‘অনেক ঠেকে শিখেছি, এখন আর থামতে চাই না’

শ্রীলঙ্কায় হেরে যাওয়া সিরিজে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে তাসকিন আহমেদের বোলিং। কঠিন কন্ডিশন ও উইকেটে যে মানের ফাস্ট বোলিংয়ের প্রদর্শনী তিনি মেলে ধরেছেন, বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে তা বিরল। এই চেহারায় তার আবির্ভূত হওয়ার পেছনে আছে হাড়ভাঙা খাটুনি, অধ্যাবসায় আর প্রতিজ্ঞার গল্প। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তাসকিন শোনালেন সেই গল্পগুলি। পাশাপাশি জানালেন তার ভেতরের তাড়না, বদলে যাওয়ার প্রেরণা ও সামনের পথচলা নিয়ে স্বপ্নের কথাও।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2021, 02:14 PM
Updated : 8 May 2021, 05:55 PM

এই তাসকিনকে কি বলা যায়, তাসকিন ২.০? তাসকিনের দ্বিতীয় জন্ম! নাকি অন্য তাসকিন?

তাসকিন আহমেদ: হাহাহা…নাহ, সবই আমি, সবই তাসকিন। সময়ের সঙ্গে বদলায় অনেক কিছু। এবার ফেরাটা অনেক কঠিন ছিল। যে জায়গাটায় চলে গিয়েছিলাম, সবাই ভেবেছিল, ‘তাসকিন শেষ’, ‘তাসকিন ফুরিয়ে গেছে।’ অনেক কষ্ট করে, কঠোর পরিশ্রম করে, অনেক ত্যাগের পর আল্লাহ এই সুযোগ করে দিয়েছেন।

শ্রীলঙ্কা সফরের পারফরম্যান্সে আপনার নিজের কাছে তৃপ্তির জায়গা কোনটি?

তাসকিন: সবচেয়ে বড় তৃপ্তি ছিল, সকাল থেকে বিকেল, সব সেশনে, সব দিনে একইভাবে বল করতে পারা। অনেক দিন পর টেস্ট খেলেও দুই টেস্টে ৭০ ওভার (৬৮.২) প্রায় একই গতিতে করতে পেরেছি।

এটা নিয়েই আমার দুর্ভাবনা ছিল, সাড়ে তিন বছর পর টেস্ট খেলতে নেমে কতটা সময় ভালো বোলিং করতে পারব। ভালো লাগছে যে পেরেছি।

ইচ্ছা তো আগেও ছিল। সবসময়ই ছিল। আগে পারিনি। এবার হয়েছে। টেস্ট ক্রিকেট অনেক কঠিন, অনেক কষ্টের জায়গা। দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন চা বিরতির পর বোলিংয়ের সবকিছু একইরকম রাখা সহজ নয়। আমি চেষ্টা করেছি। হয়তো দারুণ কিছু করে দুনিয়া উল্টে ফেলিনি, তবে কিছুটা পেরেছি, এটা খানিকটা সন্তুষ্টির।

এই সফরে অতৃপ্তির জায়গা?

তাসকিন: ইচ্ছে ছিল, ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার। সেটি পারিনি।

দ্বিতীয় টেস্টে আপনার বলে ক্যাচগুলি নিতে পারলে ৫ উইকেট হতে পারত!

তাসকিন: ক্যাচ মিস হওয়াকে কারণ ধরছি না। এমনিতে তো ৪ উইকেটও নাও হতে পারত! ক্যাচ ড্রপ হবেই, সবারই হয়।

ক্যাচ পড়লে যে আমার খারাপ লাগে না, তা নয়। লাগে অবশ্যই। বেশি খারাপ লাগে, খেলা শেষে রাতে যখন ভাবি, মনে হয় একটা-দুইটা উইকেট বেশি হতে পারত…তবে মাঠে আমার এখন কখনোই খারাপ লাগে না। মনে করি, যা হওয়ার হয়েছে। বাজে প্রতিক্রিয়াও দেখাই না, দলের ভাবমূর্তির ব্যাপার আছে।

প্রচণ্ড গরমে ও পেস প্রতিকূল উইকেটেও ৩০-৩৫ ওভার একই গতিতে বল করা, ম্যাচ জুড়ে একই আগ্রাসন ধরে রাখা, এই তাসকিনকে দেখে অবাক অনেকেই। তাসকিন নিজেও কি অবাক?

