সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিন: অনুপম সেন

সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এক সমাবেশ থেকে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সমাজ বিজ্ঞানী অনুপম সেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2021, 02:34 PM
Updated : 18 Oct 2021, 02:36 PM

পূজা মণ্ডপ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার প্রতিবাদ সোমবার বিকালে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড়ে সমাবেশে তিনি এ আহ্বান জানান।

‘সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাব-মানবতা মুক্তি পাক’ স্লোগান নিয়ে এই বিক্ষোভের আয়োজন করে ‘সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম’।

অনুপম সেন বলেন, “আমি দাবি করছি, ১৯৮৮ সালে যে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেছিল এরশাদ তা বাদ দিতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানকে একটি সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক সংবিধান হতে হবে।

“যদি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকে, তবে অন্যরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। যদি বলেন সবাই দেশের নাগরিক, তবে তো রাষ্ট্রধর্ম থাকতে পারে না।”

ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি ধরে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তার উল্টোদিকে যাত্রা শুরু হয়। তার ধারাবাহিকতায় সামরিক শাসক এরশাদ সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী এনে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেন সংবিধানে।

এরপর সংবিধান অনেকবার সংশোধন হলেও রাষ্ট্রধর্মের বিধানটি রয়েই গেছে।

অনুপম সেন বলেন, “বাংলাদেশের এক সম্প্রদায়ের নাগরিকদের দুর্গাপূজাকে নানাভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। আমি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। প্রশ্ন করতে পারেন, কী করেছেন আপনারা?

“আমরা একটি আধুনিক বাংলাদেশ করতে চেয়েছিলাম। মাত্র ১০ মাসে বঙ্গবন্ধু এক অসাধারণ সংবিধান দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, (বাংলাদেশ) হিন্দুর বা মুসলমানের নয়। বঙ্গবন্ধু সেদিন ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেশে প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ ধর্মকে ব্যবহার করতে পারবে না।”

সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে আওয়ামী লীগের তৎপরতায়ও হতাশা প্রকাশ করেন অনুপম সেন।

তিনি বলেন, “আজ ছাত্রলীগকে মাঠে দেখি না। বসে বসে বিবৃতি দেন। এত বড় সংগঠন আওয়ামী লীগের। কত অঙ্গ সংগঠন। তারা কেন নেই রাস্তায়?

“প্রধানমন্ত্রী একা। তিনি বলেন, শাস্তি হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তদন্ত চলছে। এতদিন কেন তদন্ত চলবে? অবিলম্বে তদন্তের খবর দিন। শাস্তির ব্যবস্থা নিন। প্রতিদিন হামলা হচ্ছে। কালও রংপুরে হামলা চালানো হয়েছে। প্রশাসন কী করছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেখান কাদের ধরা হয়েছে। আইনের আওতায় আনুন।”

গণমাধ্যমকেও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “মিডিয়া এতদিন অল্প অল্প করে দিয়েছেন। সেটা পাকিস্তান আমলে হয়েছে। এখন বলুন। সব কাগজে হেডিং দিন- ‘বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও’। প্রতি টেলিভিশনে বলুন- বাংলাদেশ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াও।”

সমাবেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, “আজকের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, কিন্তু এটা বঙ্গবন্ধুর দল নয়।

“সংবিধানে বাংলাদেশ আছে, পাকিস্তানও আছে। বঙ্গবন্ধু আছেন, জিন্নাহ সাহেবও আছে। দলে অনেক মোশতাক। মুজিব কোট গায়ে দিয়ে পাকিস্তানি প্রেতাত্মার সাথে মেলবন্ধন করে এ হামলাগুলো করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক দৃষ্টি হতভাগ্য জনগণের কাছে পৌঁছায় না।”

প্রবীণ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে দেশের সব মানুষকে এক হওয়ার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “পুলিশ বিডিআরের উপর নির্ভর করে হামলা থেকে রক্ষা মিলবে না। সকল রাজনৈতিক দল, দেশপ্রেমিক জনগণ, ধর্মপ্রাণ আলেম-ওলামা, পুরোহিত-যাজককে সংঘবদ্ধভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশে দাঁড়াতে হবে।”

তা নাহলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বড় বিপর্যয়ে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন রানা দাশগুপ্ত।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

কবি আবুল মোমেন বলেন, “লজ্জায় অধোবদন। যখনই সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে, বুঝতে হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় দায়িত্ব পালন করেনি। আজ কোনো রাজনৈতিক দল মাঠে নামেনি।

“১৯৪৭ থেকে হিন্দুদের উপর বারবার হামলার প্রধান কারণ সম্পত্তি দখল। ঘটনার সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে সব রাজনৈদিক দল মিলেমিশে যায়।”

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষা ব্যবস্থাসহ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার উপর জোর দেন তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, “সরকারের কাছে আশা করে লাভ নেই। এলাকায় এলাকায় সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলতে হবে। পাড়া মহল্লায় কমিটি করতে হবে।”

খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, “যারা আজ হামলার সমর্থন দিচ্ছেন, তারাও রক্ষা পাবেন না। তারা অন্ধকারের মানুষ। এরা কাউকে ছাড়বে না।

“কিন্তু যাদের আমরা সংসদে পাঠিয়েছি, তারা কী করেছেন? রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কী করে অবহেলা করে? কারও জন্য বসে থাকব না। আমরা মাঠে নামব, আন্দোলন করব।”

আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন নারী নেত্রী নূরজাহান খান, সিপিবি জেলা সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো ইউনুচ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা কল্পনা লালা, নারীনেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু, গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের সমন্বয়ক শরীফ চৌহান, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো জাহাঙ্গীর, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল, ওমর কায়সার ও হাসান ফেরদৌস, মহিলা পরিষদ চট্টগ্রামের সভানেত্রী লতিফা কবীর, জাসদ নেতা জসিম উদ্দিন বাবুল, সঙ্গীত শিল্পী শ্রেয়সী রায়, চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি শৈবাল চৌধুরী, নাট্যজন শুভ্রা বিশ্বাস।