আব্বা আড়াইসিধা কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। আমি হলাম তার কনিষ্ঠ সন্তান। আব্বার কোল আমার পড়তে বসার চেয়ার-টেবিল। খুব ছোট থাকতে অনেককিছু মুখে মুখেই মুখস্থ করিয়েছিলেন।
Published : 08 Oct 2022, 03:58 PM
আমাদের পাতাকুড়ানি দিনগুলো পেরিয়ে একটু সামনে এগিয়ে এলেই ঝলমলে আকাশ। কথা ঠিকঠাক শেখার আগেই যার হাতেখড়ি হয়েছিল অ আ ক খ। আশ্বিনের এক উজ্জ্বল ভোরের মতো আমার জীবনের সূর্য উদয় হয়। আমি পথ চলতে শুরু করি একদল পথিকের সাথে।
দুই হাজার সাল। প্রচণ্ড উদ্যম নিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে যাই দেড়-দু’বছরের বড় ভাইবোনদের সাথে। কিন্তু বিধির বিধানের মতো আমার সামনে চলে আসলো এক কঠিন বিধান। স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে একটি পরীক্ষায় পাশ করতে হবে আমাকে। কিন্তু আমি অনায়াসেই সেই পরীক্ষায় ফেল করি। কেননা আমার মেধা মনন আমাকে সাহায্য করতে চাইলেও আমার শরীর আমাকে সাহায্য করেনি। ডান হাত দিয়ে বাম কানে স্পর্শ করতে না পারার মতো কঠিন পরীক্ষা আমাকে আর দিতে হয়নি।
সেবারের কষ্ট সইবার মতো ক্ষমতা আমি পেয়েছিলাম আমার পরিবারের কাছে। তারা আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। কীভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হয় অযোগ্য হয়েও। আমি পেরেছিলাম। পরের বছরেই আমি সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পাই। প্রথম শ্রেণির বই এতটাই গলাধঃকরণ করেছিলাম যে শিক্ষকেরা বাধ্য হয়েছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করাতে। আমি আবার আমার প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম।
কোন বাড়ির পেছনে পাখি বাসা বেঁধেছে, কোথায় একটা হাঁস ডিম পাড়বে বলে অস্থির হয়ে আছে, কোন বাড়ির আম খেতে মিষ্টি, কোন বাড়ির বড়ই তাড়াতাড়ি পেকে গেছে, কোন বাড়িতে জিলাপির গাছ ফুল দিয়েছে, স্কুলের পেছনের কবরটা কতটা বিপদজনক, শাপলা শালুকের দিনে গলা অব্দি ডুবে এগুলো কুড়িয়ে আনা ইত্যাদি ছিলো আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ।
এই জার্নির শুরুটা আমার আব্বাকে ঘিরে। আব্বা আড়াইসিধা কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। টাইফয়েডে তার একটা পায়ে সমস্যা হওয়াতে আমৃত্যু তিনি ঘরমুখো ছিলেন। ক্লাস শেষ করেই চলে আসতেন বাড়ি। তাকে খুব কমই দেখেছি বাজারে বসে আড্ডা দিতে। আড্ডার এই পুরো সময়টা আব্বা আমাদের দিতেন। আমি হলাম কনিষ্ঠ সন্তান। আব্বার কোল আমার পড়তে বসার চেয়ার-টেবিল। খুব ছোট থাকতে অনেককিছু মুখে মুখেই মুখস্থ করিয়েছিলেন, যার ফলাফল আমি পরবর্তীতে পেয়েছি।
পঞ্চাশোর্ধ প্রতিবেশীদের সাথে আমার ভাব ছিলো ভীষণ। স্কুল থেকে ফিরলেই তাদের সাথে দেখা করতে হতো। কেননা তলব করে রেখেছে ফেরার আগেই। যেন ফিরলেই আমি দেখা করতে যাই। তাদের আমি বিভিন্ন দোয়া শেখাতাম। আব্বার শেখানো গজল বসে বসে তাদের শুনাতাম।
বর্ষায় দলবেঁধে অনেকটুকু পথ পেরিয়ে স্কুলে যেতে হতো। সুদিনে কয়েকটা বাড়ির অলিগলি পেরুলেই স্কুল। কোন বাড়ির পেছনে পাখি বাসা বেঁধেছে, কোথায় একটা হাঁস ডিম পাড়বে বলে অস্থির হয়ে আছে, কোন বাড়ির আম খেতে মিষ্টি, কোন বাড়ির বড়ই তাড়াতাড়ি পেকে গেছে, কোন বাড়িতে জিলাপির গাছ ফুল দিয়েছে, স্কুলের পেছনের কবরটা কতটা বিপদজনক, শাপলা শালুকের দিনে গলা অব্দি ডুবে এগুলো কুড়িয়ে আনা ইত্যাদি ছিলো আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ।
