কে সাহস করবে সহিংসতার মধ্যে থাকা একটি শহরে অভিজ্ঞতা ছাড়া কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে ১০ পর্বের একটি টেলিভিশন ধারাবাহিক শুট করতে?
Published : 28 Apr 2023, 09:24 AM
পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের বদৌলতে উত্তর আফ্রিকার উপকূলীয় দেশ সোমালিয়ার পরিচয় বিশ্ববাসীর কাছে দাঁড়িয়েছে এমন, এটা জলদস্যুর, আল-শাবাব জঙ্গির আর সহিংসতার এক দেশ। সে দেশে সিনেমা হয়, নাটক হয়, সেসব কখনও আসে না আলোচনায়। তবে এবার এসেছে।
গত বৃহস্পতিবার সোমালিয়ার বিলে টিভি চ্যানেলে শুরু হয়েছে ১০ পর্বের একটি নাটক, যার নাম ‘আরদে’ বা ‘শিক্ষার্থী’। পর্দায় আসার আগেই এই নাটক আলোচনায় এসেছে।
নানা কারণে এই আলোচনা। এর একটি কারণ পুরো ধারাবাহিকটি চিত্রায়িত হয়েছে সোমালিয়ার সহিংসতা প্রবণ রাজধানী মোগাদিশুতে। দ্বিতীয় কারণ, এর অভিনয়শিল্পী থেকে কলাকুশলী সবাই অপেশাদার। তৃতীয় কারণ, যেসব কথা জরুরি হলেও উচ্চারণে মানা, সেসব কথা সশব্দে বলেছে এই নাটক।
সম্পূর্ণরূপে একটি সোমালি নাটক ‘আরদে’ নির্মাণের এই অসাধ্য সাধন করেছেন আহমেদ ফারাহ। তার এই দুঃসাহসী সৃষ্টির আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছে বিবিসি।
প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে এভাবে- কে সাহস করবে ৩০ বছর ধরে সহিংসতার মধ্যে থাকা একটি শহরে একদম অভিজ্ঞতা ছাড়া কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে ১০ পর্বের একটি টেলিভিশন ধারাবাহিক শুট করতে? এর উত্তর হচ্ছে আহমেদ ফারাহ, যিনি এই ধারাবাহিকের পরিচালক।
‘আরদে’ আলোচনায় আসার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে এই ধারাবাহিকে এমন কিছু বিতর্কিত বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যা সোমালিয়ার সমাজে ‘ট্যাবু’ বা ‘অনুচ্চারিত’ বিষয় হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে আছে পর্নগ্রাফি, ধর্ষণ, মাদক ও মেয়েদের অপরাধ চক্র।
২৫-মিনিট দীর্ঘ প্রতিটি পর্বে একদল বিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের তুলে ধরা হয়েছে এবং দেখান হয়েছে কীভাবে তারা একটি সংকটময় পৃথিবীতে বেড়ে উঠছে।
ফারাহ বিবিসিকে বলেছেন, তরুণ সোমালিদের ‘টিকটক’ ভিডিও দেখে তিনি এই ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য লিখতে উদ্বুদ্ধ হন।
তিনি বলেন, “এসব বিষয় নিয়ে তারা (তরুণরা) কথা বলছে। এটাই তাদের বাস্তবতা এবং আমি তাদের এই বক্তব্য তুলে ধরতে চেয়েছি।
“সোমালিয়ায় তরুণদের উপস্থিতি অপ্রকাশ্য। দেশের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বয়স ৩০ বছরের কম অথচ তারা যেন অদৃশ্য। আমাদের এখানে রাজনীতিকরাই তারকা। তারাই সবকিছু দখল করে বসে আছেন।”
‘আরদে’র অন্যতম অভিনেত্রী ২১ বছরের শুকরি আবদিকাদির। অথচ এই ধারাবাহিকে অভিনয়ের আগে এ ধরনের কাজে অভিনয়ের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তার। এর আগে এই তরুণী মোগাদিশুতে একজন রেস্তোরাঁকর্মী হিসেবে কাজ করতেন।
শুকরি আবদিকাদির বলেন, “আমার অডিশনও (অভিনয় দক্ষতা যাচাই) নেওয়া হয়নি। আমি বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা অডিশন দিচ্ছিল। ওই সময়ই পরিচালক আমাকে দেখতে পান এবং আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমি অভিনয় করতে আগ্রহী কি না? আমাকে তখনই এই ধারাবাহিকের অন্যতম কেন্দ্রীয় ও বিতর্কিত একটি চরিত্রের জন্য মনোনীত করা হয়।”
সম্প্রতি সোমালি ভাষায় নির্মিত সফল চলচ্চিত্র ‘আইয়ানলে’র নির্মাতা ফারাহ তার এই পুরো ধারাবাহিকটি সোমালিয়ায় শুট করার মতো বিশাল এক ঝুঁকি নিয়েছেন।
বিবিসি বলছে, সোমালিয়ার মতো দেশে, মোগাদিশুর মতো একটি শহরে ১৬ থেকে ২১ বছরের অনভিজ্ঞ ও অপেশাদার কিশোর-তরুণদের নিয়ে এই ধরনের একটি ধারাবাহিকের চিত্রায়ন খুবই বড় একটি পদক্ষেপ।
অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত ৬০ জনের দলটি তিন মাসের জন্য পারিশ্রমিক পেয়েছে, পুরো ধারাবাহিকের চিত্রায়ণ শেষ করা পর্যন্ত এবং এই নির্মাণ কাজের জন্য ১৮ জন তরুণ সোমালির একটি দলকে নিজেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ফারাহ।
এই ধারাবাহিককে বিবেচনা করা হচ্ছে সোমালিয়ার এক সময়ের উজ্জীবীত চলচ্চিত্র শিল্পের পুনরুজ্জীবনের কেন্দ্র হিসেবে। বছরের পর বছর ধরে চলা সহিংসতায় ভেঙে খান খান হয়ে গেছে সেখানকার চলচ্চিত্র শিল্প।
আহমেদ ফারাহর এই ধারাবাহিকের অন্যতম উপজীব্য ‘অ্যাবিউজ পর্ন’ বা ‘নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের চিত্র ধারণ করে তার অপব্যবহার’।
‘আরদে’র কাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে: একটি মেয়েকে একটি অনুষ্ঠানে মাদক সেবন করানো হয় এবং তাকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণ ও মাদক সেবনের দৃশ্য ধারণ করে ওই মেয়েরই কয়েকজন সহপাঠী পরে যারা সেই ভিডিওচিত্র প্রকাশ করার ভয় দেখিয়ে ওই মেয়ের কাছ থেকে অর্থ দাবি করে।
সোমালিয়াতে এমন ঘটনা একটি মূর্ত বাস্তবতা এবং এই সমস্যা সেখানে বেড়ে চলেছে। সেখানকার নারীরা প্রায়ই শারীরিক নিপীড়নের শিকার হওয়ার পাশপাশি এ ধরনের ‘অ্যাবিউজ পর্ন’ ছড়িয়ে দেওয়ার হয়রানির মুখোমুখি হয়ে থাকেন।
পুরুষরা ‘টেলিগ্রাম’র মতো অ্যাপে এসব ‘পর্নগ্রাফি’ ভিডিও দেখার জন্য অর্থ খরচ করেন। আর এর কারণে অনেক মেয়েরই জীবন নষ্ট হয়ে যায়, তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
‘আরদে’র আরেক তারকা বদরিয়া ইয়াহিয়া বলেন, “আমাদের মা-বাবা ও আমাদের সম্প্রদায় এসব বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী না। তারা চায় না আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু আমরা এটা করছি কারণ আমরা চাই বাস্তব সম্পর্কে তাদের সজাগ করে তুলতে।”
এই ধারাবাহিকে অভিনয় করতে গিয়ে ইয়াহিয়া ও আবদিকাদির- দুজনেই পরিবার থেকে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন।
নির্মাতা ফারাহ জানালেন, অনেক পরিবারই শুরুর দিককার শুটিং দেখার পর তাদের সন্তানদের আর এখানে কাজ করতে দেয়নি।
“আমাদেরকে তাদের চরিত্র বাদ দিতে হয়েছে। এই সিরিজটি নির্মাণ করায় এখন তাদের অনেকেই আমাকে ঘৃণা করে। তারা আমাকে ‘বেইমান’ বলে গালি দেয়। বলে আমি নাকি পশ্চিমাদের টাকা খেয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে বদলানোর জন্য এই কাজ করেছি।”
অথচ ‘আরদে’ নির্মাণের পুরো খরচই সোমালিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান আহমেদ ফারাহ।
তবে ‘আরদে’ শুধু সোমালি সমাজের বাস্তবতা ও বিতর্কিত বিষয়বস্তুর জন্যই আলোচিত হয়নি। বরং এর নির্মাণও এই ধারাবাহিককে আলোচনায় তুলে আনার অন্যতম কারণ। দীর্ঘ বছরের মধ্যে ‘আরদে’ প্রথম বড় একটি কাজ যা মোগাদিশুর রাস্তায় শুট করা হয়েছে।
ফারাহ বললেন, “এটা একটা সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতি। মানুষ এমনটা কখনও দেখেনি। সেখানে চিত্রধারণ খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ। সোমালিরা খুব জোরে কথা বলে। তাই পথচারীরা এই শুটিংয়ের অন্যতম প্রতিবন্ধক ছিল। এছাড়া মাইকের শব্দ আর গোলাগুলির শব্দ তো ছিলই।”
আহমেদ ফারাহর জন্য আরেকটা চ্যালেঞ্জ ছিল অভিনয় ইউনিটে মেয়েদের ঝগড়া। বিশেষ করে কিশোরীদের মধ্যে মারামারি বেঁধে যেত।
তিনি বলেন, “আমি যদি এই ধারাবাহিকের ‘মেকিং অফ’ (নির্মাণের পেছনের গল্প) নির্মাণ করে মুক্তি দিই, তাহলে সেটা একটা ‘বেস্টসেলারে’ পরিণত হবে।”
এই ধারাবাহিকে আরও একটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে তা হলো কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি।
সবমিলিয়ে ‘আরদে’ দেশটির এই দারুণ সংকটময় সময়ে তার তরুণ জনগোষ্ঠীকে হয়ত নতুন করে ভাবতে শেখাবে। দুঃসাহসিক পরিস্থিতিতে নির্মিত এই ধারাবাহিক হয়তো হয়ে উঠবে সোমালিদের নতুন সময়ের অঙ্গীকার।