ডেঙ্গুর বিস্তারের সঙ্গে বাড়ছে আতঙ্ক, কিন্তু কেন?

মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাংলাদেশকে গ্রাস করছে আতঙ্ক; সরকার বিপদের মাত্রা হালকা করে দেখাতে চাইছে কি না- সেই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে অনেকের মধ্যে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2019, 06:22 PM
Updated : 1 August 2019, 06:29 PM

চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত রেকর্ড ১৯ হাজার ৫১৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে সরকারি খাতায়। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে।

তবে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ পর্যন্ত ১৪ জনের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে বলেছে, মৃত্যুর অন্য ঘটনাগুলো তাদের পর্যালোচনায় রয়েছে। 

আর এ কারণেই অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে; সরকার প্রকৃত চিত্র আড়াল করতে চাইছে বলে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন।  

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার এখনও আক্রান্তের সংখ্যার ০.৫ শতাংশের কম। তারপরও আতঙ্কিত মানুষ প্রতিদিন হাসপাতাল আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভিড় করছে রক্ত পরীক্ষার জন্য।

আতঙ্কের এই চিত্রটি স্পষ্ট হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আবদুল্লাহ আল আজাদের কথায়।

বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “উদ্বেগ থেকেই অনেকে হাসপাতালে আসছেন। গতকাল আমরা ৪৬৫ জনের রক্ত পরীক্ষা করেছি, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১৬ জনের ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। অর্থাৎ, মানুষের মধ্যে আতঙ্কের মাত্রা অনেক বেশি।”    

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বিষয়টিকে ‘জনগণের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছাতে সরকারের ব্যর্থতা’ হিসেবে দেখছেন।  

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরকে মুখপাত্রের ভূমিকায় দেখা গেলেও এবার ডেঙ্গু মৌসুমের শুরুতে তারা ছিল একেবারেই চুপ।

অতীতে কোনো রোগের প্রাদুর্ভাগের আভাস পেলে শুরুতেই সাংবাদিকদের নিয়ে কর্মশালা বা ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে সঠিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা গেছে আইইডিসিআরকে। কিন্তু এবার তেমন কিছু তারা করেনি।  

যেখানে প্রতিদিন ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, সেখানে ‘ছুটি নিয়ে’ চুপচাপ মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সংসদে নিজের সহকর্মীদের কাছেও সমালোচিত হয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

‘ছুটি সংক্ষিপ্ত’ করে দেশে ফেরার পর বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিলেও সাংবাদিকদের তিনি অনেকটা এড়িয়ে গেছেন। 

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে দুপুরে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে আসার কথা ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর; তবে ‘অনিবার্য কারণের’ কথা বলে শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করা হয়।  

ডেঙ্গু আতঙ্কে মশারির ভেতরে বসেই দুপুরের খাবার খাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের এক শিক্ষার্থী

‘নজিরবিহীন’
নুরুল ইসলাম হাসিব
স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এরকম পরিস্থিতি আমি আর দেখিনি।  

পেশাগত কারণে ২০০৩ সাল থেকেই আমি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছি। সে সময় আইইডিসিআর ছিল সরকারি ডাক্তারদের ডাম্পিং স্টেশন। নতুন কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে বলে মনে হলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নমুনা পাঠাতে হত যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসিতে।   

সেই পরিস্থিতি বদলেছে। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সনদপ্রাপ্ত পরীক্ষাগার রয়েছে আইইডিসিআরে। কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাপনা আর তথ্য পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এখন তাদের হাতে রয়েছে। এর এ কারণেই এ ধরনের ক্ষেত্রে আইইডিসিআরকে মুখপাত্রের ভূমিকায় দেখা যায়।

যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে ঠিক কী ঘটছে, কর্তৃপক্ষ কী করছে, কর্তৃপক্ষ কী করতে পারছে না, সামনে কী ঘটতে যচ্ছে- এসব বিষয়ে জনগণকে নিয়মিত ওয়াকিবহাল রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পায়।

কিন্তু এবার পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো।

এবার সাংবাদিকদের আইইডিসিআরে গিয়ে কোনো তথ্য না পেয়ে ফিরেও আসতে হয়েছে, পরিচালক তাদের সময় দেননি। 

বিভিন্ন সূত্র বলছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তেই সাংবাদিকদের এভাবে দূরে রাখা হচ্ছে।

এই সব কিছুর পর পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি।

ফেইসবুকে একজন লিখেছেন- “প্রতিদিনই পত্রিকায় নতুন করে মৃত্যুর খবর আসছে, কিন্তু সরকার শুধু বলছে ১৪ জনের কথা। তারা এই হিসাবটা কীভাবে করে?”

আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরা বলছেন, একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার আগে তারা কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারেন না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার নেতৃত্বেই একটি বিশেষজ্ঞ দল মৃত্যুর তথ্যগুলো পর্যালোচনা করছে। আর সেজন্য কয়েকটি ধাপে কাজ করতে হচ্ছে তাদের।

বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আসা ২০ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করে এ পর্যন্ত ১৪ জনের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ায় আইইডিসিআর সেই তথ্যই প্রকাশ করেছে বলে জানান পরিচালক। 

তিনি বলেন, “নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা তিনভাবে কাজ করি। প্রথমত, সব ক্লিনিক্যাল ডকুমেন্টস, চিকিৎসার তথ্য, হাসপাতালে থাকার সময়কার তথ্য পর্যালোচনা করতে হয়। তারপর আমরা ভার্বাল অটোপসি (মৃত্যুর কারণ বোঝার জন্য উপসর্গ ও শারীরিক অবস্থার তথ্য বিচার) করি, নমুনা সংগ্রহ করি।

“আমরা যখন ল্যাবের পরীক্ষায় পিসিআর (রক্তে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী ভাইরাসের জিন অবশেষ) পেয়ে যাই, তখন আমরা সরাসরি বলতে পারি যে ডেঙ্গুতেই তার মৃত্যু হয়েছে।”

“আর বাকি ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয় ডেঙ্গুর ‘সম্ভাব্য সংক্রমণ’ হিসেবে। মৃতের তালিকায় আমরা সেসব নাম দিই না।” 

ডা. ফ্লোরা বলেন, “আমাদের আট সদস্যের ডেথ রিভিউ কমিটি ঘটনাগুলো দুই ভাগে ভাগ করে। একভাগে থাকে তাদের তথ্য, যাদের ডেঙ্গুর কারণেই মৃত্যু হয়েছে। আর অন্যভাগে তাদের তথ্য থাকে, যাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন তথ্য এসেছে, তবে ডেঙ্গুও একটি কারণ হতে পারে।

“সব বিচার করে রিভিউ কমিটিই সিদ্ধান্ত নেয়; প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইইডিসিআরের এখানে করার কিছু নেই।” 

সরকারি হিসেবে যে ১৪ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তার সবগুলোই ঘটেছে কোনো না কোনো বেসরকারি হাসপাতালে। অথচ কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই জুলাই মাসে ১০ জনের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য দিচ্ছে। 

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডা. ফ্লোরা বলেন, সেসব তথ্যের পর্যালোচনা শেষ হয়নি বলেই এখনও সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

“মৃত্যুর পর সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভার্বাল অটোপসির জন্য স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। তাদের মানসিক অবস্থাটা তো আমাদের বিবেচনায় রাখতে হয়, সামলে ওঠার সময়টুকুতো আমাদের দিতে হয়।”

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

আইইডিসিআরের পরিচালক জানান, হাসপাতাল থেকে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যার পাশাপাশি ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সম্ভাব্য একটি তালিকাও তাদের কাছে নিয়মিত পাঠানো হয়।

“এরকম লম্বা একটি তালিকা আমাদের হাতে আছে। ফেইসবুকেও আমরা নজর রাখি।”

এটাই যদি আইইডিসিআরের সাধারণ কর্মপদ্ধতি হয়, তাহলে অতীতে মৃতের সংখ্যা নিয়ে এ ধরনের বিভ্রান্তি ঘটেনি কেন? 

মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরা বলেন, “গত বছরও আমরা একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। আর গতবারও একই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছে। কিন্তু গতবছর ডেঙ্গুর বিস্তৃতি এবারের মত ব্যাপক ছিল না। সে কারণে এত হৈ চৈও হয়নি।” 

২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর আইইডিসিআর এই ‘ডেথ রিভিউ’ ব্যবস্থা চালু করে জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো রোগে মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চিত করার জন্য অনেক দেশেই এ ধরনের পদ্ধতি চালু আছে। আমরা সেটাই অনুসরণ করছি।”

রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, ‘রিভিউ’ প্রক্রিয়া চলার মধ্যেও সরকার হাসপাতাল থেকে পাওয়া মৃত্যুর সংখ্যাটি জানাতে পারে। 

এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনার হাতে যে তথ্য আছে, সেটা আপনি বলতেই পারেন। পাবলিককে একটা বার্তা আপনি দিতে পারেন যে হাসপাতাল থেকে এই তথ্য এসেছে, নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা সেটা ল্যবরেটরিতে যাচাই করে দেখছি।

“এই সামান্য বার্তাও কিন্তু আস্থার সঙ্কট অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে, বিশেষ করে এ রকম সময়ে।”

আইইডিসিআরের পরিচালক অবশ্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আশাবাদী, তবে সেজন্য মশা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিচ্ছেন তিনি।   

“মশা নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত চেষ্টাটা যদি অব্যাহত রাখা যায়, তাহলে শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়। এখন সবকিছুই নির্ভর করবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের চেষ্টা এবং তার সাফল্যের ওপর।”