কোভিড-১৯: যথেচ্ছ প্লাজমা থেরাপিতে সতর্কতা বিশেষজ্ঞদের

গুরুতর কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের রক্তরস নিয়ে প্রয়োগে ‘ভালো’ ফল আসায় দিন দিন প্লাজমা থেরাপির প্রতি ঝোঁক বাড়ছে; তবে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2020, 04:05 AM
Updated : 19 June 2020, 04:05 AM

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ ছাড়া প্লাজমা থেরাপি দিতে বারণ করলেও হরদম তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত এই চিকিৎসা পদ্ধতির শরণ নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে দাতাদের কাছে প্লাজমা চেয়ে রোগীর স্বজনদের আবেদন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। নানা নামে গড়ে তোলা হয়েছে প্লাজমা ব্যাংক। বিভিন্ন হাসপাতালও প্লাজমা সংগ্রহ ও রোগীদের উপর তা ব্যবহার করছে।

চিকিৎসকদের ভাষ্য মতে, অনেক ক্ষেত্রেই প্লাজমায় অ্যান্টিবডির পরিমাণ মাপা হচ্ছে না।

প্লাজমায় অ্যান্টিবডির পরিমাণ না জেনে এটি প্রয়োগ করলে ভালো ফল নাও আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এই পরিস্থিতিতে প্লাজমা ঘিরে নতুন অসাধু চক্রের উত্থান নিয়ে শঙ্কিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ খান যত দ্রুত সম্ভব একে একটি নিয়ম-নীতির আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করছেন।

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পাশাপাশি সঙ্কটাপন্ন রোগীদের উপর প্রয়োগের অনুমতিও দেওয়া হয়েছে।

তবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এর আগে এটা ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন না তারা।

“আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার, প্লাজমা থেরাপি এবং আরও কয়েকটা ওষুধের ব্যাপারে যারা দাবি করছে যতক্ষণ পর্যন্ত এটা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত না হবে, ততক্ষণ এগুলো প্রয়োগের বিষয়ে আমাদের কোনো সুপারিশ নেই।”

তবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বাইরে সীমিত আকারে এর প্রয়োগে কোনো সমস্যা দেখছেন না তিনি।

অধ্যাপক শহীদ উল্লাহ বলেন, “যেহেতু একটা মহামারীর সময়, এ কারণে অনেকে দিয়ে দেখতে চায়। আমেরিকার মতো দেশেও এটি ব্যবহার করে দেখছে হাইপোথেটিক্যালি।”

তবে এখনও প্লাজমা থেরাপি নিয়ে গাইডলাইন না থাকায় বিষয়টি নিয়ে অনেকে অনৈতিক সুযোগ নিতে পারেন বলে মনে করছেন ঢাকা মেডিকেলের অধ্যাপক ডা. এম এ খান।

তিনি বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাহিদা বেশি থাকবে, ডোনার কম থাকবে তখন তো সমস্যা হবেই। মানুষ টাকা দিয়ে কিনবে। এই সুযোগ নিতে চাইবে একটা পক্ষ।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে প্লাজমা থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, তার নেতৃত্বে আছেন ডা. এম এ খান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বাইরে সীমিত আকারে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের জন্য গত ২০ মে ‘এক্সপ্যান্ডেড অ্যাকসেস প্রোগ্রাম’ শুরু করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিলেন তারা।

“ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বাইরে এই প্রোগ্রামের আওতায় কিছু রোগীকে প্লাজমা দেওয়া যায়। যেটা আমেরিকায় শুরু করেছে। এটা রোগীদের মধ্যে ব্যাপক আকারে দেওয়া হবে, কিন্তু নিয়মকানুন থাকবে, যারা দেবে তাদের একটা ডকুমেন্ট রাখতে হবে। কাকে দেওয়া যাবে সেটা ঠিক করে দেবেন চিকিৎসকরা।”

অধ্যাপক ডা. এম এ খান বলেন, প্লাজমা প্রয়োগের আগে তাতে অ্যান্টিবডি কী পরিমাণ আছে তা জানা জরুরি। কিন্তু পরীক্ষাটি না করেই প্লাজমা প্রয়োগ করছেন অনেকে।