তাসকিন: আমি বিস্মিত হইনি। কারণ, যে লেভেলের কষ্ট করেছি, আমি তো জানি! নিজের কাছে আমার এটা প্রত্যাশা ছিল এবং এটা আমি মনে করি, এত কষ্টের পর প্রাপ্যও ছিল।

আমি প্রতিটি বল ধরে এগিয়েছি, সব বলে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যখন শারীরিক ভাবে ক্লান্তি এসেছে, তখন মানসিকভাবে নিজেকে চাঙা করে তুলেছি যে দেশের হয়ে খেলছি, এখানে শতভাগ দিতে হবে প্রতিটি মুহূর্তে।

এই যে কষ্টের কথা বলছেন, অনেকেই জানে কিছুটা সেসব। যদি একটু বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়, কেমন ছিল আপনার সেই অধ্যায়টা?

তাসকিন: এই অবস্থায় আসার ভ্রমণটা অনেক কঠিন ছিল, অনেক। গত বছর লকডাউনেই শুরু করেছিলাম। ভয়ঙ্কর পরিশ্রম, অনেক ট্রেনিং তো করতে হয়েছেই, অনেক পছন্দের কিছু ছাড়তে হয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। লাইফ স্টাইল, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা-ঘোরা, খাওয়া-দাওয়া, এসবে অনেক বদল আনতে হয়েছে। আমার জন্য খুব কঠিন ছিল এসব। তবে পেরেছি এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছি।

যতদিন খেলব, এসব চালিয়ে যেতেই হবে। অন্য কোনো বিকল্প নেই। পারফরম্যান্স আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, ভালো-খারাপ হবে। তবে প্রসেস আমার হাতে, সেটায় আমি কোনো ঘাটতি রাখতে চাই না। মাঠের বাইরের বা প্রস্তুতির যে প্রসেস, এটা সবসময় শতভাগ ঠিক রাখতে চেষ্টা করব।

লাইফ স্টাইলের কথা বলছিলেন। সুনির্দিষ্ট করে যদি দু-একটি পরিবর্তনের কথা বলতে বলা হয়?

তাসকিন: বন্ধু-বান্ধবের কথাই বলি, আগে প্রায় প্রতিদিন আড্ডা হতো, অন্তত ৭-৮ জন একসঙ্গে। এখন ৭-৮ মাস হয়ে গেছে, ৭-৮ জন একসঙ্গে হইনি। সবশেষ কবে এরকম আড্ডা দিয়েছি, মনেও নাই। এখন আমার কোনো বাড়তি বন্ধু-বান্ধব নেই।

সামগ্রিক শৃঙ্খলা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। নিজেই অনুভব করি, আগের চেয়ে কতটা ডিসিপ্লিনড আমি। ধরেন, নিয়ম করে পর্যাপ্ত ঘুম, শরীরকে রিকভারির সময় দেওয়া, ট্রেনিংয়ে বাড়তি সময় দেওয়া, দলের সূচির বাইরে বাড়তি জিম-রানিং, মাইন্ড ট্রেনিং…সব কিছু মিলিয়েই বদল এসেছে।

খাওয়ার কথা যদি বলেন, সঠিক সময়ে সঠিক খাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। এমন নয় ভাত খাওয়া যাবে না। তবে পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে ঠিকভাবে সবকিছু খাচ্ছি।

ঠিক কোন সময়টায় আপনার উপলব্ধি হলো যে এসব করা দরকার? কোনো ঘটনায় নাকি হুট করেই?