স্কুলের পাশেই সাব বাড়ির ব্যক্তিগত কবরস্থান। তার ঠিক পাশেই একটা সুন্দর পুকুর। পুকুরটার চারপাশে তিনটে ঘাট। পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের ঘাটটাতে ওই বাড়ির সব পুরুষেরা গোসল করতেন। একটা ঘাট নারীদের জন্য বিশেষভাবে বানানো হয়েছে। চারপাশে দেয়াল। আমার দেখলেই কেমন দমবন্ধ লাগতো। তখনকার সময়ে আমার ওই বাড়ির নারীদের কেমন খাঁচায় বন্দি পাখি মনে হতো।
আরেকটি ঘাট স্কুলের পাশে। পুকুরের উত্তর পাশে অবস্থান করছিলো ঘাটটি। একদিন সবার সাথে বাজি ধরলাম যে খুব দ্রুত পানির দিকে নামতে পারবো। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রচণ্ড গতিতে উপর থেকে নিচে নামতে গিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সোজা পুকুরের পানিতে। উপায়ন্তর না পেয়ে দৌড় দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। এদিকে ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে ক্লাস শুরু হয়ে গেলো বলে। স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করে সিভিল ড্রেস। ঠিক সেদিনই নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ির অবস্থার কথা টের পেয়েছিলাম।
একবার স্কুলে একদল লোক এসেছিলো চুল বিষয়ে সচেতন করতে। আমার কোঁকড়া চুল এসবে অভ্যস্ত নয়। অনেক আলোচনা শেষে সবার হাতে একটা করে শ্যাম্পুর মিনি প্যাক ধরিয়ে দিয়েছিলো। আমার অগোছালো চুল জীবনের প্রথম শ্যাম্পু ব্যবহার করে। সানসিল্ক শ্যাম্পুর এই মজার গন্ধে বিমোহিত হয়েছিলাম। এই অবাধ্য চুলগুলো আরও ঢোলের তাল পেতো সোহেল স্যারের বাড়ির পাশে গেলে। আসলে ওখানে ছাগল চড়াতে যেতাম। এই প্রাণীদের বড় একটা সময় কেটেছে ওই মাঠে। সেখানে যেমন অবাধ বিচরণ ছিলো আমাদের তেমনই ছিলো ভুতের ভয়ও। মাগরিবের ঠিক আগে আগেই আমরা বাড়ি পৌঁছে যেতাম।
অভাব আমাদের যেমন একটি ডিম পাঁচ থেকে সাতজনকে ভাগ করে খেতে শিখিয়েছে তেমনই শিখিয়েছে পাঁচ বছর একই স্কুল-ড্রেস ব্যবহার করতে। আব্বা প্রথম বছরই লম্বা করে ড্রেস বানিয়ে দিয়েছেন যেন কয়েক বছর টিকে যায়।
‘আড়াইসিধা পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ তখন আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন খুব সুদর্শন। নাম মনে নেই স্যারের। ওনার শুভ্র শ্বশ্রূ কেঁপে উঠতো হাসির দাপটে। দ্বিতীয় শ্রেণি পেরিয়ে আমি তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। পুরোটা বছর ঠিকঠাক পড়াশোনা করলেও চতুর্থ শ্রেণিতে উঠার সুযোগ হয়নি আমার। বাঁধ সাধলো ‘বেঁটে’ উপাধি। আমাকে আবারও তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতে হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির বই এতটাই ভারি ছিলো যে আমার মতো বেঁটে মানুষের তা বহন করার শক্তি ছিলো না। আমি আবার পিছিয়ে গেলাম একধাপ।
আমাদের সময়ে বিটিভির প্রাধান্য ছিলো খুব। শুক্রবার মানেই আলিফ-লায়লা। নতুন কুঁড়ি, হানিফ সংকেতের ইত্যাদি, মাহফুজের অভিনীত পাতার বাঁশির সেই নাটক, সিন্দাবাদ ইত্যাদি ছিলো আমাদের বিনোদনের অংশ। বৃহস্পতিবার স্কুল থেকে ফিরতেই এক সপ্তাহের অপেক্ষা শেষ হতো। চেনা চলচ্চিত্র কতবার দেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে প্রতিবারই নতুন নতুন ভাবে দেখতাম। আর স্কুলে গিয়ে সেগুলোর পর্যালোচনা করতাম।
সাব বাড়ির প্রৌঢ়রা নাকি একসময় একই পাতিলে ভাত খেতো আমাদের পিতামহ, প্রপিতামহদের সাথে। কিন্তু অর্থ আমাদের আলাদা করে দিয়েছে সেই কবেই। তো সেই বাড়ি পার হয়েই আমাদের স্কুলে পৌঁছাতে হয়। সাব বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই খাল ঘেঁষে একটি সুন্দর পুকুর। এই পুকুরের পাড়টাকে আমরা সিন্দাবাদের সেই পাহাড় মনে করতাম। নিচু জমি থেকে পাহাড় বেয়ে উঠার মতো কত নিখুঁত অভিনয় না করেছি!
