সংক্রমণ কমলেও সতর্কতায় ‘ঢিলেমি নয়’

করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের ব্যাপক বিস্তারে মহামারীর মধ্যে সবচেয়ে বাজে সময়টা পার করে এসে এখন সংক্রমণের হার অনেকটা নেমে এলেও সতর্কতায় ঢিল না দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2021, 05:20 PM
Updated : 21 Sept 2021, 05:39 PM

তারা বলছেন, জুলাইয়ের লকডাউনের পর টিকাদানের গতি বেড়েছে। পাশাপাশি একসঙ্গে অনেক মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়েই হয়ত সংক্রমণের হার কমতে কমতে ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। 

কিন্তু মহামারী শেষ হয়ে গেছে, এমন মনে করার কোনো কারণ এখনও ঘটেনি। বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে ভাইরাসকে সঙ্গী করে বাঁচার প্রস্তুতি নিচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষকেও সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। না হলে যে কোনো সময় আবার ভাইরাসের দাপট ফিরে আসতে পারে। 

মহামারীর মধ্যে এখনই সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বাংলাদেশ; কিন্তু কোরবানির ঈদের পরদিন বিকালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকতে বেড়াতে আসা মানুষদের মুখে ছিল না মাস্ক। ছবি: সুমন বাবু

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েকটি দেশে আমরা দেখেছি সংক্রমণের হার শূন্যে নেমে যাওয়ার পরও আবার সংক্রমণ বেড়ে গেছে। সুতরাং মহামারীর ভয় কেটে গেছে- এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।

“বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের যে ধারা, তাতে যতদিন পর্যন্ত পুরো নিয়ন্ত্রণে না আসে, সংক্রমণ কমে গেলেও আবার বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যাবে। সংক্রমণ আবার বাড়বেই, সেটাকে যতটা দেরি করানো যায়, যত নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেটাই আমাদের জন্য ভালো।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত জুলাই মাসে দেশে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল, যা মহামারীর দেড় বছরে সর্বোচ্চ। 

এরপর অগাস্ট মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমে ২ লাখ ৫১ হাজার ১৩৪ জন হয়। আর ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৪৫ হাজার ১৮২ জন।

দেখা গেছে, জুলাই মাসে দৈনিক গড়ে ১০ হাজার ৮৪৬ জন, অগাস্টে ৮ হাজার ১০২ জন এবং সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ১৫১ জন করে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

দেড় বছর পর খোলার প্রথম দিন রোববার স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক মুখে দূরত্ব রেখে শ্রেণি কক্ষে ঢুকতে হয়েছিল চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের। ছবি: সুমন বাবু

পুরো জুলাই মাসে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ৬ হাজার ১৮২ জন, যা একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ। এরপটর অগাস্টে ৫ হাজার ৫১০ এবং ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৮২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

অর্থাৎ জুলাইয়ে দৈনিক গড়ে ১৯৯ জন, অগাস্টে ১৭৮ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের মধ্যে গত ২৪ জুলাই নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে শুরুতে শনাক্তের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। আর মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

গত মার্চের পর এই প্রথম দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। আর মহামারীর পুরো সময়ের বিবেচনায় পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ।

কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ মনে করছেন, মহামারীর যে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে আছে, তা ‘অনেক ভালো’।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, “জুলাই মাসে দুটি কঠোর লকডাউন গেছে। দেশের জনসংখ্যার একটা অংশ টিকার আওতায় আসায় মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। সংক্রমণের হার ৩২ শতাংশের উপরে উঠেছিল, তা ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, প্রতিদিন সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে।

বাবুবাজার সেতুর নিচে বাহারি রঙের মাস্ক নিয়ে বসেছেন পাইকারি বিক্রেতারা। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

“এটা ভালো জায়গা। কিন্তু আমরা এই ভালো জায়গা থেকে আরও ভালো জায়গায় যাব, যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধিটা ঠিকমত মানি। আর যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানি, বেপরোয়া হয়ে যাই, তাহলে সংক্রমণ কিন্তু আবার বাড়বে। আমি ইদানিং লক্ষ্য করছি মাস্ক পরার ক্ষেত্রে আবার কিছুটা শিথিলতা দেখা যাচ্ছে।”

ডা. মুশতাক হোসেনও মনে করেন, কঠোর লকডাউনের পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ায় মানুষের ভেতরে কিছুটা হলেও ভয় কাজ করেছে, ফলে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা বেড়েছে।

এখন সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় আবার মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে আগের জীবনে ফিরে যেতে চাইবে। কিন্তু সবার সুরক্ষার জন্য ‘অনেকগুলো কাজ’ এখন করা প্রয়োজন।

“এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শনাক্ত রোগী পেলেই চিকিৎসার পাশাপাশি আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং দ্রুত টিকা নিয়ে নেওয়া।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলছেন, জুলাই-অগাস্ট জুড়ে চলা সংক্রমণের তীব্রতা যে ভাঙা গেছে, তাতে হয়ত এক ধরনের স্বস্তি আছে। তবে তাতেই খুশি হয়ে গেলে চলবে না।

“ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত অনেক লোককে আক্রান্ত করায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে যা হার্ড ইমিউনিটির কাছাকাছি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ব্যাপকভাবে সংক্রমণ হওয়ায় সেখানেও নতুন করে সংক্রমণের সুযোগ কমে গেছে। শহরাঞ্চলের বয়স্ক মানুষকে টিকাদান বড় ভূমিকা পালন করেছে।

লকডাউনের মধ্যে রোববার সকালে রাজধানীর কমলাপুরে কাজে যাওয়ার পথে পোশাক শ্রমিকদের অনেকের মুখেই ছিল না মাস্ক। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন

“এসবের ফলাফল সংক্রমণের নিম্নগতি, আনুপাতিক হারে মৃত্যু হ্রাস। কিন্তু এতে আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ এখনও রয়ে গেছে। মাস্ক পরার হার কম, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন করা হয় না সেভাবে, টেস্ট অনেক কম। টিকার হার কম।”

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরণ যখন এলম তার বিস্তার ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। সামনে আরও কোনো অতি সংক্রামক নতুন ধরন যে আসবে না, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। 

“এজন্য মাস্ক পরা নিশ্চিত করা, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন যথাযথভাবে প্র্যাকটিস করা এবং টিকার প্রয়োগ দ্রুত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ে যেতে হবে।

“মাসে দুই কোটি টিকা দিলেও ত্রিশ কোটি টিকা দিতে ১৫ মাস লাগবে। আগামী বছরেরও অর্ধেক সময় পার হয়ে যাবে। সেটাও ভালো কথা না। আমরা কি আগামী বছরও ঝুঁকি নিয়ে আগাব? এ বছরই সবাইকে টিকা দিতে পারি কিনা সেখানে জোর দিতে হবে।”