‘সস্তা জিনিসই বেশি জনপ্রিয় হয়’

টিটো রহমানের ‘বউ কথা কও’ গল্পের অনুপ্রেরণায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেছেন নিজের ষষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘ফাগুন হাওয়ায়’। চলতি সপ্তাহেই ছবিটি সেন্সরে জমা পড়বে; মুক্তির সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারি।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Jan 2019, 02:30 PM
Updated : 15 Jan 2019, 11:03 AM

মুক্তির আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্রটি নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা শোনালেন নির্মাতা। আলাপচারিতায় আরও উঠে এল, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বিপরীতে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগ্রাম, দেশের দর্শকের রুচিবোধ ও বাইরের ফেস্টিভালে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সম্ভাবনার কথা।

গ্লিটজ: ‘ফাগুন হাওয়ায়’ মুক্তি নিয়ে কী ধরনের প্রচারণার পরিকল্পনা করেছেন?

তৌকীর আহমেদ: এটা আসলে ডিস্ট্রিবিউটর ও প্রডিউসার করবেন; ডিরেক্টরের কাজ না। যদিও আমাদের দেশে ডিরেক্টররা করে থাকেন। আমি এটা পারি না, দুর্বল। এখন স্যোশাল মিডিয়া বেশ জনপ্রিয়; সেখানে প্রচারণা হতে পারে। পাশাপাশি টেলিভিশন, অনলাইন গণমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় প্রচার করা হবে।

 

এবার আমাদের সঙ্গে আছে টাইটেল স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হয়েছে ওয়ালটন। পণ্যটির বেশ কিছু শো’ রুমে ছবির ট্রেইলার, গান, পোস্টার থাকবে। সঙ্গে কিছু বিলবোর্ডও করার ইচ্ছা আছে। আমি জানি না, প্রচারে কতটা পারব। এ ব্যাপারে পূর্ব অভিজ্ঞতা খুব খারাপ।

গ্লিটজ: এর আগে আপনার ‘অজ্ঞাতনামা’র যথাযথ প্রচার হয়নি বলে অনেকে অভিযোগ করেছিলেন…

তৌকীর আহমেদ: আমি এখানে পরিস্কার করে নিই, প্রচার-প্রচারণা বিশেষায়িত কাজ। যদিও আমাদের ছবিগুলোতে প্রচারণার সঙ্গে অতটা সঙ্গতি থাকে না। এগুলো কোনও এজেন্সির করা উচিত বলে মনে করি।

গ্লিটজ: চলচ্চিত্রের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রচার-প্রচারণা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?

তৌকীর আহমেদ: আমি কখনও প্রচার সর্বস্ব হতে চাইনি। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। অনেক ভালো প্রচারেও অনেক বাজে প্রোডাক্ট আমরা দেখি। এই জায়গায় আমার ভীষণভাবে আপত্তি আছে। বর্তমানে পুঁজিবাদি বিশ্বে প্রচার-প্রচারণা দিয়ে মানুষকে অনেক কিছু গিলিয়ে দেওয়া হয়। কনজিউমার ওয়ার্ল্ডে সেটাই স্বাভাবিক হয়তবা। কিন্তু সেটাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি সমর্থন করি না।

তবে ব্র্যান্ডিং বলে একটি বিষয় আছে; চলচ্চিত্রেরও ব্র্যান্ডিং হয়। দর্শককেও বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে, ছবিটা কী নিয়ে, তিনি আগে কী নির্মাণ করেছেন, কারা অভিনয় করছেন। তিনিও যদি চোখ-কান খোলা রাখেন তাহলে প্রচারণা সহজ হয়।

গ্লিটজ: চলচ্চিত্রটি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কেমন?

