক্রিকেট নিয়ে লেখা হয়েছে, তার পাশাপাশি রক গান ও বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্টও লিখেছেন। আপনার পরবর্তী কাজ কী হতে যাচ্ছে এবং সেটি দ্য মুনস থেকে কতটা আলাদা হবে…হবে কী?
আমি অল্পকিছু বিষয়ে কাজ করছি, কিন্তু সেগুলোর কিছুই ক্রিকেট অথবা ভূত নিয়ে নয়।
আপনি দুই বছরের মধ্যে বুকারের জন্য মনোনয়ন পাওয়া দ্বিতীয় শ্রীলঙ্কান লেখক। পশ্চিমা পাঠকরা কী পরিশেষে শ্রীলঙ্কার লেখার গুণগত মান নিয়ে সজাগ হয়েছে নাকি এটি এখন খুব শক্ত জায়গাতেই রয়েছে? অন্য আর কোন শ্রীলঙ্কান লেখকদের পড়া উচিত?
শ্রীলঙ্কার অতীত কিংবা বর্তমান নিয়ে আর্কষণীয় গল্পের কোনো কমতি নেই। যখন আমি লেখা শুরু করেছি তখন কার্ল মুলার, রমেশ গুনাসেকারা, শ্যাম সেলভাদুরি এবং মিশাইল ওন্ডাতজেরা উঁচুমানের। পাশাপাশি আর্থার সি ক্লার্কের কথাও বলতে হয় যাকে আমি শ্রীলঙ্কান লেখক হিসেবেই বিবেচনা করি।
আজ আমাদের অনুক অরুধপ্রগাজম এবং নায়োমি মুনাভিরার মতো সাহিত্যিকরা রয়েছেন। জুধনজয়া উইজেরাত্নে এবং আমান্ডা জে এর মতো গল্পকাররা আছেন। অশোক ফেরে এবং অ্যান্ড্রো ফিদেল ফার্নান্দোর মতো কমিক লেখকরা লিখছেন। কবি বিবিমারে ভেন্ডারপোর্টেন এবং প্রাবন্ধিক ইন্দি সমরাজিভার মতো ডজনখানেক প্রতিভাধর লেখক রয়েছেন। এগুলো শুধু ইংরেজিতেই রয়েছে। আশা করছি, নতুন প্রজন্মের অনুবাদকরা বৃহত্তর পাঠকদের কাছে সমসাময়িক সিংহলিজ ও তামিল কাজগুলো তাদের অনুবাদের মাধ্যমে সামনে নিয়ে আসবে।
বুকার জেতা অথবা বুকারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় আপনার কোনো প্রিয় উপন্যাস রয়েছে?
শুধু একটি? সহজেই সেরা ১০টি থাকবে, কিন্তু আমি আপাতত পাঁচটিতেই থামবো। ‘লিংকন ইন দ্য বার্ডো’, ‘ক্লাউড অ্যাটলাস’, ‘দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল’, ‘গার্ল’, ‘উইমেন অ্যান্ড আদার’ এবং অবশ্যই ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’।