দুই জাপানির বাংলা গানের দল ‘বাজনা বিট’

কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা জাপানি নাগরিক মায়ে ওয়াতানাবে ও সুনসুকে মিজুতানি এখন বাংলায় সুর বাঁধছেন, গড়ে তুলেছেন গানের দল।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2023, 11:56 AM
Updated : 24 Feb 2023, 11:56 AM

জীবনের প্রয়োজনেই এসেছিলেন লাল-সবুজের দেশে, শহর আর গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, শিখেছেন বাংলা, বেঁধেছেন গান; যেন জীবনের স্বাদ খুঁজে পেয়েছেন বাংলার পথে পথে।

কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা জাপানি দুই নাগরিক মায়ে ওয়াতানাবে ও সুনসুকে মিজুতানি এখন বাংলাতে সুর বাঁধছেন, গড়ে তুলেছেন গানের দল।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ইতোমধ্যে তারা ভিন্ন কণ্ঠে তুলেছেন চেনা সুর। সূর্যোদয়ের দেশের গোছালো জীবন ছেড়ে বাংলায় সেই দ্যুতি ছড়াতে চান বাকি জীবন।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে তাদের গানের দল ‘বাজনা বিট’ যোগ দিয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। সেখানে গান শেষে নগরীর র‌্যাডিসন হোটেলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয় তাদের সঙ্গে।

বাংলায় আসা, বাংলা শেখা

জাপানের নারা এলাকার বাসিন্দা সুনসুকে মিজুতানি ২০০৭ সালে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেবার অবশ্য বন্যা দেখে কিছুটা ভয়ই পেয়েছিলেন।

তার কথায়, “২০০৯ সালে আবার আসি এনজিও ‘একমাত্রা’য় ইন্টার্নশিপ করতে। এক বছর ছিলাম। তারপর আরো কয়েকবার এসেছি। ২০১৪ সালে ঢাকায় চলে আসি।”

ওই বছরই তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন সুনসুকে। এখন ওই প্রতিষ্ঠান এনিমেশনসহ তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন কাজ করে ১৫ জন বাংলাদেশি।

আর টোকিওর মায়ে ওয়াতানাবে ২০০৯ সালে প্রথমবার বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। তখন ছিলেন এক সপ্তাহ। জাপানে তিনি মঞ্চে অভিনয় ও শিশুদের নিয়ে নাটক করতেন।

২০১২ সালে এনজিও ‘একমাত্রা’য় যোগ দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করতে বাংলাদেশে চলে আসনে মায়ে।

এদেশের শিশুদের কাছেই বাংলা শিখেছেন জানিয়ে মায়ে ওয়াতানাবে বলেন, “গ্রামের নারীরা এবং শিশুরা আমার বাংলা শেখায় টিচার হয়েছে।”

আর সুনসুকে মিজুতানির বাংলা শেখাটা আরও অভিনব। তিনি বলেন, “আমি বাংলা জানতাম না। এখানে থাকতে শুরু করার পর কাজ শেষে প্রতি রাতে এলাকার চায়ের দোকানে গিয়ে আড্ডা দিতাম। আড্ডার বন্ধুদের কাছ থেকেই একটু একটু করে বাংলা শেখা।”

‘বাজনা বিটে’ পথ চলা

একটু একটু বাংলা শেখা আর ভিনদেশি ভাষার প্রতি আগ্রহ থেকে ২০১৬ সালে এই দুই জাপানি মিলে গড়ে তোলেন গানের দল ‘বাজনা বিট’।

কেন এমন নামকরণ? মায়ে বলেন, “জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যেকার বন্ধুত্বকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরতে একটা বাংলা নাম দিতে চাই। ‘বাজনা’ শব্দটিতে বাংলাদেশের ‘বি’ আছে আবার জাপানের ‘জে’ও আছে। খুব সুন্দর শব্দ, ডিকশনারিতে পাই।

“বাজনা আবার বাংলায় গানের সাথেও সম্পৃক্ত। আর জাপানি ভাষায় ‘বিট’ শব্দের অর্থ মানুষ। সব মিলিয়ে মানুষ আর সংগীত মিলিয়ে ‘বাজনা বিট’ নামকরণ।”

সুনসুকে অবশ্য গান করেন ছোটবেলা থেকেই। যখন ক্লাস থ্রিতে পড়তেন তখনই তার গান শেখার শুরু। হাই স্কুলে ওঠার পর মিউজিক শুরু করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “মনের আনন্দের জন্য গান করি”।

আর নাটকের দলে গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মায়ে। তার ভাষ্য, “শুরুতে আমরা জাপানি গান বেশি গাইতাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ জাপানি ভাষা জানে না। ওই গান শুনতে হয়ত তাদের বোরিং লাগত। তাই লাইভ অনুষ্ঠানে এক্সাইটমেন্ট আনতে বাংলা গান ও ব্যান্ড মিউজিককে বেছে নিই।

