কোভিড: হাসপাতালের খরচ ভেঙে দিচ্ছে বহু পরিবারের কোমর

মাকে বাঁচানোর মরিয়ে চেষ্টায় দিনে লাখ টাকার বেশি গুণতেও কার্পণ্য করেননি ব্যবসায়ী ফরহাদ হোসেন। কিন্তু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মা ফাতেমা রহমান আইসিউ থেকে আর বাড়ি ফিরলেন না। চিকিৎসার জন্য করা ধার-দেনা মেটাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে পুরো পরিবার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2021, 06:56 PM
Updated : 19 May 2021, 07:00 PM

ঢাকার একটি হাসপাতালে এক মাসের বেশি সময় চিকিৎসা নেওয়ার পর গত ২ মে রাতে মারা যান ফাতেমা রহমান। পরিবারটিকে হাসপাতালের আইসিইউর ৩১ দিন ৮ ঘন্টা ৪ মিনিটের বিল চুকাতে হয়েছে।

করোনাভাইরাসে গত বছর অগাস্টেই মারা যান ফাতেমার বড় জামাতা। স্বামীহারা মেয়েকে দেখতে গত ফেব্রুয়ারিতে ঠাকুরগাঁওয়ের বাড়ি থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ফাতেমা। কিন্তু মার্চের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ জ্বরের উপসর্গ নিয়ে তার শরীরেরও হানা দেয় কোভিড-১৯।

একান্ত আপন দুই স্বজনের চিকিৎসার পেছনে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে ফরহাদের পরিবারের। প্রিয়জনের চিকিৎসার জন্য ধার-দেনা করেও এত টাকা জোগাড় করার সামর্থ্য বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের নেই।

ফরহাদরা তা পেরেছেন, কিন্তু সেই ধার শোধ দিতে এখন তাদেরও সম্পত্তি বিক্রির কথা ভাবতে হচ্ছে।

ঠাকুরগাঁওয়ে বীজ ও কৃষি পণ্যের ব্যবসায়ী ফরহাদ বলেন, “আইসিইউতে একেক দিনের বিল আসত ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা। কোনো কোনো দিন লাখ টাকার শুধু ওষুধই কিনতে হয়েছে।”

ফরহাদের ছোট ভাই ফয়েজ আহমেদ চাকরি করেন ঢাকার পলমল গ্রুপে। চিকিৎসার বড় অঙ্কের এই খরচ যোগাতে আত্মীয় পরিজন আর বন্ধুদের কাছে টাকার প্রয়োজনের কথা জানিয়েছিলেন দুই ভাই। তাতে সাড়া দেন বন্ধুবান্ধব আর স্বজনরা।

ফরহাদ হোসেন বলেন, “বন্ধুদের কাছ থেকে আনা আরো প্রায় সাত লাখ টাকা হাতেই ছিল। কিন্তু সেটা কোনো কাজে লাগল না, মা চলে গেলেন। এখন কি করে বাকি ধার-দেনা শোধ দেব, দুই ভাই মিলে সে চিন্তা করছি।”

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেই যে হাসপাতালে যেতে হবে বা ফরহাদের পরিবারের মত অত খরচ টানতে হবে- তা নয়।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান –আইইডিসিআরের হিসাবে এ বছর ২৮ জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। বাকিরা বাসায় চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে গেছেন।

তবে যাদের হাসপাতালে যেতে হয়েছে, তাদের চিকিৎসার জন্য বড় অংকের টাকাই বেরিয়ে গেছে। সাধারণ শয্যায় এই খরচ গড়ে সোয়া এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা। আর আইসিইউতে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা।

সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের খরচের বেশিরভাগটাই সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেয় বলে রোগীদের ততটা চাপে পড়তে হয় না। কিন্ত যাদের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, তাদের অনেকেই আর্থিকভাবে বড় ধাক্কা খেয়েছেন।

ঢাকার আদাবরের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করেন। স্ত্রী, বাবা-মা আর ছোট ভাই মিলে একসঙ্গেই থাকতেন। এপ্রিলের শুরুতে একসঙ্গেই তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন।

মামুন জানান, কোভিড ধরা পড়ার তিন দিনের মাথায় রাতের বেলা তার বাবার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তার আগেই মারা যান তিনি।

