‘কোহলি অপরিণত, তরুণদের আদর্শ হতে পারবে না কখনোই’

রিশাভ পান্তের অসাধারণ সেঞ্চুরি, কিগান পিটারসেনের লড়াই, ম্যাচের উত্তেজনা, সব মিলিয়ে কেপ টাউন টেস্টের তৃতীয় দিনে রোমাঞ্চের রসদ ছিল যথেষ্ট। কিন্তু সব ছাপিয়ে গেল ডিআরএস বিতর্ক। প্রযুক্তিকে সংশয়বিদ্ধ করে বিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুল, রবিচন্দ্রন অশ্বিনরা স্টাম্পমাইকে দৃষ্টিকটুভাবে ফুটিয়ে তোলেন তাদের অসন্তুষ্টি। বিরল এই ঘটনার পর ভারতীয় ক্রিকেটারদের সমালোচনা হচ্ছে নিজ দেশ থেকে শুরু করে ক্রিকেট বিশ্বের নানা প্রান্তে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Jan 2022, 06:16 AM
Updated : 14 Jan 2022, 09:03 AM

চতুর্থ ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার রান তাড়ায় ২১তম ওভারের ঘটনা সেটি। অশ্বিনের বলে ডিন এলগারকে এলবিডব্লিউ দেন আম্পায়ার মারাইস ইরাসমাস। রিভিউয়ে দেখা যায়, বল লাইনে পিচ করে এলগারের হাঁটুতে ছোবল দেয়। তখনও পর্যন্ত আউট বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু বল ট্র্যাকিংয়ের শেষ ধাপে দেখা যায়, বলটি চলে যেত স্টাম্পের ওপর দিয়ে। এলগার টিকে যান।

আম্পায়ার ইরাসমাস তখনই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মাথা নেড়ে বলেন, “এটা তো অসম্ভব।” তার এই কথা ধরা পড়ে স্টাম্প মাইকে।

বিরাট কোহলি ও ভারতের অন্যান্য ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষায়ও ফুটে ওঠে অবিশ্বাস। সেটা তারা কণ্ঠেও প্রকাশ করতে পিছপা হননি।

সহ-অধিনায়ক লোকেশ রাহুল বলে ওঠেন, “১১ জনের বিপক্ষে যেন খেলছে গোটা দেশ।” অশ্বিন আরও কাঠগড়ায় তোলেন ব্রডকাস্টার সুপারস্পোর্টকে, “জয়ের জন্য অন্য কোনো ভালো পথ বের করো, সুপারস্পোর্ট!”

স্টাম্প মাইকে তারা এসব ইচ্ছে করেই শোনান। তবে কোহলি ছাড়িয়ে যায় সবকিছুর সীমানা। ভারতীয় অধিনায়ক স্টাম্প মাইকের কাছে মুখ নিয়েই বলেন, “তোমাদের দলের দিকে মনোযোগ দাও বল উজ্জ্বল করার সময়। শুধু প্রতিপক্ষের দিকে খেয়াল রাখলে চলবে না। সবসময় শুধু লোকজনকে ধরার চেষ্টা!”

কোহলির এই মন্তব্যের প্রেক্ষাপট হতে পারে ২০১৮ সালের সেই আলোচিত কেপ টাউন টেস্ট, যেটিতে সুপারস্পোর্টের ক্যামেরায় ধরা পড়ে অস্ট্রেলিয়ানদের বল টেম্পারিং। যেটির সূত্র ধরে পরে নিষিদ্ধ হন স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার ও ক্যামেরন ব্যানক্রফট।

ডিআরএস নিয়ে অসন্তুষ্টির অনেক ঘটনা আছে বটে। তবে মাঠেই এরকম ক্ষুব্ধ প্রকাশ বিরল।

বল ট্র্যাকিং প্রযুক্তি সরবরাহ করে হক-আই নামে একটি সংস্থা, যারা স্বতন্ত্র। ক্রিকেট বিশ্বজুড়েই তাদের স্বীকৃত প্রযুক্তি চলে, এই সিরিজেও সেটাই।

ব্যাটসম্যানের হাঁটুর নিচে লাগা বল স্টাম্পের ওপর দিয়ে যেত, এটা বিস্ময়কর বটে। তবে সাধারণ চোখে মনে হওয়া কোনো কিছু রিভিউয়ে নাটকীয়ভাবে ভুল প্রমাণিত হওয়ার অনেক নজির আছে। ব্রডকাস্টার সুপারস্পোর্ট টুইটারে একটি গ্র্যাফিক্সে দেখায়, কেপ টাউনের উইকেটের বাড়তি বাউন্সের কারণেই বলটি স্টাম্পের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল।

দিনের খেলা শেষে ভারতের বোলিং কোচ ও সাবেক পেসার পরশ মামব্রে বললেন, আবেগের প্রকাশ অস্বাভাবিক নয়।

“আমরা দেখেছি, আপনারাও দেখেছেন। আমি এটি ছেড়ে দেব ম্যাচ রেফারির ওপরে, তিনি দেখবেন। এখন আর মন্তব্য করব না।”

