কাটছাঁট ছাড়াই ছাড়পত্র পেল গণঅর্থায়নের ‘সাঁতাও’

প্রযোজক না পেয়ে গণমানুষের টাকায় এ সিনেমা বানিয়েছেন খন্দকার সুমন।

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2022, 12:02 PM
Updated : 15 Sept 2022, 12:02 PM

উজানের বাঁধে মরুভূমিতে রূপ নেওয়া ভাটি অঞ্চলের কৃষকের হাত-পা বাঁধা প্রকৃতি আর এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে। সেইসব কৃষকদের যাপিত জীবনের যন্ত্রণা আর সংগ্রাম নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘সাঁতাও’ কাটছাঁট ছাড়াই ছারপত্র পেল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড থেকে।

চলচ্চিত্র নির্মাতা খন্দকার সুমন তার ‘সাঁতাও’ সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন গণঅর্থায়নে। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আইনুন পুতুল, ফজলুল হক ও আব্দুল্লাহ আল সেন্টু।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার অর্থ হল সিনেমাটি মুক্তিতে আর কোনো বাধা নেই।

মুক্তির অনুমতি পেয়ে উচ্ছ্বসিত পরিচালক খন্দকার সুমন গ্লিটজকে বলেন, “স্বাধীন ধারার সিনেমা আনকাট সেন্সর পাওয়াটা খুবই আনন্দের ঘটনা।”

এই নির্মাতা জানান, টানা কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণকে রংপুর অঞ্চলে বলে ‘সাঁতাও’। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন যাপনের চিত্রায়নের প্রয়াস থেকে তার এ সিনেমার কাজে হাত দেওয়া।

“শৈশবে সাঁতাওয়ের কবলে ঘরে বন্দি থাকার অনুভূতি নিয়ে আমার সিনেমা। এতে তুলে ধরা হয়েছে প্রকৃতি তথা মাটি, প্রাণী ও মানুষের সম্পর্কের গল্প। আছে মাতৃত্বের সার্বজনীন রূপ এবং সুরেলা জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না।”

সুমন বলেন, ওই এলাকায় এমন জনগোষ্ঠী আছেন, তারা গান গেয়ে মাতম করেন, গান গেয়ে আনন্দ করেন। তাদের সুখ দুঃখ সবকিছু প্রকাশ ঘটে সংগীতে। তাদেরই ‘সুরেলা জনগোষ্ঠী’ বা মিউজিক্যাল কমিউনিটি বলা হচ্ছে।

আগামী নভেম্বরের শেষে কিংবা ডিসেম্বরের শুরুতে এ সিনেমা মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান নির্মাতা।

তিনি জানান, রংপুরের তিস্তা তীরবর্তী চর গগুন্দা নামের যে গ্রামে সাঁতাওয়ের শুটিং হয়েছিল, সেই গ্রামটি তিস্তার ভাঙনে এখন নদীগর্ভে।

“আমাদের সিনেমায় একটি তালগাছ আছে। এখন সেই তালগাছটা নদীর মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।”

গ্লিটজের সঙ্গে আলাপে সাঁতাওয়ের গল্প আর প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন সুমন।

তিনি বলেন, নানা প্রকল্পের নাম করে নদীর উপর একের পর এক বাঁধ নির্মিত হয়েছে। উজানে বাঁধের কারণে ভাটি অঞ্চল পরিণত হচ্ছে মরুভূমিতে। কৃত্রিম সেচে চাষাবাদ হচ্ছে, কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণ থাকছে গ্রামের প্রভাবশালীদের হাতে। সাধারণ কৃষক সেখানে অসহায়। আবার ভরা বর্ষায় বাঁধ খুলে দেওয়ায় কৃষকের ফসল ও গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে।

“কৃষকের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে রমরমা ব্যবসা করছে দাদন ব্যবসায়ী এবং ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থাগুলো। এক দিকে ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তির চাপ, অন্য দিকে কৃষির জন্য বৈরী পরিবেশ। গ্রাম ছেড়ে কৃষক শহরে যাচ্ছে, হাত দিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। হয়ত দুর্ঘটনায় লাশ হয়ে ফিরে আসছে গ্রামে।”

এমন সব চলমান ঘটনার বিপরীতে থাকা একজন সাধারণ কৃষক ফজলু। মা-বাবাহীন ফজলু বিয়ে করে উজানের গ্রামের মেয়ে পুতুলকে। পুতুলের একাকীত্ব দূর করতে তাদের পরিবারে নতুন সদস্য হয়ে আসে একটি গরু। ফজলু, পুতুল আর তাদের গরুকে ঘিরে এগোতে থাকে সাঁতাওয়ের গল্প।

প্রকৃতি ও ঋতুচক্রের প্রভাব সঠিকভাবে তুলে ধরতে মোট ছয় লটে এর শুটিং হয় জানিয়ে সুমন বলেন, যে জমির ধান লাগানোর দৃশ্য ধারণ হয়েছে সেই জমিরই ধান কাটার সময় আবার শুটিং হয়েছে।

সিনেমাটার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হবে বাংলাদেশে। এছাড়া বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে জমা দেওয়া হচ্ছে। আমন্ত্রণ পেলে ইন্টারন্যাশনাল প্রিমিয়ার হবে কোনো এক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে।

গণঅর্থায়নে সিনেমা বানানোর কারণ জানতে চাইলে খন্দকার সুমন বলেন, “আমরা শুরুতে সিনেমার গল্প নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়েছি। বাণিজ্যিক উপাদান না থাকায় তারা এই সিনেমার পেছনে লগ্নী করতে আগ্রহ দেখাননি। পরে ১৫৫৯ জন মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন একেকজন।

“আরও জানান ৩৭৫ জন প্রকাশ্য অনুদানের মাধ্যমে এই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বাকিরা নাম প্রকাশে অনিচ্ছার কথা জানিয়েছেন।”

সিনেমাটি নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে সুমন বলেন, “আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। এর আগে আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য পৌনঃপুনিক যারা দেখেছেন প্রশংসা করেছেন। আমি আশা করি গণমানুষের এই সিনেমাটা গণমানুষ দেখবেন।”

সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল সেন্টু ওটিটি প্লাটফর্মে ‘বাংকার বয়’, ‘শুক্লপক্ষ’ ও ‘কারাগারে’ অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন বলে জানান সুমন।

সেন্টু ছাড়াও আইনুন পুতুল, ফজলুল হক, সাক্ষ্য শহীদ, সিফাত সৈকত অভিনয় করেছেন এ সিনেমায়। কয়েকজন থিয়েটারকর্মী ও স্থানীয় শিল্পীকেও সাঁতাওয়ে দেখা যাবে।

সিনেমার সহকারী পরিচালক ছিলেন মাসুদ রানা নকীব।