‘কথা নয়, কাজ’ দেখাতে চান সিএমপি কমিশনার তানভীর

বন্দর নগরীর পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে বাহিনীর সদস্যদের সেবাপরায়ণ করে তোলার উপর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়ার কথা জানালেন সালেহ মোহাম্মদ তানভীর।

চট্টগ্রাম ব্যুরোউত্তম সেনগুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2020, 05:27 AM
Updated : 1 Oct 2020, 06:51 AM

থানায় গেলে সেবাপ্রার্থীরা বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়, টাকা ছাড়া কিছুই হয় না, বদলি বাণিজ্যসহ এমন নানা অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের।

সেই ধারা থেকে পুলিশকে বের করে আনাই লক্ষ্য ঠিক করেছেন তানভীর, যা সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “পুলিশের বিষয়ে আমরা কড়া বার্তা দিয়েছি। একাধিকবার বিভিন্ন ইউনিটের সাথে বৈঠক করেছি তাদের পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয়েছে জনগণের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে তদন্ত হবে। যদি জনগণের সাথে খারাপ ব্যবহারের প্রমাণ আসে তাহলে শাস্তির কোন মাফ নেই।”

গত মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর সিএমপিতে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা আনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন তানভীর।

এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি এমন কিছু বলতে চাই না, যেটা আমাকে হাইলাইটস করে। আমি কী করি না করি সেটা আমার কাজ বলবে। আমি চাই আপনারাই লিখবেন কী হয়েছে।”

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ৩০তম কমিশনার হিসেবে গত ৭ সেপ্টেম্বর যোগ দেন তানভীর।

তিনি এর আগে দেড় বছর চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারেরও দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বদলি হয়ে চট্টগ্রাম ছাড়লেও পদোন্নতির পর সিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে পুনরায় এসেছেন বন্দরনগরীতে।

থানায় ক্যামেরা

যোগদানের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তানভীর বলেছিলেন, দালালদের দৌরাত্ম্য রুখতে এবং হয়রানি রোধে বিভিন্ন থানায় ক্যামেরা লাগানো হবে। তার নজরদারি হবে সিএমপি সদর দপ্তর থেকে।

তার অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “থানাগুলোতে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য থানাগুলোতে ক্যামেরা লাগানোর নেটওয়ার্ক প্ল্যান চলছে। কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হবে। সময় লাগলেও তা করা হবে।”

পাশাপাশি সিএমপি সদর দপ্তরে ‘অভিযোগ কেন্দ্র’ স্থাপনের কথাও জানান তিনি।

“একটা কমপ্লেইন সেল খুলব। জনগণ সেবা না পেলে এখানে কমপ্লেইন করতে পারবেন। থানায় যারা সেবা নেওয়ার জন্য যাবেন, তাদের কোনো অভিযোগ থাকলে তা সংগ্রহ করে আমরা মনিটর করব।”

পুলিশে মাদকাসক্তি

মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান সিএমপি কমিশনার তানভীর।

তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট চলছে। টেস্ট হলেই অপরাধী না। টেস্টের ফলাফল আসলেই গণমাধ্যমে জানানো হবে।

“যিনি মাদকাসক্ত তিনি স্বাভাবিক চলাফেরা করেন না। তার লাইফটা থাকে ইরেগুলার। তার শরীরটা ইরেগুলার। ডিউটিকালীন সময়ে তার পারফরম্যান্স থাকে অস্বাভাবিক। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বলেছি, সেগুলো মার্ক করতে। সেরকম কিছু নাম আমরা সংগ্রহ করেছি। ফেইজ বাই ফেইজ আমরা টেস্ট করাচ্ছি।”

বদলি বাণিজ্য

বিভিন্ন থানায় পদায়নের ক্ষেত্রে বদলি বাণিজ্যের একটা অভিযোগ আছে পুলিশের মধ্যে। মোটা অঙ্কের টাকা উৎকোচ দিয়ে সিএমপিতেও বড় থানায় পদায়নের গুঞ্জন আছে।

তানভীর বলেন, “পদায়নের বিষয়ে পারফরমেন্স ইভোলোয়েট করার চেষ্টা করছি। অফিসারদের ভালো খারাপ এবং দুর্বল দিকগুলো বিবেচনা করব। আমাদের যারা তথ্য দিয়ে সহায়তা করে তাদের সাথে আমরা কথা বলেছি। আমরা চেষ্টা করছি সঠিক মানুষকে সঠিক স্থানে পদায়নের। যোগ্য লোককে তার যোগ্যতম পুরস্কার দেওয়ার।”

কিছু পুলিশ পরিদর্শকই কেন ঘুরে ফিরে বিভিন্ন থানায় ওসির দায়িত্বে থাকেন সিএমপি’তে- এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয় সিএমপি কমিশনারের কাছে।

তিনি বলেন, “এমন কোনো নিয়ম নাই, একজন অফিসার পরপর ওসি হতে পারবে না। তবে এক জন অফিসার ১২ বছর পর্যন্ত অফিসার ইনচার্জ হিসেবে কাজ করতে পারবে বলে আউট লাইন আছে।

“একটা নিয়ম আছে একজন ওসি এক স্টেশনে দুই বা তিন বছর থাকতে পারেন। দুই বছরের বেশি হলে তাকে বদলি করা যাবে। তিন বছর হলে সাধারণত বদলি করা হয়ে থাকে। সে অফিসার যদি জনগণের কাছে সত্যি জনপ্রিয় হয় বা সামনে কোন নির্বাচন বা কিছু থাকে সেক্ষেত্রে আরও কিছুদিন রাখা যায়।”

