ক্যাটজিলা, প্রথম কিস্তি

ঝন্টুর গলায় মাছের কাঁটা বিঁধেছে। ডাক্তার বললেন, বিড়ালের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে। বিড়াল মাফ করে দিলে গলা থেকে কাঁটা নেমে যাবে।

প্রিন্স আশরাফপ্রিন্স আশরাফ
Published : 8 June 2023, 07:22 AM
Updated : 8 June 2023, 07:22 AM

মন্টু মিয়ার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। সেই বাড়াবাড়ি নিজের উপর নয়। অন্যদের উপর। বেশিরভাগটুকু পড়ে একমাত্র ছেলে ঝন্টুর উপর। নিজ জীবনের অপূর্ণতা সব ছেলের মধ্য দিয়ে পূর্ণ করতে চান। ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে চৌকস করতে গিয়ে ঝন্টুর জীবনটা তিনি ঝরঝরে করে ফেলেছেন।

নিজে নির্বিরোধী ঢোড়াসাপ হলেও ঝন্টুকে ডানপিটে তৈরি করতে চান। কিছুদিন ফুটবলের কোচিং, তারপর ক্রিকেট। স্কুলের অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবে ভর্তি করিয়েছেন। সুইমিংপুল থেকে সাঁতার শিখে ঝন্টু মাছের মতো সাঁতরাতে পারে। মাছের মতো সাঁতরালেও সে মাছ খেতে পারে না। কাঁটার ভয়ে ঝন্টু মাছ খায় না।

রাতে খেতে বসে মন্টু মিয়া গর্জে উঠলেন, তিনবেলা গোশ আর গোশ। মাছ খা। খাবিনে মানে? তুই খাবিনে তোর বাপ খাবে। স্ত্রী রেহেনা বললেন, তাহলে তুমিই খাও। জানো না ও মাছের কাঁটা বাছতে পারে না!

লাই দিয়ে দিয়ে তো ছেলের মাথা খেয়েছো। পারে না বলে কোনদিন শিখবে না নাকি? আজ ও নিজে নিজে খাবে। তুমি আমি কেউ হেল্প করবো না। নাইনে পড়ুয়া ছেলে, দুদিন পরে হোস্টেলে গেলে কী করবে? ঝন্টু প্লেটে জাতীয় মাছের টুকরো নিয়ে রাগের চোটে তড়িঘড়ি করে অপটু হাতে মাছ বেছে খেতে শুরু করল। কয়েক লোকমা খাওয়ার পরে ঝন্টু গলা টানতে শুরু করল।

মন্টু মিয়া রাগি গলায় বললেন, কি হয়েছেটা কী? গলা টানছিস কেন? ঝন্টু কোনমতে বিকৃত কণ্ঠে বলল, ‘গলায় কাঁটা ফুটে..’ সে আর কিছু বলতে পারল না। বমি করল। সেই বমি কিছুক্ষণ পরপর চলতে লাগল। চোখমুখ লাল হয়ে গেল। হেঁচকি দিতে লাগল ক্রমাগত। চোখ মুখ ফুলে একাকার হয়ে গেল। কথা আটকে যেতে লাগল। মাছের কাঁটা যে এমন ভয়াবহ ব্যাপার হতে পারে তা আগে জানলে মন্টু মিয়া কখনও মাছ খাওয়ানোর জন্য চাপাচাপি করতেন না। অপরাধবোধে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। 

এত রাতে যন্ত্রণাকাতর ছেলেকে নিয়ে কী করা যায় বুঝতে পারছেন না। এই এলাকায় তিনি নতুন ভাড়াটে হিসেবে এসেছেন। তেমন কিছুই চেনেন না। আশপাশে কোন ডাক্তারখানা দেখেছেন বলে মনে পড়ে না। তবুও এভাবে ঘরে বসে থাকা যায় না। ছেলেকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়তে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসা করানো হয়েছে। শুকনো ভাতের দলা গেলানো। গলা নরম করার জন্য ঘি, মধু খাওয়ানো। গলায় গরম সেঁক। কিছুতে কিছু হয়নি।

ঝন্টুকে নিয়ে নিচে নেমে দারোয়ানকেই হাতের কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মোজাহার, আশপাশে কি কোন ডাক্তারখানা আছে? কাঁটার ডাক্তার?