দেওয়ান কাকা বংশের সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন। ওনার একটা কাঠগাছের বাগান ছিলো। খেলাধুলা করার বেশ কয়েকটা জায়গা ছিলো স্কুলের আশপাশে। এর মধ্যে এই কাঠ বাগান ছিলো আমাদের সবার খুব পছন্দের। কিন্তু কাকা একদমই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই এসে বকে যেতেন আমাদের। এমনকি ক্লাসে এসেও রেহাই পেতাম না। টেন্স, সিলেবলের মতো কঠিন কঠিন (সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা প্রত্যেকেরই গোচরে আছে) প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে অথর্ব হয়ে বেঞ্চে বসে থাকতাম। সেই সাথে মিষ্টি মিষ্টি কিছু বকাঝকাতো ছিলোই।
পঞ্চম শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি কলম দিয়ে খেলেছি এবং নতুন প্রধান শিক্ষকের কাছে থাপ্পড় খেয়েছি। থাপ্পড় খাওয়ার মূল কারণ অতি দ্রুত লেখার চেষ্টা করা। যদিও এটা খারাপ অভ্যেস না। খারাপ তখনই হতো যখন দশ লাইনের কবিতায় স্যার সাত থেকে আটটা ভুল খুঁজে পেতেন এবং এই ভুলের পেছনে দায়ী ছিলো আমার তাড়াহুড়ো করা। স্যার আমাকে শিখিয়েছেন সব কাজে তাড়াহুড়ো না করতে।
দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি বছর আমি একটি স্কুল ড্রেসে আবদ্ধ ছিলাম। বলা যায় বাধ্য হয়েই। কেননা অভাব আমাদের যেমন একটি ডিম পাঁচ থেকে সাতজনকে ভাগ করে খেতে শিখিয়েছে তেমনি শিখিয়েছে পাঁচ বছর একই স্কুল-ড্রেস ব্যবহার করতে। আব্বা প্রথম বছরই লম্বা করে বানিয়ে দিয়েছেন যেন কয়েক বছর টিকে যায়। এবং হলোও তাই। ইস্ত্রির ব্যবহার ছিলো না বলে স্কুল ড্রেসের অবস্থা তখন বুড়ো মানুষের চামড়ার মতো হয়েছিলো।
তবুও জীবনকে আটকে দিতে পারলে আমি হয়তো ওই পাতাকুড়ানি দিনগুলোতে আটকে দিতাম। দলবেঁধে হাতিয়ে মাছ ধরতে যেতাম লাইট্টাডিংগি পর্যন্ত। বর্ষার মৌসুমে আদু ভাই খ্যাত চাচাতো বোনকে পাম দিয়ে তার নৌকায় করে অল্প সময়ে চলে যেতাম স্কুলে। সবাই মিলে প্রচুর খেলাধুলা করতাম। শিক্ষকের বকুনি শুনতাম। আমার কাছে শৈশব থাকতো, বাবা থাকতো, আমাদের পুরনো চারচালার ঘরটা থাকতো। যদিও মাটির পুতুলের বিয়েটা ঠিকঠাক দিতে পারিনি পয়সার অভাবে। তারপরও খুব করে খেলার সাথীরা থাকতো। সামান্য বিষয়ে যে বান্ধবীদের সাথে ঝগড়া হতো আজ তা অভিমান হতো।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!