নিহত কিশোরের স্ত্রী লুসিয়ানা গোমেজও জানতেন না চট্টগ্রামে স্বামীর মৃত্যুর খবর। চারদিন পর তারা জানতে পারেন কিশোর মারা গেছেন।
বাবার স্মৃতি বলতে কয়েকটি ছবিই সম্বল মেয়ে পাপড়ি গোমেজের। বাবা ছাড়া বেড়ে ওঠার কষ্টের দিনগুলো এখনও কাঁদায় তাকে।
১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানের পাশে শেখ হাসিনার সমাবেশের আগে পুলিশের গুলিবর্ষণে যে ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের একজন কিশোর গোমেজ।
৩১ বছরেরও বেশি সময় পর চট্টগ্রামের আদালত এই হত্যামামলার রায় দেয়, যাতে পাঁচ পুলিশ সদস্যের ফাঁসির আদেশ হয়েছে।
রায়ের দিন পাপড়ি গোমেজের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। তিনি এখন কুমিল্লার রয়েছেন।
পাপড়ি বলেন, তার জন্ম ১৯৮৮ সালের ২২ জানুয়ারি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার দেশান্তরকাঠি গ্রামে মামার বাড়িতে।
পাপড়ি বলেন, বাবার কোনো খোঁজ না পেয়ে জ্যাঠা বাদল গোমেজ ও চপল গোমেজ তাকে খুঁজতে বের হন।
কিশোরের ভাই চপল গোমেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোতোয়ালি মোড়ে তুষার স্টুডিও নামে একটি স্টুডিও ছিল। তিনি ওই ঘটনার ছবি তুলেছিলেন। তার কাছে একটি ছবি দেখতে পাই। সেটা আমার ভাইয়ের ছবি। ছবিতে দেখি ভাই তখনও জীবিত।
“এরপর আমরা শুরুতে জেনারেল হাসপাতালে যাই। সেখানে ভাইকে না পেয়ে যাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভাইয়ের নাম এথলেবার্ট গোমেজ বললে একজন চিকিৎসক চিনতে পারেন। কারণ ভাইয়ের গলায় তখনও ক্রশ ছিল।”
মরদেহ শনাক্ত করলেও তা তাদের নিতে দেওয়া হয়নি বলে জানান চপল।
চপল বলেন, “আমরা শুধু শেষবার দেখেছি। কিছুই করতে পারিনি। ভাইকে আমাদের দেয়নি। পুলিশ নিয়ে গেছে। শ্মশানে নিয়ে পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে।”
এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন বলেন, এইচ এম এরশাদের শাসনামলে সেদিন গুলিতে নিহতদের কারও লাশ পরিবারকে দেওয়া হয়নি । হিন্দু-মুসলিম নির্বিচারে সবাইকে বলুয়ার দীঘি শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
লাশ না পেয়ে ভাইয়ের স্মৃতি রক্ষায় পাথরঘাটা জপমালা রানি গির্জা প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতি সৌধ করেছেন কিশোর গোমেজের স্বজনরা।
পাপড়ি বলেন, “আমি কোনোদিন বাবাকে দেখিনি। চার দিন পর মামারা জ্যাঠাদের সাথে যোগাযোগ করলে জানতে পারেন আমার বাবা মারা গেছেন।
“আমার মা আমাকে নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। চট্টগ্রামে আমরা মা-মেয়ে অনেকে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। অনেক কষ্টে মা আমাকে মানুষ করেছেন। ২০০৫ সালে এসএসসি পাসের পরই আমার বিয়ে হয়। এরপর মাস্টার্স পাস করেছি। ২০০৬ সালে বিচার না দেখেই আমার মা মারা যান।”
পাপড়ি বলেন, “বাবার মৃত্যুর পর অনেকে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। শহীদের সন্তান হিসেবে বিচার পেয়ে খুশি। কিন্তু আমাদের পরিবারের জন্য কিছুই করা হয়নি। এখন কুমিল্লায় একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করি।”
চপল বলেন, “আমার ভাইয়ের মেয়েটি অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার জন্যই এ হামলা হয়েছিল। উনার কাছে আবেদন মেয়েটার যেন একটা সরকারি চাকরি হয়। সে একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করে।”
তিনি বলেন, “৩১ বছর ধরে বিচার শেষ হচ্ছিল না। তাই রায় শুনে খুব খুশি হয়েছি। আমরা চাই, রায় যেন অতি দ্রুত কার্যকর হয়। দেরি হলে আবার দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হতে পারে।”