তৌকীর আহমেদ: আমি ভালো করেই কাজটা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনও কাজ ভাবার সময় যেমন আশাবাদী থাকি; কাজটা করার সময় এক ধরনের ইনসিকিউরিটি তৈরি হয়। মনে হয় যতটা ভালো আশা করেছিলাম ততটা হল কি না। এটাও কিন্তু আমার প্রচারের এগেইনেস্টেই যাবে। আমার বিনয় আমার প্রচারবিমুখতাকে প্রমাণ করবে। তা বলতে চাচ্ছি না। অবশ্যই আমি ভালো ছবি নির্মাণের চেষ্টা করেছি; কারণ খারাপ ছবির কোনও মূল্য নেই।

ছবি যদি ভালো হয় তাহলে টিকে থাকবে। এই টিকে থাকার মধ্যেই ছবির সাফল্য; প্রচারণার মধ্যে নয়। এই সময়ে হয়ত অবহেলিত থাকতে পারে আবার সময় পার হলে কালোত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকে।

আমার ছবির প্রচার করতে চাইব; অবশ্যই সেটা ডিস্ট্রিবিউটরে উপর নির্ভর করছে। তবে আমি ছবির কোয়ালিটির দিকে যত্নবান হওয়ার চেষ্টা করেছি। তারপরও আমার সীমাবদ্ধতা আছে। যতটুকু পেরেছি ততটুকুই করেছি।

গ্লিটজ: ছবিটার পরিকল্পনা করেছিলেন ২০০৮ সালে; তার প্রায় ১০ বছর পর এসে মুক্তি পাচ্ছে। এত সময় নিলেন কেন?

তৌকীর আহমেদ: ২০০৮ সালে পরিকল্পনা করলেও তখন প্রডিউসার পাইনি। অনেকে হয়ত ভেবেছে, ছবিটা চলবে না। প্রচলিত অর্থে নাচে-গানে ভরপুর নয়। কেউই টাকা লগ্নী করতে চায়নি। কিন্তু আমি তো ভাষা আন্দোলনের উপর কোনও ডকুমেন্টারি করছি না।

 গল্পটা সেই প্রেক্ষাপটে একটি মফস্বলের গল্প; যেটি আমাদের ভাষা আন্দোলনকে রিলেট করবে। এর মধ্যেও প্রেম আছে, সুন্দর গল্প আছে, বেদনা আছে।

গ্লিটজ: ছবির বিষয় হিসেবে ভাষা আন্দোলনকে কেন বেছে নিলেন?

তৌকীর আহমেদ: ভাষা আন্দোলনকে স্পর্শ করে দেশে খুব বেশি কাজ হয়নি। অনেক আগে থেকেই মাথায় ছিল, দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে সিনেমা করব। দেরিতে হলেও কাজটা করা গেল-এটাই ভালো লাগার।

গ্লিটজ: ভালো আন্দোলন নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনও চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি আগে। কোনও ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ ছাড়া কাজটা আপনার কাছে কতটুকু চ্যালেঞ্জিং?

তৌকীর আহমেদ: এটা তো অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে ঢাকা শহরে যদি কোনও পিরিয়ড ফিল্ম করতে চান তাহলে সেটি দুরূহ হয়ে যাবে। খুব ব্যয়বহুল। সেকারণেই আমার গল্পের প্রেক্ষাপট মফস্বল।

আমি গল্পটিও সেভাবেই বেছেছি। রূপকভাবে মূল আন্দোলনকেই রিপিট করবে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে পিরিয়ড একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ছবিতে পুলিশের গাড়ি দেখাতে হবে; সেটি অবশ্যই বায়ান্ন সালের হতে হবে। মটরসাইকেল, টাইপরাইটার, রাস্তাঘাট-বাড়িঘর সবকিছুতেই পিরিয়ড অথেন্টিসিটি থাকতে হবে।

একটি রেডিও যোগাড় করতে দেখা গেল, ২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জের বাইরে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। যেমন, বর্তমানে চটুল বিশ্বে সস্তা জিনিসই বেশি জনপ্রিয় হয়। দর্শক কী পছন্দ করবে তেমন বিষয়বস্তু নিয়েই অনেকে কাজ করেন। সেটাও আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ।

গ্লিটজ: চটুল বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রকে স্বাধীন চলচ্চিত্রের বিকাশে অন্যতম বাধা হিসেবে দেখছেন?