“শ্রোতাদের আনন্দ দিতে পরিচিত গানগুলো গাই। তারপর শ্রোতাদের রেসপন্স নিয়ে আবার নিজেরা কাজ করি। প্র্যাকটিস করি।”

সুনসুকে বলেন, “বাংলাদেশ ও জাপানের সংস্কৃতিতে যেমন মিল আছে, তেমন সংগীতে পার্থক্যও আছে। আমরা দুই ভাষার গানে ফ্লেভারের আদান-প্রদান ঘটাতে চাই।”

মায়ে এবং সুনসুকে দুজনেই আছেন ভিন্ন পেশায়, তাই সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সময় করে অনুশীলন করেন, নতুন নতুন গান তোলেন। 

বাংলায় গান

লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা ও সুর করা ‘একই বৃন্তে শাপলা আমি/ তুমি সাকুরা/ সুখে দুঃখে পাশে আছি/ বন্ধু আমরা/ তোমার আমার এই বন্ধন হবে না তো শেষ/ আমি লাল সবুজের দেশ, তুমি সূর্যোদয়ের দেশ’- গানটি বাংলাদেশি শিল্পী সন্ধির সঙ্গে বাংলা ও জাপানি ভাষায় গেয়েছেন মায়ে ও সুনসুকে। এটি তাদের প্রিয় একটি গান।

২০২০ সালে বাংলাদেশ অলিম্পিক ও প্যারা অলিম্পিক সাপোর্টিং সং- ‘চলো উড়ে বেড়াই ডানা মেলে, ওই দূর আকাশে’ শিরোনামের গানটিও করেছে বাজনা বিট।

২০২১ সালে শরৎ অ্যালবাম ‘লাইফ’ রিলিজ করে বাজনা বিট। টি’স মিউজিক থেকে মুক্তি পাওয়া অ্যালবামটির ১০টি গানের মধ্যে পাঁচটি মৌলিক গান ও পাঁচটি কভার করা। অ্যালবামের ‘লাইফ’ গানটির গীতিকার সজল বড়ুয়া ও দীপ্ত ইবনে জাকির।

জাপানি ভাষা শিক্ষক ও লেখক সজল বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাপানের মানুষ অসম্ভব সুশৃঙ্খল। তারা নিয়মনিষ্ঠ জীবন যাপন করে। মায়ে ও সুনসুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত শুভবোধ আছে। মানুষের জন্য, বাংলাদেশের জন্য। গানে গানে সে কথাই তারা বলে যেতে চায়।”

‘বাংলাদেশের প্রেমে পড়েছেন’ জানিয়ে সুনসুকে বলেন, “বাকি জীবনটা এদেশেই থাকতে চাই। বাংলাদেশ হয়ত জাপানের মত অত উন্নত এখনো নয়। তবে আগাচ্ছে।

“জাপানে বিশাল বিশাল রাস্তা। একটাও গাড়ি নেই। একজন লোকও নেই রাস্তায়। কারো সাথে কারো কথা নেই। সবাই ব্যস্ত। এখানে তা নেই। চারপাশে অনেক শব্দ, অনেক গন্ধ। ঘ্রাণ পাই। মনে হয় যেন বেঁচে আছি। এখানে কিছু কষ্ট আছে দেখে আনন্দ অনেক বেশি।”

কাজের প্রয়োজনে মায়েও প্রায়শ গ্রামে ছুটে যান, সেখানে শিশুদের সাথে সময় কাটান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এগিয়ে যাওয়ার ফিলিংসটা এদেশের মানুষের মধ্যে আছে। এটা খুব ভালো। আমরা নিজের জন্য সবাই ভাবতে থাকি। এককেন্দ্রিক। পৃথিবীটা শুধু তো আমাদের নয়। এখানে ৫০০ বছর পরও মানুষ থাকবে। পৃথিবীটা কেন নষ্ট করব? আগামীর মানুষের জন্য ভালো কিছু রেখে যেতে চাই।

“‘লাইফ’ গানের লিরিকে যেমন বলা হচ্ছে, ‘…আমাদের পৃথিবী অশ্রুভরা বিষণ্ন/ আমাদের জগতটা যেন রণক্ষেত্র/ তারপরেও যতটুকু পারি তোমার জন্যে/ ঝলমলে সুন্দর কিছু রেখে যেতে চাই’।”

চট্টগ্রামের র‌্যাডিসন হোটেলের লবিতে থাকা পিয়ানোতে সুর তুলে মায়ে ও সুনসুকে গেয়ে ওঠেন, ‘আমি বাংলার গান গাই, আমি বাংলায় গান গাই’। আশেপাশের সবাই সেখানে জড়ো হতে থাকেন, গানের শেষে করতালিতে তাদের অভিবাদন জানান।