গত বছরের মার্চ মাসে ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) তৈরির কাজ শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশে প্রথমবারের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের একটি ভবনে বিভিন্ন বিষাক্ত সাপ লালন করা হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে ৫টি বিষাক্ত সাপ দিয়ে এই ভেনম রিসার্চ সেন্টার শুরু হলেও সোয়া এক বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে এই গবেষণাগারে সাপের সংখ্যা ঠেকেছে ৬০টিতে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সাপের বিষ সংগ্রহের কাজও।
এখন দেশে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় ভারতে তৈরি প্রতিষেধক ব্যবহার হয়ে আসছে বলে জানান ভেনম রিসার্চ সেন্টারের মূল দায়িত্বে থাকা চমেক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয়।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা অনেক আগে থেকেই আছে। ১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে ভারতে অ্যান্টিভেনম তৈরি শুরু হয়। এদেশে সাপে কাটা রোগীর অ্যান্টিভেনম ব্যবহার হয় ভারতের তৈরিগুলো।”
তবে অঞ্চল ভেদে সাপের বিষে অনেক তফাৎ থাকে উল্লেখ করে এই গবেষণাগার প্রধান বলেন, “ভারত ও বাংলাদেশের সাপে কাটা রোগীর অ্যান্টিভেনমও আলাদা হয়। এজন্য হু এর নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্বের সব দেশকে নিজেদের সাপের অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে হবে।”
ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রধান গবেষক ডা. অনিরুদ্ধ বলেন, “কাউকে সাপে কাটলে শরীরে যে বিষ ছড়িয়ে পড়ে তা মূলত বিভিন্ন প্রোটিনের মিশ্রণ। সেটি শরীরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্নভাবে কাজ করে থাকে।”
শরীরে ছড়িয়ে পড়া এই প্রোটিনের কার্যকারিতা নষ্ট করতে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় অ্যান্টিভেনম।
এ প্রকল্পের কো-ইনভেস্টিগেটর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমানে এ সেন্টার থেকে ভেনম সংগ্রহের কাজ চলছে। তবে তা খুবই সামান্য পর্যায়ে।”
গ্লাস ক্যাপিলারি ও গ্লাস বিকার পদ্ধতিতে পালিত সাপগুলো থেকে বিষ সংগ্রহ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্যারাফিনের লেয়ার দিয়ে সাপের কামড়ের অনুভূতি তৈরির মাধ্যমে আমরা বিষ বা ভেনম সংগ্রহ করছি। এছাড়া বিষদাঁতের সাথে লাগিয়ে গ্লাস ক্যাপিলারি পদ্ধতিতে বিষ সংগ্রহ করা হয়।
“দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব ভেনম সংগ্রহ করে রাখা হবে। কম তাপমাত্রায় ভেনম ক্রিস্টাল আকার ধারণ করলে সংরক্ষণ করে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরি হবে।”
ডা. অনিরুদ্ধ বলেন, ‘‘লালন-পালন করা সাপের শরীর থেকে ভেনম সংগ্রহের পর পরীক্ষামূলক ডোজ তৈরি করে ডব্লিউএইচওর নিয়ন্ত্রিত মান পর্যায়ে রেখে তা অন্য কোনো প্রাণী বিশেষ করে উট, ঘোড়া, ভেড়া বা ছাগল জাতীয় প্রাণির শরীরে প্রবেশ করিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে।’’
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে উৎপাদিত অ্যান্টিভেনম পরীক্ষামূলকভাবে মানব শরীরে দেওয়ার মতো পর্যায়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করে ডা. অনিরুদ্ধ বলেন, এটি সফল হলে পরবর্তীতে তা বাণিজ্যিক পর্যায়ে উৎপাদনে যাওয়া যাবে।
বাংলাদেশে সকল বিষধর সাপে কাটা রোগীর জন্য নিরাপদ ও কার্যকরী প্রতিষেধক তৈরি হবে দাবি করে তিনি বলেন, সাপে কাটার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হার আরও অনেক কমে আসবে।
চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগ এ গবেষণার মূল দায়িত্বে থাকলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্স মেন্টর ট্রপিক্যাল মেডিসিন, মেডিসিন টক্সিকোলজি সোসাইটি অফ বাংলাদেশ এবং জামার্নির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সহযোগী হিসেবে আছেন।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্তরা জানান, সাপ শীতল রক্তের প্রাণি অর্থাৎ পরিবেশের সঙ্গে তার দেহের তাপমাত্রা পরিবর্তিত হয়। শীতকালে তারা তেমন বের হয় না। শীত শেষে গরম শুরু হলে তারা তাদের বাসস্থান ছেড়ে বের হয়।
বিশেষ করে দেশের গ্রামাঞ্চলে বর্ষাকালে চাষবাস শুরুর সময় সাপদের দেখা মেলে বেশি এবং তখনই মানুষের সাথে মুখোমুখি হয় বলে সেসময়েই সাপে কাটার ঘটনা ঘটে।
সামুদ্রিকসহ বাংলাদেশে ৯০ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। এর মধ্যে ১৫টি বিষাক্ত প্রজাতি মানুষকে আক্রান্ত করে থাকে।
৫টি সাপ নিয়ে শুরু হলেও পরে এই সব সাপের ডিম থেকে ফুটে বাচ্চা হয়ে সাপের সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও বিষধর সাপ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
চমেক হাসপাতালে ডেন্টাল বিভাগের সাথে লাগোয়া ভবনের নিচতলায় বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি ঘরে এসব সাপ নিরাপদে বড় হচ্ছে।
রিসার্চ সেন্টারে চিকিৎসকদের পাশাপাশি কাজ করছে চবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও এখানে পালিত সাপগুলোর তত্ত্বাবধান করে থাকেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী এসব সাপের দেখভাল করা হয় বিশেষ ব্যবস্থায়।
সাপদের খাওয়ানোর জন্য খাবারও এ প্রকল্পের আওতায় উৎপাদন করা হচ্ছে। আলাদা কক্ষে ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর পালন করা হচ্ছে।
চমেকের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, “সাপগুলোকে ছিদ্রওয়ালা প্লাস্টিকের বক্সে রাখা হচ্ছে। এছাড়া সাপদের বিচরণের জন্য কৃত্রিমভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশও তৈরি করা আছে।
“প্রটোকল মেনে সাপদের ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রাণী খাবার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সাপগুলোকে ধরে ধরে খাওয়ানো হয়।”
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ কাজটি করছে বলে জানান তিনি।