স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করতে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন’ গঠনের দাবি

দেশের স্বাস্থ্যখাতকে শক্তিশালী করতে স্থায়ীভাবে একটি জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের দাবি এসেছে এক প্রাকবাজেট আলোচনায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2020, 08:14 AM
Updated : 10 June 2020, 08:14 AM

মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট পরিচালিত স্বাস্থ্যখাতে বিশেষজ্ঞদের প্ল্যাটফর্ম 'সহযোদ্ধা' আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এ দাবি আসে।

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ।

তিনি বলেন, কমিশনের কাঠামো কেমন হবে, কীভাবে গঠিত হবে- এ বিষয়ে একটি নীতিমালার প্রয়োজন। সেই কমিশনে স্থায়ী জনবল নিয়োগ করতে হবে, যাতে পূর্ণকালীন সময় তারা কাজ করতে পারেন।

“এখন দেশে যেসব কমিশন রয়েছে, সরকারের আমলারা সেখানে প্রধান হচ্ছেন। একই ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন । স্বাস্থ্য কমিশনে আমলারা আসতে পারবেন না, জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আছে, এরকম জনবল নিয়োগ দিতে হবে। এটাকে একটি মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা দিতে হবে।"

অধ্যাপক হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিত কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকে। স্বাস্থ্য সচিব থেকে শুরু করে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক- সবাই খুবই ব্যস্ত। ফলে স্বাস্থ্যখাতে নতুন কাঠামো ও সংস্কার নিয়ে চিন্তার করার সময় তাদের নেই।

“স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর করে ব্যাপক সংস্কারের লক্ষ্যে আমাদের দরকার একটি স্থায়ী কাঠামো। সেজন্য স্বাস্থ্যখাতে স্থায়ীভাবে জাতীয় কমিশন গঠন আমাদের সকলের স্লোগান হওয়া উচতি।"

স্বাস্থ্যখাতে অব্যবস্থাপনার বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে তাতে পরিবর্তন আনতে বেশ কিছু পরামর্শ তুলে ধরেন অধ্যাপক হামিদ।

স্বাস্থ্যখাতে ২২ শতাংশ পদ খালি রয়েছে জানিয়ে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

তার ভাষায়, হাসপাতালের শয্যা সংখ্যার মাথায় রেখে বাজেট প্রণয়ন না করে তা হওয়া উচিৎ জেলা-উপজেলার জনসংখ্যার চাহিদার ভিত্তিতে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল ইনফরমেশনস সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগে যোগাযোগ করে মানুষ  অনেক সময় কোনো তথ্য বা সহযোগিতা পান না- এমন অভিযোগের কথা তুলে ধরে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে বলেন অধ্যাপক হামিদ।

এছাড়া স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি হাসপাতালকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে জোর দিয়ে তিনি বলেন, "কোভিড-১৯ দেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করেছে। সঙ্কটে অনেকে পালিয়েছে। ডায়ালাইসিসের ক্ষেত্রে প্রাইভেট হাসাপাতালের অভিজ্ঞতা একদম ভালো না। প্রাইভেট সেক্টরের লাগাম টেনে ধরতে হবে। তাদের পূর্ণকালীন চিকিৎসক দিয়ে হাসপাতাল পরিচালনা করতে হবে। ভাড়াটে দিয়ে হাসপাতাল চালানো যাবে না।"

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক শাহ মু. মনির হোসাইন বলেন, "স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আমরা কোথায় আছি। আমাদের দেশের প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য আটটি হাসপাতাল বেড। দুই হাজার লোকের জন্য একজন মাত্র চিকিৎসক। এই অবস্থায় হাসপাতালের বেড হিসেবে বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে। আমরা চিন্তা করছি না ওই এলাকায় লোকসংখ্যা কত। আমরা জনগণের স্বাস্থ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণ করছি না।"

আঞ্চলিক পর্যায়ে পরিকল্পনা করে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, "আমাদের কার্যক্রম বাড়লে, বাজেট অটোমেটিকলি বাড়বে। এজন্য আমাদের লোকাল লেভেল প্ল্যানিং অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজাতে হবে। ঢাকায় বসে ডিজি অফিস থেকে সার্ভেইল্যান্স করলে হবে না। প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। স্বাস্থ্যখাতে যোগ্য ও মোটিভেটেড লোকদের নিয়োগ না হলে কোনোদিনই তা শক্তিশালী হবে না।"

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী মোট বাজেটের ১০ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দেওয়া উচিত।

“কিন্তু চলমান অর্থবছরে আমাদের বাজেটে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ হলে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। সব খাতের বিবেচনায় স্বাস্থ্যে বরাদ্দের পরিমাণ ৬ নম্বরে আছে। বিগত এক দশকে আমাদের মোট বাজেটের আকার বেড়েছে চারগুণ। স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের পরিমাণ বেড়েছে ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। আনুপাতিক তুলনা করলে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ পিছিয়েছে।"

তিনি বলেন, শুধু বাজেট বরাদ্দ দিলেই হবে না, সেটা ব্যবহারের সক্ষমতাও থাকতে হবে। প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার একটি অংশ অব্যবহৃত থাকে এবং ফেরত চলে যায়।

“যদি প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে চাই, তাহলে আমাদের চাহিদা ভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।"

করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যখাতে বেশি বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন,"কোভিড -১৯ পরিস্থিতিতে এবছর স্বাস্থ্যখাতে একটু বাড়তি বরাদ্দ দরকার।আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু সরকার তার সীমিত সম্পদ দ্বারা স্বাস্থ্যখাতের সমস্যা সমাধানে তৎপর।"

তবে স্বাস্থ্যখাতে অদক্ষতার অভিযোগ খণ্ডন করতে গিয়ে শাহাদৎ বলেন, "শুধু দক্ষতা থাকলেই হবে না। এজন্য আমাদের থাকতে হবে ভালো দৃষ্টিভঙ্গি, কমিটমেন্ট ও মোটিভেশন। আর স্বচ্ছতার কথা বলেন, সব সেক্টরে একই অবস্থা। স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে যেসব রিপোর্ট হয়েছে, সব সেক্টরেই এ জাতীয় রিপোর্ট আছে। সুতরাং এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।"

ওয়েবিনারে সঞ্চালনায় ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত অন্যতম উপদেষ্টা আবু জামিল ফয়সাল।

সমাপনী বক্তব্যে তিনি স্বাস্থ্য কমিশন গঠনসহ স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের জন্য ‘রোডম্যাপ’ তৈরি করে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে দিতে বিশেষজ্ঞদের প্রতি আহ্বান জানান।

ভার্চুয়াল এই সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. নুরুল আমিনসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার স্বাস্থ্য-অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।