ঢাকা থেকে পুরো বাংলাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে সোমবার জনসচেতনামূলক এক অনুষ্ঠানে এই তথ্য তুলে ধরেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বিষয়ক কর্মসূচি ব্যবস্থাপক অধ্যাপক ডা. এম এম আক্তারুজ্জামান।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা যে শহরে বা যে এলাকায় একবার বিস্তার করে, সে এলাকায় আর ‘নিস্তার নেই’।
“কারণ এডিস মশার ডিম শুকনা পরিবেশেও নয় মাস পর্যন্ত সক্রিয় থাকে, নষ্ট হয় না। আর যখনই স্বচ্ছ পানির সংস্পর্শে আসে তখন তা লার্ভা হয়; রূপ নেয় পরিপূর্ণ মশায়।”
ডা. আক্তারুজ্জামান বলেন, বিদেশ থেকে গাড়ির টায়ারে করেও যদি এডিসের ডিম আসে, সেটা যদি পানির সংস্পর্শে আসে, সেখান থেকেই এডিসের জন্ম হবে।
ঢাকায় ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে এডিস এজিপ্টি মশা ইতোমধ্যে সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি এডিস এজিপ্টি মশা একেবারে একশর মতো ডিম দেয়। আর ডিম ছাড়ার জন্য এই মশা বেছে নেয় স্বল্প গভীরতার পানি, যেমন বোতল, কাপ, টব, টায়ারের মতো স্থান। এদের ডিমের খোলস হয় বেশ শক্ত। তা শুষ্ক পরিবেশেও অন্তত আট মাস সক্রিয় থাকে। যখন পানি ডিমটি পুরো ঢেকে দেয়, তখন ডিম থেকে লার্ভা হয়। লার্ভা থেকে পিউপা হয়ে পরিপূর্ণ মশায় রূপ নিতে সময় লাগে আট-থেকে ১০ দিন।
এডিস মশা তাদের ৪০ দিনের মতো জীবনকালে গড়ে পাঁচ বারের মতো ডিম দেয়।
সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, এডিস মশা মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। এজন্য ঘর, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থানে এদের দেখা মেলে বেশি। আর তাদের ওড়াউড়ি জন্মস্থানের কাছাকাছিই সীমাবদ্ধ থাকে।
বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক ধরে বর্ষায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দিলেও এবার তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রথমে ঢাকায় দেখা দেওয়ার পর এখন ৫০টি জেলায় তা ছড়িয়েছে। মারা গেছে ২৫ জনের মতো, আক্রান্ত হয়েছে ১৩ হাজারের বেশি।
ডা. আক্তারুজ্জামান তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, “২০১৭ সালে আমরা যে পরিমাণ লার্ভা (এডিস মশার) পেয়েছিলাম, এবার তার তুলনায় শতভাগ বেশি পাওয়া গেছে। মূলত, নির্মানাধীন ভবন, জমে থাকা পানি, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে আমরা লার্ভা পেয়েছি।”
ঢাকায় এডিস এজিপ্টি মশাই প্রধানত ডেঙ্গুর বাহক; তবে ঢাকার বাইরে থাকা এডিস এলবোপিকটাস মশাও ডেঙ্গু রোগের কারণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ডা. এ এস এম আলমগীর।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এডিস এলবোপিকটাস মশাও ডেঙ্গুর কারণ হতে পারে। আর এই মশাটি ঢাকার বাইরের অঞ্চলগুলোতে রয়েছে। সুতরাং এই মশার (এডিস এলবোপিকটাস) কোনটি যদি ঢাকা থেকে যাওয়া কোনো ডেঙ্গু রোগীকে কামড় দেয়, তবে ওই এলাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, “ব্যক্তি সচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। পানি জমে থাকলে সেখানে এই মশা জন্ম নেবেই।
“ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতেও এডিসের ডিম যদি থাকে, পানি পাওয়ার পর সেখান থেকে লার্ভা হবে। পরিপূর্ণ মশা জন্ম নেবে। তাই স্যাঁতস্যাতে ঘরের মেঝেতে ব্লিচিং পাউডার ছিটানো কার্যকর হবে। এছাড়া মশারি ব্যবহার, এরোসল ব্যবহার করা যেতে পারে।”
এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় তা প্রতিরোধে বাড়ির আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। অফিস, ঘর ও আশপাশে যে কোনো পাত্রে (এসির ট্রে/ফুলের টব) জমে থাকা পানি তিন দিনের মধ্যে পরিবর্তন করতে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এবার ঢাকায় এডিস মশা নিধনে দুই নগর কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন অনেকে। ছিটানো ওষুধ অকার্যকর বলেও গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সতর্কবার্তা দেওয়ার পরও ডেঙ্গু মোকাবেলায় সমন্বিত কার্যক্রম নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ঢাকার দুই মেয়রের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।
নির্বাচন ভবনে এক সচেতনতামূলক সভায় গিয়ে এডিস মশা ও ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে নানা তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি সবাইকে আশ্বস্তও করেন অধ্যাপক ডা. আক্তারুজ্জামান।
জ্বর হলেই না ঘাবড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “৬ ঘণ্টার মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর প্রথমবার হলে তেমন সমস্যা নেই। দ্বিতীয়, তৃতীয়বার হলে সমস্যা ভয়াবহ হয়। তখন শরীরের বিভিন্ন অর্গান ফেইলর হয়। তাই দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।”
সভায় থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ডেঙ্গু মোকাবেলায় ইসির ফোয়ারা বন্ধ রাখাসহ আশেপাশের ভবনেও যেন পানি জমতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ইসি সচিবকে নির্দেশ দেন।
এর আগে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তীব্র জ্বর, মাথা ব্যথা ও মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীরে লালচে দানা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা গেলেও এবার এর ব্যতিক্রম পাওয়া যাচ্ছে, যা বিভ্রান্ত করছে চিকিৎসকদেরও।
তাই জ্বর হলেই কাছের হাসপাতালে কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রক্তের পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়েছে সরকার।
চিকিৎসকরা জ্বরে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি রোগীকে বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়াতে বলেছেন।
এবার ডেঙ্গুজ্বরে রক্তের ঘনত্ব কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেওয়ায় আক্রান্তের রক্তচাপ কমে যাচ্ছে কি না, তা নিয়মিত পরীক্ষা করতে বলা হচ্ছে।
জ্বর ভালো হওয়ার পরও ডেঙ্গুজনিত মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা।
এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায় বলে দিনে ঘুমানোর ক্ষেত্রেও মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।