“প্লাজমায় অ্যান্টিবডির ন্যূনতম অনুপাত ১:১৬০। প্লাজমায় এর বেশি অ্যান্টিবডি থাকলে সেটা দেওয়া যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি পরীক্ষাই করা হচ্ছে না। ব্যাপারটা ফার্মেসি থেকে ওষুধ দেওয়ার মতো হয়ে গেছে।”

যেভাবে
চলছে
প্লাজমা
থেরাপি

অনেক ক্ষেত্রেই বিনামূল্যে প্লাজমা দান করছেন কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তি। আবার কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে প্লাজমা দিচ্ছেন।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন রোগীর জন্য ৪০০ মিলিলিটার প্লাজমা সংগ্রহ করেছেন তার স্বজনরা।

তাদের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একজন দাতা প্লাজমা দিতে রাজি হওয়ার পর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্লাজমা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরে কুর্মিটোলা হাসপাতালে এনে রোগীকে প্লাজমা দেওয়া হয়েছে।

আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক রোগীর স্বজন জানান, তারা একজন দাতার কাছ থেকে এক ব্যাগ নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের প্লাজমা সংগ্রহ করেছেন। এজন্য দাতাকে ‘কিছু টাকা’ দিতে হয়েছে।

তবে কত টাকা দিতে হয়েছে, তা বলতে রাজি হননি তিনি।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক ব্যাগ প্লাজমা সংগ্রহ করে দিতে ওই হাসপাতালে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ছাড়াও বাইরের রোগীদের জন্যও প্লাজমা সংগ্রহ করে দেন তারা।

আল আমিন নামে সেখানকার একজন কর্মী বলেন, “আপনি যদি বাইরে থেকে ডোনার আনেন সেক্ষেত্রে আমরা প্লাজমাটা করে দেব। বিল আসবে ৩৩ হাজার টাকার মতো।”

প্লাজমা সংগ্রহ করে দিলেও সেখানে প্লাজমার অ্যান্টিবডি পরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।

ইউনাইটেড হাসপাতালে শুধু ভর্তি রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। হাসপাতালের হটলাইনে যোগাযোগ করলে বলা হয়, এক্ষেত্রে প্লাজমা দাতাকে নিয়ে আসতে হবে। ৪০০ এমএল প্লাজমা সংগ্রহ করে দিতে খরচ হবে ২৫ হাজার টাকা। প্লাজমা দেওয়ার আগে অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয় না। এখন পর্যন্ত ২০টার মতো প্লাজমা দেওয়া হয়েছে।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোভিড-১৯ রোগীদেরও প্লাজমা দেওয়া হচ্ছে।

ওই হাসপাতালের পরিচালক ড. হাসান উল হায়দার বলেন, তারা সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই প্লাজমা সংগ্রহ ও প্রয়োগ করছেন। পুলিশ সদস্যদের বাইরেও অনেকের অনুরোধে প্লাজমা সরবরাহ করা হচ্ছে।

গাইডলাইন না থাকার পরও প্লাজমা কেন দিচ্ছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হচ্ছে।

“বিভিন্ন স্টাডিতে আমরা দেখেছি যে যদি ক্ষতি না হয় রোগীর কিছুটা উপকার হয় তাহলে এটি দিতে সমস্যা নেই। গাইডলাইনে এখন অনেক চিকিৎসার কথাই বলা নাই। কিন্তু রোগীকে তো ফেলে রাখা যাবে না। বাংলাদেশে যেহেতু এর প্রয়োগ হচ্ছে এ কারণে অবশ্যই একটা নীতিমালা করা উচিত।”

গাইডলাইন হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বদলির আগে) হাবিবুর রহমান খান বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এ ধরনের একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে এসেছিল। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বলেছেন।

“এটা একটা কারিগরি ব্যাপার। এখানে মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই। এটা অনুমোদন বা যা-ই হোক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই করতে পারে। এজন্য আমরা প্রপোজালটা সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের মোবাইলে ফোন করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।