বাংলাদেশে কায়িক শ্রমে পুরুষের চেয়ে নারীরা ‘কম সক্রিয়’

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো অসংক্রামক রোগ হৃদরোগ ও ডায়াবেটিকের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের নারীরাও।

নুরুল ইসলাম হাসিব জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Sept 2018, 03:42 PM
Updated : 5 Sept 2018, 03:47 PM

এই তথ্য উঠে উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক গবেষণায়।

গবেষকরা বলছেন, পুরুষের চেয়ে শারীরিকভাবে নারীদের কম সক্রিয়তাই এই ঝুঁকির কারণ।

বুধবার ব্রিটিশ চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যান্সেটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি চারজনে একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তি শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকেন। অর্থাৎ বিশ্বে ১৪০ কোটি মানুষের ২৮ শতাংশই শারীরিকভাবে সক্রিয় নন।

কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান হতে পারে প্রতি তিনজনে একজন, জানাচ্ছে ওই গবেষণা।

গবেষণায় জড়িত চারজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, অপর্যাপ্ত কায়িক শ্রমের কারণে বাড়ছে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি। মানসিক স্বাস্থ্য ও উন্নত জীবন চর্চাতেও রয়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব।  

এই গবেষণার তথ্য সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয় ২০০৮ সালে। তবে প্রথমবারের মতো এই গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০১ সাল থেকে বিশ্বে মানুষের কায়িক শ্রমে বা ব্যায়ামের মতো শারীরিক সক্রিয়তায় অংশ না নেওয়ার চিত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি।

এতে বলা হয়, ১৬৮টি দেশের মধ্যে ১৫৯টি দেশে অপর্যাপ্ত কায়িক শ্রমের হার নারীদের চেয়ে পুরুষদের কম। মোট ৬৫টি দেশে এই তুলনামূলক পার্থক্য ১০ শতাংশ।

অন্যদিকে ২০ শতাংশ পার্থক্যে যে নয়টি দেশে পুরুষদের চেয়ে নারীরা শারীরিক পরিশ্রমে কম সক্রিয়, সেই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও।    

বাংলাদেশে পুরুষদের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত শারীরিক শ্রমের হার যখন ২০ থেকে ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ, নারীদের ক্ষেত্রে তা ৩০ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের সব দেশে জাতীয় ও অন্যান্য পর্যায়ে প্রতিদিন কায়িক শ্রমে যে কোনো বয়স ও সক্ষমতার মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ানোর পরিবেশ গড়ে তোলাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছে এই গবেষণা।

কায়িক শ্রম বাড়াতে গ্লোবাল অ্যাকশন প্লানে ২০২৫ সালের মধ্যে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ১০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা ‘দিক হারিয়েছে’ বলেই জানিয়েছে ল্যান্সেটের ওই প্রতিবেদন।

ডব্লিউএইচও’র ২০১৪ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৯ শতাংশ। এরমধ্যে হৃদরোগে মারা যায় সবচেয়ে বেশি, ১৭ শতাংশ। এছাড়াও ফুসফুসের অসুখ ও ক্যান্সারে মারা যায় ১০ শতাংশ।   

এদিকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই রোগগুলো বাংলাদেশসহ এশিয়ার মানুষদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে জানিয়ে গত অক্টোবরেই সতর্ক করেছিল এনসিডি অ্যালায়েন্স।

গত বছর বিশ্ব স্থূলতা দিবসে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে শারীরিক স্থূলতার হার বেড়ে যাওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল ল্যান্সেট। 

ল্যান্সেটের পরিসংখ্যান মতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে পাঁচ থেকে ১৯ বছরের ছেলেদের বেলায় এই হার তিন শতাংশ; যা ১৯৭৫ সালে ছিল মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।

একই বয়সী মেয়েদের বেলায় মাত্র চার দশকে প্রায় শূন্য থেকে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় দুই দশমিক তিন শতাংশ।

২০১৪ সালে করা বিশ্বব্যাপী স্কুল-ভিত্তিক স্বাস্থ্য জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৫৯ শতাংশ কিশোর-কিশোরী শারীরিকভাবে ‘অপর্যাপ্ত সক্রিয়’ এবং ৭৯ শতাংশ বিনোদনের জন্য কমপিউটার বা টিভি স্ক্রিনে চোখ রেখে সময় কাটায়।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অসংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নীতি প্রণয়ন করা হলেও সাইকেল চালানোর মতো একটি কার্যকর ব্যায়ামকে উৎসাহ দিতে কোনো আলাদা সাইকেল লেইন ও হাঁটার উপযোগী ফুটপাত না থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে এই গবেষকদের পর্যবেক্ষণে।

ওই গবেষণার লেখকদের মতে, অফিস বা ঘর, পরিবহণ এবং অবসরে নারী-পুরুষের কম ও বেশি অংশগ্রহণকে মূল্যায়ন করলে লিঙ্গ বৈষম্যকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

“এর আগের গবেষণা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে কম অবসর কাটানো ও কম পরিশ্রমের কাজে দেখা যায়।”

তবে নারীদের নিরাপদ এবং সহজলভ্য অবসর যাপনের সুযোগ তাদের কায়িক শ্রমে অংশগ্রহণ বাড়ানোর পাশাপাশি লিঙ্গ বৈষম্য মিটিয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে শারীরিক সক্রিয়তার মাত্রা বাড়ানোর লক্ষ অর্জনে সহায়ক হবে বলে মনে করেন তারা।

গবেষণায় বলা হয়, সাংস্কৃতিক প্রথা, চিরাচরিত ভূমিকা এবং সামাজিক সহায়তার অভাবেও মেয়ে ও নারীদের মধ্যে শারীরিক কর্মচাঞ্চল্যে অংশগ্রহণ কমে যেতে থাকে।

“আচরণগত পরিবর্তনকে সহায়তায় সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল কাজগুলো পরিকল্পনা ও উপস্থাপনে এই বাধাগুলোকে বোঝা ও চিহ্নিত করা প্রয়োজন”, বলছেন গবেষকরা।

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা কমানোর উদ্যোগের অগ্রগতি যে খুবই ধীর তা নিয়েও সমালোচনা উঠে এসেছে।

“বিশ্বে এবং উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে অপর্যাপ্ত শারীরিক কর্মের হার বেড়েই চলেছে; এখানে নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম সক্রিয়।”

এ কারণে অধিকাংশ দেশেই কার্যকর নীতি বাস্তবায়নে জাতীয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান এই গবেষকরা।

 ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী নেওয়া নতুন নীতিগুলো আমলে নিলেও এর বাস্তবায়নে ‘সাহসী নেতৃত্ব এবং সার্বিক সম্পৃক্ততা’ থাকা জরুরি বলে মনে করেন তারা।

ল্যান্সেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, “সকল ক্ষেত্রের মধ্যে সহযোগিতা থাকলে উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাওয়া যাবে। শারীরিক ক্রিয়াকে উৎসাহিত করে নেওয়া নীতিগুলো স্বাস্থ্য, স্থানীয় অর্থনীতি, সামাজিক সুরক্ষা, পরিবেশত স্থিতিশীলতা এবং ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবদান রাখবে।”