সেই অ্যাম্বুলেন্সে করে বাবাকে আল মারকাজুল আল ইসলামীতে নিয়ে গোসল-কাফন শেষে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন মামুন। আর নিজে ভর্তি হন হাসপাতালে। বাড়ির অন্যরা ঢাকার বাসায় কোয়ারেন্টিনে ছিলেন।

মামুন বলেন, “কি যে এক একটা দিন গেছে… বাবা চলে গেলেন, মাটিটাও দিতে পারলাম না। স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, বয়স্ক মা। হাসপাতলে আমার আট দিন থাকতে হয়েছে। আট দিনেই প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।”

কোথায় কেমন খরচ

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট এক গবেষণায় দেখেছে, কোভিড চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালে প্রতি রোগীর জন্য সাধারণ শয্যায় খরচে গড়ে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা; আইসিইউতে চার লাখ আট হাজার টাকা।

আর বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি রোগীর জন্য খরচ সাধারণ শয্যায় গড়ে দুই লাখ ৪২ হাজার টাকা। আইসিইউতে পাঁচ লাখ নয় হাজার টাকা।

গত বছর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশের চারটি কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতাল এবং দুটি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য নিয়ে এই হিসাব করেছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এ গবেষণায় সাধারণ শয্যার ৩১ হাজার ১৪৭ জন এবং আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া দুই হাজার ৯১৮ জন রোগীর খরচ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

গবেষণার পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (উপ-সচিব) ড. নুরুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি হাসপাতালের যে খরচ দেখানো হয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই আসলে সরকারের ব্যয়।

“বেডে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অতিরিক্ত খরচ হয় সাত হাজার টাকা এবং সরকারি আইসিইউতে থাকা রোগীদের অতিরিক্ত খরচ হয় ৩৩ হাজার টাকা। আর বেসরকারি হাসপাতালের খরচের পুরোটাই রোগীদের পকেট থেকেই যায়।”

ড. আমিন জানান, তারা হিসাব করে দেখেছেন, ওই সময় সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী প্রতি গড়ে আট দিন থাকতে হয়েছে। আর বেসরকারি আইসিইউতে অবস্থানের গড় সময় ৭.৩৯ দিন।

সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় রোগীর গড় অবস্থানের সময় ১০ দিন, আর বেসরকারি হাসপাতালে ৬.৫২ দিন।

অবস্থানের গড় সময় ধরে হিসেব করলে বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় চিকিৎসার দৈনিক খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ১১৬ টাকা। আইসিইউতে দৈনিক খরচ হয় গড়ে ৬৮ হাজার ৮৭৬ টাকা।

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গড় অবস্থানের তারতম্যের কারণ জানতে চাইলে ড. আমিন বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালে খরচ বেশি। তাই রোগী মোটামুটি ভালো হলেই পরিবারের পক্ষ থেকে ছেড়ে দেওয়ার চাপ তৈরি করা হয়।”

ওষুধের দামও চড়া

কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওষুধের দামও কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার বড় খরচের একটি কারণ।

অধিকাংশ হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসায় যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার একটি হল রেমডেসিভির। খোলা বাজারে ১০০ মিলিগ্রামের ভায়াল বিক্রি হয় কোম্পানি ভেদে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায়। পুরো কোর্স সম্পন্ন করতে রোগীর খরচ হয় ৩০ হাজার টাকার বেশি।

সঙ্কটাপন্ন রোগীদের অনেকের ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে টোসিলিজুমাব (অ্যাকটেমরা) ইনজেকশন। এর পুরো ডোজের দাম পড়ছে রোগীর ওজন ভেদে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।

কোভিড আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের সবারই কম-বেশি নিউমোনিয়ার সমস্যা থাকে। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে রোগীদের দেওয়া হয় অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন। সেটারর প্রতি ডোজের দাম হাজার টাকার কাছাকাছি। এছাড়া অক্সিজেন এবং অন্যান্য ওষুধের খরচও আছে।

কোভিড-১৯ রোগীদের প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু প্যাথলজি টেস্ট করাতে হয়। অনেক সরকারি হাসপাতালে এর সব টেস্ট হয় না। বেসরকারি হাসপাতালে এসব টেস্টের জন্য দিনে গড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। এসব কারণেও রোগীর খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।