চট্টগ্রামে রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা: লাইনম্যানের বিরুদ্ধে ‘গাফিলতির’ অভিযোগ

চট্টগ্রামে লেভেল ক্রসিংয়ে একটি অটোরিকশায় ট্রেনের ধাক্কায় তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা গেইটম্যানের ‘গাফিলতির’ অভিযোগ করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2021, 07:50 PM
Updated : 5 Dec 2021, 01:45 PM

শনিবার সকালে খুলশী থানা এলাকায় জাকির হোসেন রোডের ঝাউতলা রেল ক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনায় একজন পুলিশ কনস্টেবলসহ তিনজন নিহত এবং আটজন আহত হন।

এ ঘটনার তদন্তে আলাদা দুটি কমিটি করেছে রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে খুলশী থানা ও রেলওয়ে পুলিশ বলছে, ট্রেন আসার সময় যান চলাচল ঠেকাতে সড়কের একপাশে লোহার বার দিয়ে আটকানো হলেও অপর পাশে খোলা ছিল।

খুলশী থানার ওসি মো. শাহীনুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাদের বলেছে ফয়’স লেকমুখী সড়কের দিকে রেল গেইটে লোহার বার ফেলা ছিল না।

“এসময় সিএনজি অটোরিকশাটি নিয়ম অমান্য করে লাইনে উঠে পড়ে। তবে সড়কের বিপরীত দিকের লোহার বার ফেলা ছিল। এটা গেইট ম্যানের গাফিলতি কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখছি।”

ঘটনার পর থেকে ওই ক্রসিংয়ের গেইটম্যান আলমগীর ভুইয়া পলাতক আছেন বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ওসি সারোয়ার কামাল বলেন, “গেইটম্যান ঠিকভাবে লোহার বার ফেলেনি বলে আমরা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি। এসময় নিয়ম না মেনে অটোরিকশা ও বাস লাইনে উঠে পড়ে।”

দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওসি শাহীনুজ্জামান বলেন, “অটোরিকশাটিকে একটি বাস পেছন থেকে প্রথমে ধাক্কা দেয়। এরপরই অটোরিকশায় নাজিরহাট থেকে চট্টগ্রাম স্টেশনমুখী ডেমু ট্রেনের ধাক্কা লাগে।

“এসময় বাস এবং অটোরিকশাটি ট্রেনের সঙ্গে বেশ কিছুদূর ছেঁচড়ে চলে যায়। সড়কে থাকা অপর একটি সিএনজিচালিত লেগুনাও তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় দোকানি মোহাম্মদ আরিফ বলেন, “ক্রসিংটার গেইটম্যান একদিকের বার ফেললেও অপরদিকেরটা ফেলেননি। সেকারণেই জিইসি থেকে ফয়সলেকমুখী গাড়িগুলোর বেশ কয়েকটা লাইনের উপর চলে আসে। লোহার বার ফেলা ফেলা থাকলে এ দুর্ঘটনা হত না।”

পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদিকুর রহমান জানান, ধাক্কায় অটোরিকশাটি ছিটকে পড়লে একজন পুলিশ কনস্টেবল ঘটনাস্থলেই মারা যান। এছাড়া হাসপাতালে আরও দুই জনের মৃত্যু হয়।

এদের মধ্যে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ট্রাফিক উত্তর বিভাগের কনস্টেবল মনির হোসেন (৪৫) নগরীর বায়েজিদ এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। তার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে।

অপর দুজন হলেন- পাঁচলাইশ থানার হামজারবাগ এলাকার সোহরাব হোসেনের ছেলে সৈয়দ বাহাউদ্দিন আহমেদ (৩০) এবং পাহাড়তলী এলাকার মোহাম্দ করিমের ছেলে সাদরাজ উদ্দিন (১৮)।

সাদরাজ নগরীর পাহাড়তলী কলেজে এইচএসসিতে পড়ছিলেন।

দুর্ঘটনায় আহত আরও আটজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান পুলিশ পরিদর্শক সাদিকুর রহমান।

পুলিশ ও রেলওয়ের আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি

চট্টগ্রাম রেল পুলিশের এসপি মোহাম্মদ হাসান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্ঘটনা তদন্তে আমাদের নিজস্ব একটি কমিটি করেছি। কমিটিকে তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।”

তিন সদস্যের এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে রেল পুলিশ চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল গফুরকে।

দুর্ঘটনার সময় রেলক্রসিংয়ে লোহার বার ফেলা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে এসপি হাসান বলেন, “আমরা অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য পেয়েছি। তবে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর সঠিক কারণ বলা যাবে।”

এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে পূর্বাঞ্চলের জিএম জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

অ্যাসিস্টেন্ট ট্রাফিক অফিসারকে (এটিও) ওই কমিটির প্রধান করা হয়েছে জানালেও কমিটির সদস্য কাদের করা হয়েছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য তিনি দিতে চাননি।

দুর্ঘটনার সময় গেইটম্যান লোহার বার দিয়ে সড়কে যান চলাচল আটকেছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তদন্ত কমিটি হয়েছে, তারাই তদন্ত করে এসব বের করবে।”

দুর্ঘটনার পরপর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিআরএম তারেক মোহাম্মদ শামস তুষার বলেন, “বাস ও সিএনজি অটোরিকশা নিয়ম লঙ্ঘন করে লাইনে উঠে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। লাইনেরও কোনো সমস্যা ছিল না।”

এখন কে পাইলট হবে?

দুর্ঘটনায় হতাততের স্বজনদের আর্তনাদে শনিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও মর্গ এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।

হাসপাতালের মর্গে ছুটে আসা পুলিশ কনস্টেবল মনির হোসেনের মেয়ে মাহমুদা আহাজারি করে বলেন, ‘‘আব্বু কেন তুমি এভাবে চলে গেলে। আমার ভাই কাকে আব্বু ডাকবে আল্লাহ? আমার আম্মারে কে দেখবে?”

মনির হোসেনের দুই মেয়ে ও এক ছেলে, বড় মেয়ে মাহমুদার বিয়ে হয়েছে। আরেক মেয়ে আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

দুর্ঘটনায় নিহত কলেজছাত্র সাদরাজের বাবা মোহাম্মদ করিম হাসপাতালের মর্গে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “দুই ছেলের মধ্যে বড় সাদরাজ, সে পড়ালেখা শেষে পাইলট হবে বলেছিল। এখন কে পাইলট হবে!”

আরও পড়ুন