তাসকিন: গত বছর লকডাউন যখন দেওয়া হলো, হুট করেই একদিন মনে হলো, ‘আমি কি করছি এসব? আমি তো শেষ হয়ে যাচ্ছি! অফ ফর্ম, ইনজুরি তো আছেই। তার ওপর আমি এসব গায়েই লাগাচ্ছি না। দিন যাচ্ছে, আমি আমার মতো আছি, রিল্যাক্সড, খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি…দলের প্র্যাকটিসের বাইরে বাড়তি কিছু করি না…

পাশাপাশি আমি ডিপ্রেশনেও ভুগছিলাম। আমার ভেতরে কোনো স্পিরিট ছিল না।

একদিন আমি দেবু দাকে ফোন করি, মাসলম্যানিয়া নামে একটি জিম আছে উনার। তাকে বললাম, ‘দাদা, আমি তো ভ্যানিশড হয়ে যাচ্ছি। এভাবে চললে ৬ মাস পর আমি শেষ হয়ে যাব। ঘরোয়া ক্রিকেটে এখন খেলতে পারছি, সামনে এসবও পারব না। আমি এভাবে হারাতে চাই না, নিজের সেরাটা দিতে চাই। এজন্য ফিট হতে চাই।”

দেবু দা বললেন, তার জিম বন্ধ, লকডাউন শেষে খুলবে। আমি তাকে বললাম, ‘যতদিন অপেক্ষা করব, ততদিনই আমার দেরি হবে। আজকে থেকেই শুরু করব।” অনেক কথা হওয়ার পর একটা পর্যায়ে উনি রাজী হয়ে বললেন, শুধু আমার জন্য জিম খোলার ব্যবস্থা করবেন। এরপর গত রমজান মাসে আমাকে ট্রেনিং করালেন তিনি।

জিম ঠিক করার পর ডিপ্রেশন দূর করার জন্য মাইন্ড ট্রেনার সাবিত আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। উনি অনেক সাহায্য করেন। আমার হতাশাগুলো দূর করে কিভাবে চাঙা হতে পারি, কিভাবে নিজেকে আরও অনুপ্রাণিত করতে পারি, এসব নিয়ে তিনি কাজ করেন।

প্রথম এক মাস শুধু ফিটনেস আর মাইন্ড ট্রেনিংই করেছি। পরে স্কিল ট্রেনিং শুরুর কথা ভাবলাম। খালেদ মাহমুদ সুজন স্যার (বিসিবি পরিচালক ও কোচ) ও মাহবুব আলি জাকি স্যারের (বিসিবির কোচ) সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম যে কীভাবে কাজ করতে পারি।

লকডাউন তখন কড়া। বাইরে কাজ করার উপায় নেই। আমি বাসার গ্যারেজে বোলিং ড্রিল করে সেসবের ভিডিও তাদেরকে পাঠাতাম। পাশাপাশি ওটিস গিবসনকেও পাঠাতাম। সুজন স্যার ও জাকি স্যার আমাকে ছোট বেলা থেকে দেখে আসছেন, আমার সব জানেন। আর গিবসন জাতীয় দলের বোলিং কোচ, সবার সঙ্গেই কাজ করতে থাকলাম।

গিবসন একটু টেকনিক্যাল পরিবর্তন করে দিলেন। বড় কিছু নয়, আমার রিস্ট পজিশন যেন ঠিক থাকে, এটা নিয়ে বেশি কাজ করলেন। সুজন স্যার ও জাকি স্যারও টুকটাক কিছু দেখালেন, তিন জনের পরামর্শ প্রায় একইরকমের ছিল।

এভাবে কাজ করতে থাকলাম। মাঠে ফেরার পর চলতে থাকল কাজ, এখনও চলছে।

এটা চলতে থাকবে, আর থামাথামি নেই। মাঠে-মাঠের বাইরে আমি সেরাটা দিতে চাই। তারপর কাজ হলে হবে, না হলে কিছু করার নেই।

আপনার যে লাইফ-স্টাইল ছিল, সেখান থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ এই কষ্টকর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া কতটা কঠিন ছিল? তখন প্রেরণার জ্বালানী কি ছিল?

তাসকিন: অনেক কষ্টকর ছিল। তবে প্রেরণার অভাব ছিল না। সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিল ‘অবহেলা।’ জাতীয় দলে না থাকলে অনেক অবহেলা, উপেক্ষা সহ্য করতে হয়। মাঠে, মাঠের বাইরে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সবারই ব্যবহার বদলে যায়।

এখন মনে হয়, ওই বাদ পড়া, অমন খারাপ সময় এসে ভালোই হয়েছে। দুনিয়া চিনতে পেরেছি। যা হয়, ভালোর জন্যই হয়।

ম্যাশ ভাইও (মাশরাফি বিন মুর্তজা) আমার অনেক বড় প্রেরণা সবসময়। উনি বলতেন, ‘এটা কর, ওটা দ্যাখ…।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন আপনার ফিটনেস ট্রেনিং নিয়ে ট্রল হয়েছে বেশ। আপনারও চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই?