তৌকীর আহমেদ: ভীষণ ক্ষতি করছে। ক্রমাগতভাবে জনরুচি যদি নামিয়ে নিয়ে যান তখন দর্শককে ভালো কিছু দিতে পারবেন না। আমার ছবিগুলো বাণিজ্যিক ধারার ছবি না; ফলে অনেকে এগুলোকে আগ্রহ দেখান না। ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘জয়যাত্রা’, ‘রুপকথার গল্প’র মতো চলচ্চিত্র হলওয়ালারা নিতে চাননি; আবার দর্শকও নিতে চাননি।

অনেকে অভিযোগ করেন, প্রচার হয়নি। কিন্তু দর্শককেও একটু খোঁজ রাখতে হবে। দেশে এখন উচ্চস্বরের কমেডি মিশ্রিত ভাঁড়ামো চলচ্চিত্রগুলো বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। কারণ দর্শকের রুচি ওই ধরনের হয়ে গেছে। কিন্তু একটা ইউরোপীয় চলচ্চিত্রে ওই ধরনের অভিনয় খুঁজে পাবেন না। ওই ধরনের ভাঁড়ামো খুঁজে পাবেন না।

হলিউড ও বলিউডই বিশ্বে এই ধরনের ক্ষতিটা ক্রমাগতভাবে করে যাচ্ছে।… এটা মনে করার কোনও কারণই নেই, স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলো সুপারহিট হবে। সেই পরিমাণ রুচিশীল দর্শক তৈরি হয়নি। যদি কোনও রুচিশীল চলচ্চিত্র সুপারহিট হয় তাহলে বুঝতে হবে ঝামেলা ছিল। (হা হা।)

খুলনার পাইকগাছায় ‘ফাগুন হাওয়ায়’ চলচ্চিত্রের শুটিং।

গ্লিটজ: ক্রমাগত নিন্মগামী জনরুচির পেছনে নির্মাতাদের দায়ও তো থাকে।      

তৌকীর আহমেদ: সমস্যা হল, দর্শক যা দেখতে চান ডিরেক্টরা তাই দেখাতে চান। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দর্শকের রুচিকে ক্রমাগত নামিয়ে আনেন। দর্শককে ক্রমাগতভাবে ভালো সিনেমা দিলে কিন্তু উন্নতি হত। ষাটের দশকে বা সত্তরের দশকে বাংলাদেশে ভালো সিনেমা হয়েছে। তারপর ভালো ছবির সংখ্যা বাড়েনি; বেড়েছে বাণিজ্যিক ছবি।

ফ্যান্টাসি নির্ভর ছবি এসেছে-যেগুলোর কোনও আগামাথা নেই। না আছে কাল-প্রেক্ষাপট না আছে অথেনন্টিসিটি। আরও এসেছে ‘সাপের সিনেমা’, ‘ঘোড়ার সিনেমা’ ‘রূপকথার সিনেমা’। বাচ্চাদের জন্য নির্মল আনন্দের হিসেবে রূপকথা আনলে ঠিক ছিল। কিন্তু ওখানেও নৃত্যু দৃশ্য থাকছে, সুড়সুড়ি থাকছে-এভাবে দর্শকের রুচিতে ক্রমাগতভাবে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নামাতে নামাতে এমন জায়গায় চলে এসেছে যে, কোনও ভালো জিনিস দিলে আর কেউ দেখতে চাইবে কি না সন্দেহ।

এখন অবস্থার হয়ত কিছুটা পরিবর্তন ঘটছে। শিক্ষিত শ্রেণি বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহী হচ্ছে। তবে ঢাকা শহরের স্টার সিনেপ্লেক্স আর যমুনা ব্লকবাস্টারের চিত্রই ‍দেশের চিত্র না। ফেইসবুকের চিত্রই কিন্তু পুরো দেশের চিত্র না।

ঢাকার বাইরে এমনও শুনেছি, ‘অজ্ঞাতনামা’ মাত্র ৪ জন দেখেছেন। এই ঘটনা একদিনে ঘটেনি। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, এটি একটি দর্শনগত রূপান্তর। একটি জাতির মনন কোথায় অবস্থান করবে সেটা দর্শকের রুচির উপর নির্ভর করবে।

জার্মান, ইউরোপে ‘সাপের ছবি’ দেখানোর চেষ্টা করেন, পারবেন না। আমেরিকায় আবার অ্যাকশন, থ্রিলার, হরর, সুপারহিরোর মুভির চাহিদা আছে। মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রি তাদের মতো করে নাচে-গানে ভরপুর চলচ্চিত্র তৈরি করছে। সেগুলো তো আসলে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ঘটনা না। এগুলো বাণিজ্যিক প্রচেষ্টামাত্র। মাথায় রাখতে হবে, চলচ্চিত্র হচ্ছে কি না।

গ্লিটজ: স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলো লগ্নীকৃত টাকা তুলতে পারে না, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বিপরীতে দর্শকের কাছেও ঠিকঠাক মতো যেতে পারে না। বাণিজ্যিক স্রোতের বিপরীতে কোন তাড়না থেকে নিজেকে নির্মাণে সামিল রাখছেন নিজেকে?