“আমি পার্সোনালি ফিল করি, সে যদি যোগ্য হয়, তাকে দিয়ে যদি মানুষের উপকার হয়, জনগণের কাছ থেকে যদি সে ধরনের ফিডব্যাক পাই, তাহলে তাকে আমরা প্রয়োজনে রাখব। যদি এমন হয়ে থাকে সে জনবান্ধব না, তাকে দিয়ে মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না, তাহলে তাকে দুই বছর কেন? যেকোন সময় বদলি করা যেতে পারে,” বলেন তিনি।

তানভীর দায়িত্ব নেওয়ার ২২ দিনের মধ্যে সিএমপির দুই থানায় ওসি এবং আরও এক থানায় পরিদর্শক বদলি হয়েছে। সামনে আরও রদবদল আসছে কি না জানতে চাওয়া হয় তার কাছে।

“আমি যদি বলি আরও হবে না, তাও ভুল, আবার যদি বলি এখনই হবে, তাও আমার জানা নেই। এটা রুটিন প্রক্রিয়া। যে দুই ওসি বদলি হয়েছে তাদের মধ্যে এক জন আগেই পুলিশ সদর দপ্তরে বদলির আদেশ হয়েছে। আরেকজন আবেদন করেছে তিনি অফিসার ইনচার্জ হিসেবে থাকতে চান না ।”

শুদ্ধি অভিযান

 তানভীর কমিশনারের দায়িত্ব নেয়ার পর সিএমপি’তে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু হয়েছে বলে গুঞ্জন উঠেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কক্সবাজারে ঢালাও বদলি হচ্ছে, মানুষ মনে করছে এখানেও হয়ত হবে কিনা; এটা আমার জানা নাই পুরোটা সদর দপ্তরের এখতিয়ার।

“তবে এটা ঠিক প্রত্যেকে চায়, তার মতো করে টিম সেট-আপ করার জন্য। যারা ভালো কাজ করবে তারাই আমার টিমের সদস্য। তাদেরকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দিতে চাই, যারা এর যোগ্যতা রাখে। সর্বোপরি যার দ্বারা মানুষের উপকার হবে। অন্য অফিসারদের ক্ষেত্রেও যে আমাকে ভালো আউটপুট দিতে পারবে তাকেই আমরা পদায়ন করছি।”

‘কিশোর গ্যাং’

চট্টগ্রামে ‘কিশোর গ্যাং’য়ের উৎপাত নিয়ে কোনো অভিযোগ পুলিশ পায়নি জানালেও এনিয়ে সচেতন আছেন বলে জানান সিএমপি কমিশনার তানভীর।

তিনি বলেন, “কিশোর গ্যাং শব্দ দুটোই ‘সেনসেটিভ’। কিশোররা খুব স্পর্শকাতর। দেশের আইন অনুযায়ী কিশোরদের শিশু হিসেবে ডিক্লায়ার করা আছে। কিশোরদের শিশুর মতো করে ট্রিট করতে হবে। তাকে প্রথমেই অপরাধী বলে ফেলা হলে সে অপরাধী হয়ে যাবে।”

তানভীর বলেন, “প্রাথমিক পর্যায়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের ৩০ জনকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলব, বোঝাবো।”

তবে কিশোর অপরাধীদের চেয়ে এদের পেছনে যারা আছে তারাই পুলিশের মূল লক্ষ্য বলে জানানতিনি।

কিশোরদের মোটর সাইকেল কিংবা প্রাইভেটকার চালানো নিয়ে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে অভিযানের কথাও জানান তিনি।

“আমরা চাই অ্যাডভেঞ্চারের নামে কোন শিশু-কিশোর যেন দুর্ঘটনায় না পড়ে।”

রাজনৈতিক চাপ

বন্দর নগরীর রাজনীতিতে বিভক্তির কারণে নানা সময়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠে পরিস্থিতি। তাদের নিয়ন্ত্রণে নানামুখী চাপ পুলিশের উপর থাকে বলেও গুঞ্জন আছে।

চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনে কোনো রাজনৈতিক চাপ অনুভব করছেন কি না- জানতে চাওয়া হয় তানভীরের কাছে।

জবাবে তিনি বলেন, “এখনও তেমন কিছু ঘটেনি। আমি শুধু বলতে চাই আমি সোজা থাকব, পথে যে লাইন ক্রস করবে বা আইনের সীমা অতিক্রম করবে, তিনি আমাদের চোখে অপরাধী। তার ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে যেটা হওয়ার সেটা হবে।”

“আমি কোনো গ্রুপে বিশ্বাস করি না। আমার কাছে একটাই কথা- হয়ত সে অপরাধী, না হয় না,” বলেন সিএমপি কমিশনার।

বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পাওনা টাকা আদায়, জায়গা-জমি দখল-বেদখলেরও বিভিন্ন আবদার আসে পুলিশের কাছে। যেগুলো পূরণ করতে গিয়ে নানা রকম আলোচনা সমালোচনায় পড়তে হয়।

পুলিশ সদস্যদের তা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান সিএমপি কমিশনার তানভীর।

“আমি কঠোরভাবে বলেছি, পুলিশ যেন জমি বা টাকা উদ্ধার করে দেওয়ার কোনো কাজ না করে। এটা আইনগত বিষয়। সেটার জন্য আপনারা আদালতে যান। আদালতের আদেশের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ কাজ করবে।”