না। এই এলাকায় কোন ডাক্তারখানা নেই। ওষুধের দোকানে ডাক্তার বসে। তাও এই রাত বারোটায় বন্ধ হয়ে গেছে।

তাহলে এখন কী করা যায়? ছেলের গলায় তো কাঁটা ফুটেছে। মাছের কাঁটা।

এইখানে কয়েক বাড়ি পর একজন ডাক্তারের বাড়ি আছে। সামনের ঝিলের ধারে। সেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে দেখতে পারেন।

বাড়িতে পাওয়া যাবে?

মফেজ ডাক্তার দিনরাত বাড়িতেই পড়ে থাকে। গেলেই পাবেন। সবাই বলে খুব বড় ডাক্তার। মাছের কাঁটা তোলা তো তার কাছে হাতের ময়লা। ঘষা দেবে উঠে যাবে।

আমি তো এখানের ঝিলটিল চিনি না। তুমি একটু আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও।

ঠিক আছে চলেন। আমি শুধু বাড়ি দেখিয়ে দিয়েই চলে আসব। পাহারার কাজ...

ঝিলের ধারে পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। গেট আছে না থাকার মতো। খোলা-ই। বারকয়েক ধাক্কা দিয়ে যখন বুঝলেন কাজ হবে না তখন মোজাহার বলল, আপনি সরাসরি ভেতরে যান চলে যান। পাগলা ডাক্তারের বাড়িতে আর কেউ থাকে না।

সে চলে গেল। বাড়ির আধভাঙা সিঁড়িতে পা দিতেই বারান্দার আলো জ্বলে উঠল। ভেতরের অন্ধকার থেকে আলোয় যে মানুষটি বেরিয়ে এলেন তাকে ঠিক স্বাভাবিক মানুষ বলা যায় না। সিনেমায় জেলখানার বিশ বছর সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে যেমন দেখায় সেরকম।

কী ব্যাপার? এত রাতে আপনারা? অবৈধ ট্রেসপাসিং। মতলব কী? কী চাই?

মফেজ ডাক্তারের কাছে এসেছিলাম। উনি কি বাসায় আছেন?

আমিই মফেজ ডাক্তার। আমার কাছে কী দরকার?

রোগী চিকিৎসার জন্য। আমার এই ছেলেটার গলায়...

মফেজ ডাক্তার বাক্য শেষ করতে দিলেন না। তার আগেই গর্জে উঠলেন, আমি ডাক্তারি করি আপনাদের কে বলল? কোন ছাগল? আমি ডাক্তার নই। ডক্টর। পিএইচডি। গবেষক। গবেষণা করি।

ও আচ্ছা। আমরা তাহলে ভুল শুনেছি। সরি। এত রাতে আপনাকে বিরক্ত...

আপনার ছেলের কী সমস্যা? ওর গলায় কী হয়েছে?

মাছের কাঁটা ফুটেছে?

কী মাছ?

ইলিশ মাছ।

আমাদের জাতীয় মাছের কাঁটা একটা জাতীয় সমস্যা। বসুন। দেখছি কিছু করা যায় কিনা?

মন্টু মিয়া নেতিয়ে পড়া ঝন্টুকে নিয়ে বারান্দার কাঠের বেঞ্চে বসলেন। মফেজ ডাক্তার ঝন্টুর গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, ওকে ক্যাট স্ক্যান করাতে হবে।

মানে?

মানে সেই গল্পটার কথা শোনেননি! এক লোককে মরার মতো অবস্থায় ডাক্তারের কাছে আনা হয়েছে। ডাক্তার দেখলেন। তারপর একটা বিড়াল নিয়ে এলেন। বিড়াল রোগীর মাথার চারপাশ শুকে গেল। ডাক্তার রোগীকে ওষুধ দিলেন। বিল এলো দুই হাজার তিনশ টাকা। রোগীর লোকজন তো অবাক। এতো বিল। ডাক্তারের ফিস এতো! ডাক্তার বলল, আরে না না, আমার ফিস মাত্র তিনশ। আর বাকি দুহাজার টাকা ক্যাট স্ক্যান।

মন্টু মিয়ার হাসির মতো অবস্থা নেই। তিনি একটু রাগত গলায় বললেন, রাখুন আপনার জোকস ফোকস। এখন কী করবেন তাই বলেন? পারবেন ওর কাঁটা বের করতে?

সেটা নির্ভর করছে বিড়াল খুঁজে পাওয়ার উপর।

মানে?

ওকে বিড়ালের কাছে নিয়ে বিড়ালের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে। বলতে হবে, মহামান্য মেকুর, আপনার খাদ্য আমি খেয়ে অন্যায় করেছি। অন্যের খাদ্য নিজে খাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাকে মাফ করে দিন। বিড়াল মাফ করে দিলে গলা থেকে কাঁটা নেমে যাবে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

বিড়াল যদি মাফ না করে?

