রাজার আগমনের পথ চেয়ে

শিশুরা তাদের খেলার মাঠে খেলছিলো। এমন সময় রাজদরবারের বুড়ো ঘোষক তার টিনের মাইক নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলো আর রাজার আগমনবার্তা ঘোষণা করছিলো, ‘সাবধান...হুশিয়ার! মহামান্য রাজা আসছেন...। তিনি এই রাস্তা দিয়ে যাবেন। সবাই সাবধান...।’

মাজহার সরকারমাজহার সরকার
Published : 4 August 2018, 02:12 PM
Updated : 5 August 2018, 12:38 PM

তীব্র ভেরীবাদ্য বাজছিলো আর তার ডঙ্কায় বারবার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিলো রাজার আগমনের খবর। শিশুরা তাদের খেলা বন্ধ করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘তুমি কি শুনতে পাচ্ছো, মহামান্য রাজা আসছেন?’ এক শিশু বললো।

অপর শিশু বললো, ‘রাজা যদি দেয়ালের ওপারে তাকান তাহলে তো আমাদের খেলার মাঠ দেখতে পাবেন, কে জানে! ঘোষকের কথা শুনে আমাদের খেলা বন্ধ করা উচিৎ।’

খেলার মাঠটি ছিলো খুব নোংরা, এক কোণে ছেড়া কাগজ ও ভাঙা খেলনার টুকরা পড়ে ছিলো। শিশুরা ছিলো সত্যি খুব অসচেতন। 

এক শিশু দৌড়ে গিয়ে একটা নিড়ানি নিয়ে এলো। অন্য এক শিশু নিয়ে এলো একটা ঝুড়ি। আরেক শিশু বাগানের পেছন থেকে নিয়ে এলো একটা ঠেলাগাড়ি। সবাই মিলে খেলার মাঠ পরিষ্কার করতে লেগে গেলো। কেউ নিড়ানি দিলো, কেউ ময়লাগুলো ঝুড়িতে তুললো আর বাকিরা ঠেলাগাড়িতে করে সেগুলো দূরে নিয়ে জমা করলো। যতক্ষণ না পুরো মাঠ সাফ হলো তারা খুব পরিশ্রম করে যেতে লাগলো।

 

‘যাক, এখন মাঠ পরিষ্কার হলো’, এক শিশু বললো। অপর শিশু বললো, ‘শুধু পরিষ্কার করলেই চলবে না, সুন্দরও করে তুলতে হবে। কেননা আমি শুনেছি রাজা সুন্দর জিনিস খুব পছন্দ করেন।’

এ কথা শুনে আরেক শিশু দৌড়ে গিয়ে এক ঝুড়ি নলখাগড়া নিয়ে এলো আর তা মাঠে ছড়িয়ে দিলো। বাকিরাও বসে নেই। হই হই করে তারা ছুটে গেলো আর সঙ্গে নিয়ে এলো ওক গাছের পাতা ও পাইন। তারপর তারা ফুলের মালা ও পাতার ঝালর তৈরি করে মাঠের চারদিকে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলো।

সবচেয়ে ছোট্ট শিশুটি গিয়ে নিয়ে এলো এক ঝুড়ি গাঁদা ফুলের কুড়ি আর তা ছড়িয়ে দিলো পুরো মাঠে। সে বললো, ‘দেখো দেখো! এখন মাঠটাকে সোনার মতো লাগছে!’ সব কাজ শেষে মাঠে গোল হয়ে দাঁড়ালো শিশুরা আর আনন্দে হাততালি দিতে লাগলো। 

এক শিশু বললো, ‘শুধু আজ নয়, আমাদের সব সময়ই উচিৎ মাঠটাকে এরকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।’ বাকিরাও তার কথায় সায় দিলো, বললো, ‘তুমি ঠিক বলেছো। এখন থেকে আমরা আমাদের মাঠ এভাবে সুন্দর রাখবো।’

তারপর তারা সমবেত দাঁড়িয়ে রাজার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু রাজা আর আসেন না।  আস্তে আস্তে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। শিশুরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, রাজা আসেন না। দুপুর গড়িয়ে সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লো তখনো শিশুরা রাজার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো। রাজা আসলেন না, কিন্তু সেসময় ওপাশ থেকে আসতে দেখা গেলো দুজন লোককে।

এদের একজন হলেন ঢিলা আলখাল্লা পরা ভ্রমণকারী, আরেকজন ক্লান্ত চেহারার দয়ালু পথিক। দেয়ালের ওপারে মাঠে শিশুদের অপেক্ষা করতে দেখে পথিক দাঁড়িয়ে পড়লো।