তৌকীর আহমেদ:  শিল্পক্ষেত্রেই বিচরণ করেছি আমি। থিয়েটার থেকে নাটক, সেখান থেকে চলচ্চিত্রে এসেছি। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র একটি জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মনন গঠনের বড় অস্ত্র। আমি শিল্পের মধ্যেই থাকতে চাই, শিল্পী হতে চাই। সেই কাজে চলচ্চিত্র আমাকে উৎসাহিত করেছে। ভালো চলচ্চিত্র নিজেকে যেমন তৃপ্তি দেয় তেমনি মানুষেরও ভালো লাগতে পারে।

বিশ্বের অনেক দেশ শুধু চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নিজেদের বিশ্ব দরবারে উজ্জল করেছে। টার্কিশ, কোরিয়া, ফিলিপাইনের ছবি অনেক এগিয়ে গেছে। নেপালেও এখন অনেক ভালো ছবি হচ্ছে। তাহলে আমরা কেন পারব না?

আমি পরিস্কার করে নিই, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ব্যাপারে কোনও বিরূপ ধারণা নেই। বিনোদনের জন্য যদি দরকার হয় হোক। কিন্তু আপনারা দয়া করে রুচিটা নষ্ট করবেন না। একটা স্ট্যান্ডার্ড রাখেন। আর আমাকে আমার কাজটা করতে দিন।

অনেকে অভিযোগ করেন, আপনার কাজটা কবে হলো আমি তো জানতেই পারলাম না। জানার দায়িত্ব দর্শকেরও আছে। কারণ ‘ফাগুন হাওয়ায়’ যে নির্মাণ হয়েছে সেটা অনেকে জানেন। এরকম অনেকেরই হয়ত চোখে পড়েছে কিন্তু মনে পড়েনি। সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয়, দর্শক তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি।

গ্লিটজ: স্বাধীন চলচ্চিত্রের এই যাত্রাপথে আপনি একাকিত্ববোধ করেন?

তৌকীর আহমেদ: শিল্পের কাজটাই একাকিত্বের। শিল্পী নিঃসঙ্গ হন; দলবাজ নন। তারা প্রচার-প্রচারণা করেন না। শিল্পী শুধু কাজটাই করতে চান। তিনি একা হলেও সমষ্টির কথায় বলতে চান, সমাজের কথায় বলতে চান। যেহেতু তিনি নিভৃতের লোক; অসহায় তো বটেই। ইবসেনের একটা কথা আছে, ‘সেই শক্তিমান যিনি ব্যক্তি হিসেবে যিনি একা দাঁড়াতে পারেন।’

গ্লিটজ: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত চলচ্চিত্রে উপমহাদেশের দর্শক ইতিহাসের চিত্রনাট্য ধরে ধরে শুধু ঘটনাই খুঁজতে চান। আগেও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকের প্রত্যাশা আর নির্মাতার ভাবনার দ্বন্দ্ব দেখা গেছে। বিষয়টি আপনার জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করেছে কি না?

তৌকীর আহমেদ: ‘হালদা’র ক্ষেত্রেও একই অনুভূতি হয়েছে আমার। অনেকে কিছু বুঝতে চেয়েছেন। কিন্তু যখন একজন নারীর মাতৃত্ব ও মাছের প্রজননের বিষয়টি এসেছে তখন অনেকের বুঝতে কষ্ট হয়েছে। অনেকে জাহিদ হাসান-মোশাররফ করিম ও তিশার ত্রিভুজ প্রেমের গল্প হিসেবে দেখেছেন ছবিটা। কিন্তু এটার অন্য লেয়ার আছে, অন্য বাস্তবতা আছে-সেই অ্যাঙ্গেল মিস করে যাচ্ছেন।

