চট্টগ্রাম বন্দর ফ্লাইওভার: যেখানে কভার্ড ভ্যানের ‘অপেক্ষায়’ থাকে চোরেরা

চট্টগ্রামে কভার্ড ভ্যান থেকে মালামাল চুরির অন্যতম রুট হয়ে উঠেছে বন্দর ফ্লাইওভার; যেখানে সুযোগ পেলেই চলন্ত গাড়ি থেকে আমদানি-রপ্তানি পণ্য সরিয়ে ফেলছে কয়েকটি চক্র।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Jan 2022, 04:15 PM
Updated : 14 Jan 2022, 04:15 PM

ফ্লাইওভারের মুখে গাড়ির গতি ধীর হওয়ার অপেক্ষায় থাকা চোর চক্র মুহূর্তের মধ্যেই ভ্যানের পেছনে উঠে বসে; ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তালা ভেঙ্গে পণ্য ফেলে দেয় নিচে।

মালামাল চুরির এমন কিছু অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ চুরির সঙ্গে জড়িত অন্তত তিনটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে।

চক্রগুলোর কয়েকজন সদস্য ইতোমধ্যে পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে বলে জানান নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (বন্দর) নোবেল চাকমা।

বেশ কিছু দিন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী রপ্তানি পণ্যবাহী যান থেকে পণ্য চুরির মধ্যে বন্দর ফ্লাইওভারের কাছে   

বাংলাদেশ কভার্ড ভ্যান, ট্রাক, প্রাইম মুভার পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশনের বন্দর বিষয়ক সম্পাদক শামসুজ্জামান সুমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এমপিভি গেইট দিয়ে বের হওয়া কভার্ড ভ্যানগুলো ফ্লাইওভারে ওঠার পথে চোর চক্রের খপ্পরে পড়ে।

“ওই সময় ভ্যানগুলোর গতি কম থাকায় চোর দলের সদস্যরা পেছনে উঠে দরজার তালা কেটে মালামাল চুরি করে।“

তিনি জানান, প্রতি মাসে মালিক সংগঠনের নেতারা এ ধরনের বেশ কিছু অভিযোগ পেলেও মামলা হয় হাতেগোনা কয়েকটি।

এসব ঘটনায় চালকরা মামলা করতে চান না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মামলা করলে নানা ধরনের হয়রানি হতে হয় চালকদের। আবার মালামালগুলোও পাওয়া যায় না। তাই বেশিরভাগ সময়েই চুরির পরও বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়।“

চুরির কৌশলের বিষয়ে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, চক্রটির কিছু সদস্য ফ্লাইওভারের উপরে, কেউ নিচে অবস্থান নেন। আর একজন সিএনজি অটোরিকশা চালক ফ্লাইওভারে গাড়ির পরিস্থিতি এবং পুলিশি টহলের বিষয়গুলো নজরদারি করে। পরিস্থিতি বুঝে অন্যদের সংকেত দিলেই তারা চুরির প্রস্তুতি নেন। আবার তাদের মধ্যে কেউ ফ্লাইওভারের নিচে অবস্থান করেন।

চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তাররা জানান, ফ্লাইওভারে কভার্ড ভ্যান ওঠার সময় তাদের মধ্যে একজন পেছনে উঠে যায়। আর দলের অন্য কেউ পেছনের গাড়িকে ফ্লাইওভারে জট লেগেছে বলে অপেক্ষা করতে বলে।

এ ফ্লাইওভার দিয়ে প্রতিদিন বন্দরে আসা যাওয়া করে বিপুল সংখ্যক পণ্যবাহী যান; যেগুলোর বেশির ভাগই কর্ভাড ভ্যান।

এর মধ্যেই ভ্যানে উঠে যাওয়া ব্যক্তি মালামাল বের করে ফ্লাইওভার থেকে বন্দর আবাসিক এলাকার গেইটের দিকে নির্জন স্থানে পণ্য ফেলে দেয়।

গত ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের বন্দর থানায় মো. রাজা নামে এক কভার্ড ভ্যান চালকের সহকারীর করা একটি মামলায় অভিযোগ করা হয়, গত ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিটিক্যালস নামে একটি ওষুধ কোম্পানির জন্য আমদানি করা ১৩ প্লেট পিভিসি রোল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাজীপুরে যাচ্ছিল তাদের কভার্ড ভ্যান।

ভ্যানটি ফ্লাইওভার দিয়ে নামার সময় বন্দর দক্ষিণ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন স্থানে দরজার তালা ভেঙ্গে দুই কার্টন পিভিসি রোল নিয়ে যায়। পেছন থেকে এক জন দৌড়ে পালানোর সময় চালক লুকিং গ্লাসে দেখতে পায় বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।

সিএমপির গোয়েন্দা কর্মকর্তা নোবেল চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারাও বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছেন। এসব বিষয়ে তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ।

এদিকে গত ১৩ ডিসেম্বরের চুরির ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে চোর চক্রের কয়েক সদস্য। পাশাপাশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে চোরাই মালামালের ক্রেতা এক ব্যবসায়ীকে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- মো. ওবায়দুল্লাহ, মো. নাজিম, মনির হোসেন ওরফে কালা মনির এবং চোরাই মালামালের ক্রেতা আব্দুল মালেক।

গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে এডিসি নোবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে ওবায়দুল্লাহ ও কালা মনির সরাসরি চুরির সঙ্গে জড়িত। আর সিএনজি অটোরিকশার চালক নাজিম চুরির আগে ফ্লাইওভার এলাকায় নজরদারি করে।

তাদের মধ্যে মনিরকে অন্য একটি মামলায় বন্দর থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। অন্যরা এর আগে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।

মনিরকে ১৩ ডিসেম্বরের চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে বলে জানান এ গোয়েন্দা।

তিনি জানান, ওবায়দুল্লাহ ও মনিরদের মতো আরও একাধিক গ্রপের তথ্য তারা পেয়েছেন, যারা বন্দর থেকে বের হওয়া কভার্ড ভ্যান থেকে মালামাল চুরি করে। প্রতিটি দলেই পাঁচ থেকে ছয় জন করে লোক আছে।

গোয়েন্দা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, চক্রগুলোর একটিতে আছে আজাদ ও তার ভাই গ্রেপ্তার ওবায়দুল্লাহ, কালা মনির, সিএনজি অটোরিকশা চালক নাজিম ও জসীম।

অপর একটি দলে আছে নয়ন, হারুণ ওরফে টেডি হারুণ, বিল্ডার হারুণ, মোতাহের, কাশেম ওরফে আন্ডা কাশেম, মো. হাশেম ওরফে আন্ডা হাশেম।

এছাড়া অপর একটি দলে জাম্বু ও বাবু নামে দুই সদস্যের নাম পাওয়া গেছে।

অতিরিক্ত উপ কমিশনার নোবেল জানান, চক্রগুলো নজরে নির্দিষ্ট কোনো মালামাল থাকে না। কভার্ড ভ্যানের পেছনের তালা কাটার সুযোগ পেলেই মালামাল চুরি করে। পরে যে স্থানে যে ধরনের মালামাল বেচাকেনা হয়, সেখানে নিয়ে সেগুলো বিক্রি করে দেয়।

চক্রটি গত ১৩ ডিসেম্বর চুরি করা মালামালগুলো আন্দরকিল্লা এলাকার মালেকের কাছে বিক্রি করেছে বলে জানান তিনি।