পথিক উঁকি দিয়ে মাঠ দেখে বললো, ‘বাহ! কি সুন্দর জায়গা!’ ক্লান্ত পথিক বললো, ‘আমি কি তোমাদের এখানে আসতে পারবো? আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, আমি একটু বিশ্রাম নিতে চাই।’

তারপর শিশুরা তাকে ধরাধরি করে ভেতরে নিলো আর একটি বড় চেয়ারে বসালো। চেয়ার বলছি কি, সেটা ছিলো শিশুদের বানানো সিংহাসন। পুরাতন পিপা ভেঙে, লাল অঙ্গরাখা জড়িয়ে, ফুল-লতাপাতা প্যাঁচিয়ে এই সিংহাসন তারা বানিয়েছিলো মহামান্য রাজার জন্য। আর তা ছিলো সত্যি খুব সুন্দর।

 

এক শিশু বললো, ‘আমাদের খেলার মাঠে আপনাকে স্বাগতম। কিন্তু এটাকে আমরা পরিষ্কার করে সুন্দর করে সাজিয়েছিলাম মহামান্য রাজার জন্য। কিন্তু তিনি আসেননি।’

‘খুব ভালো, অসাধারণ সাজিয়েছো তোমরা’, লোকটা বললো।

আরেক শিশু বললো, ‘আমাদের মনে হয়েছে নোংরা আর অপরিষ্কার থাকার চেয়ে পরিচ্ছন্ন থাকা খুব জরুরি, রাজা আমাদের দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন।’

‘খুব ভালো বলেছো’, পথিক বললো।

সবচেয়ে ছোট্ট শিশুটা বললো, ‘আমরা যে সিংহাসন বানিয়েছি মহামান্য রাজা না এলেও ক্লান্ত পথিকদের আমরা বসতে দিতে পারবো।’

‘বাহ, কি সুন্দর কথা!’, পথিক উৎফুল্ল হয়ে বললো।

পথিক শিশুদের বানানো সিংহাসনে বসে বিশ্রাম নিতে লাগলেন আর তার চারপাশে ঘিরে থাকা শিশুদের কথা শুনতে লাগলেন। যে যতকিছু জানে তা-ই সুন্দর করে জানাচ্ছিলো পথিককে, পথিকও শিশুদের এমন কোমল কথায় মন ভরাচ্ছিলেন।

শিশুরা এবার গল্প জুড়ে দিলো। কেউ বললো শস্যাগারে পাঁচটি কুকুরছানার গল্প, কেউ বললো গায়ক পাখির চারটা নীল ডিমওয়ালা নীড়ের গল্প, কেউ বললো সেই গল্পটা- ওই যে সাগরপাড়ে সোনার খোলক বেড়ে উঠার গল্প। ঘুমের চোটে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো পথিকের, তবু সে শিশুদের একের পর এক গল্প শুনে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলো।

একটু পর পথিক পানি খেতে চাইলেন। শিশুরা পরম উৎসাহে একটা ছোট্ট কাপে পানি নিয়ে এলো। কাপের হাতলটা ছিলো সোনার তৈরি। ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে নিয়ে পথিক চলে যেতে লাগলো।

কিন্তু যাবার আগে সে শিশুদের মাথায় হাত রেখে আদর করলো ও তাদের উষ্ণ হৃদয়ের ছোঁয়া পেলো।

শিশুরা দেয়ালের ওপর নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আর পথিকের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আর সূর্যের রক্তাভ আলো স্ফীত হয়ে রাস্তার ওপর লম্বালম্বি হয়ে পড়লো।

‘লোকটাকে সত্যি খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে’, এক শিশু বললো।

‘কিন্তু সে অনেক দয়ালু’, আরেক শিশু বললো।

‘ওই দেখো দেখো!’ সবচেয়ে ছোট্ট শিশুটা চিৎকার করে উঠলো। বললো, ‘দেখো, লোকটার চুলে সূর্য জ্বলে উঠে চকচক করছে। মনে হচ্ছে তার মাথায় একটা মুকুট!’

মূল গল্প ‘দ্য কামিং অব দ্য কিং’ লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শিশুসাহিত্যিক লরা ই রিচার্ডস (১৮৫০-১৯৪৩)। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি নব্বইটিরও বেশি বই লিখেছেন। এই গল্পটি অস্কার ওয়াইল্ডের বিখ্যাত গল্প ‘দ্য সেলফিশ জায়ান্ট’ এর কথা মনে করিয়ে দেয়, গল্পটি ছোট-বড় সবার অবশ্য পাঠ্য।

কিডস পাতায় শিশু-কিশোররা লিখতে পারো। অবশ্যই নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!