সেই জন্যই বলি, দর্শকেরও প্রস্তুতির দরকার; তাদেরও পরিণত হওয়া দরকার। আমি তো একা পারব না। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নিয়ে বলব, এটি কোনও ডকুমেন্টারি না। ফলে ওই ধরনের কোনও প্রত্যাশা না করা ভালো।

ইদানীং মনে হয়, পাঠ্য তালিকায় চলচ্চিত্র থাকা উচিত ছিল। আমাদের সময়ে নবম শ্রেণিতে ‘মেকিং অ্যা ফিল্ম’ শিরোনামে একটি আর্টিকেল ছিল। সেটা আছে কি না জানা নেই। ন্যূনতম স্কুল জীবনে থিয়েটারের সঙ্গে পরিচিত করানো উচিত ছেলে-মেয়েদের। পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ করবে, থিয়েটার করবে। আর হাইস্কুলে এসে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশনের উপর কোর্স হওয়া উচিত। ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

উন্নত দেশগুলো শিক্ষা-সংস্কৃতিতেই উন্নত। রাশিয়া, জার্মানী, ইংল্যান্ডে এই ধরনের বিষয় রয়েছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছি; পাশাপাশি শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়েও আগাতে হবে। নতুবা অর্থহীন হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।

গ্লিটজ: কিন্তু আমরা যে দেশে বাস করি, সেখানে এখনও নারী শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন আসে। চতুর্থ শ্রেণির বেশি না পড়ানোর ‘ওয়াদা’ করেন শাহ আহমদ শফী। সেখানে শিক্ষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব?

তৌকীর আহমেদ:  হ্যাঁ। আমিও কথাটা কাল শুনেছি। এটা কেন বলা হয়েছে? কারণ একটাই, ক্রমাগতভাবে আমরা সংস্কৃতিহীন হয়ে পড়ছি। অথচ এই দেশ একসময় সেক্যুলার ছিল। সেটাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ভূখন্ডের মানুষ সহস্র বছর ধরে সংস্কৃতিবান। তাদের ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে। সংস্কৃতির দিকে ঐতিহ্যের দিকে বারবার ফিরে তাকাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ছবি বারবার হবে। সেটা না করতে পারার ফলেই জাতিগতভাবে পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা।

গ্লিটজ: আরও কী কী কারণে সাংস্কৃতিকভাবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি বলে মনে করেন?

তৌকীর আহমেদ:  অপশাসন। যেটা পঁচাত্তরের পর থেকে অগণতান্ত্রিক শাসনের মধ্য দিয়ে গেছি। যেখানে ধর্মীয় অনেক বিষয়কে অযাচিতভাবে সামনে আনা হয়েছে, সেগুলো ক্ষতি করেছে। সুস্থির জায়গায় যেতে সময় লাগছে। একটি চলচ্চিত্র সেই জায়গায় যেতে ভূমিকা রাখতে পারে। চলচ্চিত্রের মধ্যেই আমরা এগিয়ে নিতে যেতে পারি।

গ্লিটজ: নানা সংকটের স্তুপে দাঁড়িয়েও বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে কোনও সম্ভাবনা দেখছেন?

তৌকীর আহমেদ:  আশা করছি, তরুণরা নতুন ভাবনা নিয়ে আসবে। তবে আশার চেয়ে আশংকায় বেশি দেখছি। ঘুরেফিরে যে মার্কেটিং, বাণিজ্যিকরণের কথা বলা হচ্ছে সেখানে তরুণদের মেধাও বাণিজ্যের উপাদানের পেছনে ঘুরতে থাকবে।

প্রডিউসারদের উদ্দেশ্যই হয়ে গেছে, বিলিয়ন ডলার না তুলতে পারলে কেন বিলিয়ন ডলার খরচ করব? অর্থ যার কাছে তিনিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। অনেকে বলতে চান, ভালো ছবি হবে আবার বাণিজ্যিও করবে। এটা বিরল ঘটনা। সে সমাজ এগিয়ে আছে সেখানে হয়তো সম্ভব কিন্তু অন্য সব জায়গায় খারাপ ছবিই বেশি চলে। সস্তা জিনিসই বেশি জনপ্রিয় হয়। এটা আমরা সবাই জানি।