আলোচিত সেই সিদ্ধান্ত, বল বাউন্স করে যাচ্ছে স্টাম্পের ওপর দিয়ে। ছবি: সুপারস্পোর্ট ও হক-আই।

“মাঠে সবাই নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছে। কখনও কখনও এরকম সময়ে লোকে কিছু একটা বলে ফেলে। আমাদের উচিত হবে সামনে তাকানো। সবাই নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিচ্ছে। আবেগ তাই পেয়ে বসে মাঝেমধ্যে।”

তবে আবগের এমন প্রকাশ মানতে পারছেন না সাবেক ভারতীয় ওপেনার গৌতম গম্ভির। স্টার স্পোর্টস-এ প্রতিক্রিয়ায় তিনি একহাত নেন কোহলিকে।

“কোহলি খুবই অপরিণত। ভারতীয় একজন অধিনায়ক এরকম কথা বলছেন স্টাম্প মাইকে, এর চেয়ে বাজে কিছু আর হতে পারে না। এসব কাজ করে কখনোই তরুণদের জন্য আদর্শ হতে পারবে না।”

আরেক সাবেক ভারতীয় ব্যাটসম্যান সঞ্জয় মাঞ্জরেকার মনে করলেন বল ট্র্যাকিংয়ের আলোচিত আরেকটি ঘটনা। ২০১১ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে পাকিস্তানের অফ স্পিনার সাঈদ আজমলের বলে শচিন টেন্ডুলকারের এরকম রিভিউয়ে টিকে যাওয়া নিয়ে চর্চা হয় এখনও।

ইএসপিএনক্রিকইনফোতে আলোচনায় মাঞ্জরেকার বললেন, ভারতীয় ক্রিকেটারদের আচরণ তারও চোখে লেগেছে।

“প্রথমত, রিপ্লে দেখে প্রথম দেখায় মনে হয়েছে, বল স্টাম্পে লাগত। আম্পায়ার ইরাসমাসের বিস্ময়টা বুঝতে পারি, কারণ তার সিদ্ধান্ত সাধারণত রিভিউ করতে হয় না। খালি চোখে মনে হচ্ছিল, বল স্টাম্পে লাগত। সেটা একটা ব্যাপার। তবে এরকম কিছু তো প্রথমবার হলো না। মোহালিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেন্ডুলকারের ঘটনা তো আছেই। কাজেই এরকম হয়েছে।”

“তবে এবার এই রিভিউয়ের পর যা হলো, তা খুবই সিরিয়াস ব্যাপার। ভারতীয় শিবির যেভাবে ব্রডকাস্টারকে কাঠগড়ায় তুলেছে অসদুপায় অবলম্বন করার দায়ে, এটা গুরুতর ব্যাপার। আমার এটায় আপত্তি আছে।”

স্বতন্ত্র একটি প্রযুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো যৌক্তিকতা পান না দক্ষিণ আফ্রিকান গ্রেট ও এখনকার ধারাভাষ্যকার শন পোলক।

“ভারত উইকেট নিতে মরিয়া ছিল এবং তাতে আবেগের জোয়ার বয়ে যায়। বল লাইনে পিচ করে এবং বাউন্স করে, আর এলগার অনেক সামনে পা বাড়িয়েছিল। এত লম্বা পা বাড়ালে এরকম হতেই পারে। ভারতীয়রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে।”

“হক-আই এমন একটা কিছু, সিদ্ধান্তের জন্য যেটির ওপর নির্ভর করা যায়। ওরা তো স্বতন্ত্র। ওদের যা আছে, তা নিয়েই ওরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তাদের ক্যামেরা তো নিজস্ব। ভারতীয়দের হতাশা আমি বুঝি, কারণ তারা উইকেট চাচ্ছিল। কিন্তু আমার মনে হয়, ওরা সীমা ছাড়িয়ে গেছে একটু।”

ওই সময় ২২ রানে থাকা এলগার শেষ পর্যন্ত বেশিদূর যেতে পারেননি। দিনের শেষবেলায় আউট হন তিনি ৩০ রানে। সেখানেও দৃশ্যপটে আসে রিভিউ এবং আবারও বিতর্কিত মন্তব্য করেন কোহলি।

এবার জাসপ্রিত বুমরাহর বলে কটবিহাইন্ডের আবেদনে আউট দেননি আম্পায়ার। ভারত রিভিউ নেয়। তখন স্টাম্প মাইকে আবার ধরা পড়ে কোহলির কণ্ঠ, “না জানি এবার তারা কী দেখায়!”

এবার অবশ্য ভারতীয়রা খুশিই হয় রিভিউয়ে। আল্ট্রাএজ-এ স্পাইক ধরা পড়ায় আউট হন এলগার।

ম্যাচ ও সিরিজ জয়ের জন্য ২১২ রানের লক্ষ্যে ছুটে দক্ষিণ আফ্রিকা দিন শেষ করে ২ উইকেটে ১০১ রান তুলে।