করবে। করবে। পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলে ওরা মাফ করে দেয়। বড় নরোম দিল ওদের। আপনারা একটু বসুন। আমি বিড়াল ধরার ব্যবস্থা করছি। খোকা বেশি কষ্ট হচ্ছে? আর হবে না। একটা বিড়াল ধরতে পারলেই কেল্লাফতে।

মফেজ ডাক্তার ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর নানা যন্ত্রপাতিসহ বেরুলেন। অপারেশন ফাইন্ডিং ক্যাট। যেখানেই বিড়াল পাবো সেখানেই পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবো।

আপনার হাতে এইসব হাবিজাবি কী? বিড়াল পাবেন কোথায়?

তার উপায় আছে! এই যে টেপ রেকর্ডার দেখছেন এখানে বিড়ালের ডাক রের্কডিং করা আছে। স্বজাতির ডাক শুনে বিড়াল না এসে পারবে না। বিড়ালের ডাকে বিড়াল আসে। পরীক্ষিত সত্য। আর এই পাত্রে মাছ। অ্যাকুরিয়ামের মাছ। জ্যান্ত। মাছের গায়ে হিপনোটিক পাউডার দেওয়া। বিড়াল সম্মোহিত হবে। জ্ঞান হারাবে।

জ্ঞান হারানো বিড়াল কি ক্ষমা করে দিতে পারবে?

সেক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এই ট্রাপটাও নিয়েছি। মফেজ ডাক্তারের হাতে প্যারাসুটের মতো বড় বেলুন জাতীয় জিনিস। অনেকটা ছোট বাচ্চাদের মশারির মতো।

মন্টু মিয়া বললেন, আপনি এই শীতে শুধু একটা পাঞ্জাবি পরে বাইরে বেরুচ্ছেন?

কোন অসুবিধে নেই। সন্ধ্যেয় একটা এয়ারকন্ডিশন পিল খেয়ে নিয়েছি। বারো ঘণ্টার জন্য শীত গ্রীষ্ম কাবু করতে পারবে না।

আর কথা না বাড়িয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে। পথেঘাটে যদি বেওয়ারিশ বিড়াল পাওয়া যায়। ঢাকা শহরে গৃহপালিত বিড়াল সমস্যা। মানুষ এখন আর বিড়াল পোষে না। অ্যাকুরিয়ামে বিদেশি মাছ পোষে।

রাস্তার মোড়ে ডাস্টবিনের ময়লা ঘাঁটতে থাকা একটা বিড়াল দেখে মফেজ ডাক্তার কাজে নেমে পড়লেন। বিড়ালের ডাক শুনে বড় বিড়ালটা আস্তে আস্তে সেদিকে এগিয়ে আসে। মফেজ ডাক্তার অন করা টেপরেকর্ডারের পাশে মাছ রাখেন। তার উপর মশারির মতো ফাঁদ।

মাছের লোভে বিড়াল এগিয়ে আসে। অন্য বিড়ালের ডাকে আকৃষ্ট হয়। সতর্কও। কেউ নেই দেখে মাছে মুখ দেয়। তখনই ফাঁদ নেমে আসে। মাছের কাঁটা চিবুতে থাকা বিড়াল ওষুধের প্রভাবে নেতিয়ে পড়ে। নেতিয়ে জ্ঞান হারানোর আগেই ঝন্টু বিশালদেহী কালো হুলো বেড়ালের নোংরাঘাঁটা পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেয়।

জ্ঞান হারানোর আগেই বিড়াল যে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে সেটা ঝন্টুর কথাতে বোঝা গেল। দেখেছো বাবা বিড়ালটা কত্তো বড়। এত্তো বড় বিড়াল আমি আমার বাবার জন্মে দেখিনি। তুমি দেখেছো?

বিড়াল যে সাইজে বড় সেটা সবাই আগে দেখেছে। তবুও ঝন্টুর কথায় আরেকবার বিড়ালের দিকে তাকায়। দেখছো বাবা বিড়ালটা যেন একটা ‘ক্যাটজিলা’। মফেজ ডাক্তার সন্দিগ্ধ সুরে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললি? কোন জেলা?

জেলা নয়। জিলা। ক্যাটজিলা।

সেটা কী? ব্যাপারটা কী রকম?

গডজিলার মতই। বিড়ালের ইংলিশ ক্যাটের সঙ্গে গডজিলার জিলা। ক্যাটজিলা।

 চলবে…