তাসকিন: হ্যাঁ, খারাপ লেগেছে। মন খারাপ হয়েছে। পরে নিজেই বুঝেছি, সমস্যা নেই। যারা ট্রল করছে, করুক। এটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমি যদি ভালো করতে পারি, এখন ট্রল করা লোকগুলোই হয়তো বাহবা দেবে।

জলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হাঁটছেন, আপনার এরকম একটা ভিডিও নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ট্রল হয়েছিল…

তাসকিন: ওটা ছিল মাইন্ড ট্রেনিংয়ের অংশ। এক সপ্তাহ পরেই সিরিজ ছিল, ওই অবস্থায় ওটার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছির মেন্টাল ব্রেক থ্রু আনার জন্য, সাহসের জন্য। এমনিতে এটা কিন্তু বড় কোনো কিছু নয়, চট করে হেঁটে গেলে কিছু হয় না। কিন্তু যাওয়ার জন্য যে সাহস দরকার, সেটা অর্জন করাই চ্যালেঞ্জের। পা পুড়তে পারত, অনেক কিছু হতে পারত।

নিউ জিল্যান্ডে আমি বাঞ্জি জাম্প দিয়েছিলাম, এটা নিয়েও ট্রল হয়েছে। কিন্তু এটাও ছিল মাইন্ড ট্রেনিংয়ের অংশ, মাইন্ড ট্রেনারই বলেছিলেন করতে। মেন্টাল ব্রেক থ্রুর ব্যাপারটা হলো, চাপের মধ্যে ভয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এটা সহায়তা করে। এটা করলেই যে বীর হয়ে গেলাম, তা নয়। তবে উন্নতি হবে। চাপের মুহূর্তে যদি অন্যদের চেয়ে শতকরা এক-দুই ভাগও এগিয়ে রাখতে পারি, সেটাই তো বাড়তি সুবিধা। এসবেরই চেষ্টা এটা।

আপনার ফিটনেস এখন দারুণ বটে। তবে স্কিল বলুন বা বৈচিত্র্য বাড়ানো, নতুন কিছু যোগ করা, এসব উন্নতি নিয়ে ভাবনা কি?

তাসকিন: রিস্ট পজিশন নিয়ে গিবসসের কাজ করার কথা বললাম আগে। খালেদ মাহমুদ সুজন স্যার ফলো থ্রু একটু ঠিক করে দিয়েছেন। ছোট ছোট টেকনিক্যাল কিছু পরিবর্তন আমাকে সহায়তা করছে। বলের সিম পজিশন, মুভমেন্ট পাওয়া, এসব ভালো হচ্ছে।

এসবও প্রসেস। আরও কাজ করতে হবে। গিবসন অনেক সহায়তা করছেন। আমাকে নিয়ে কাজ করছেন। বড় কিছু না, কিন্তু ছোট ছোট বেশ কিছু।

গিবসনের আগে শার্ল ল্যাঙ্গাভেল্ট অল্প কিছুদিন ছিলেন। তার আগে কোর্টনি ওয়ালশ ছিলেন লম্বা সময় বোলিং কোচ। তাদের নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কি?

তাসকিন: ল্যাঙ্গাভেল্টের সঙ্গে তো সেভাবে কাজ করার সুযোগই হয়নি। ওয়ালশ অবশ্যই কিংবদন্তি বোলার, কোচ হিসেবেও ভালো ছিলেন। তবে আমি গিবসনের সঙ্গে কাজ করে অনেক উপকৃত হচ্ছি। আমার মনে হয়, শুধু আমি নই, অন্যরাও লাভবান হচ্ছে।

নতুন বলে তো ভালোই করছেন। সঙ্গে ইন কাটার যোগ করা, পুরনো বলে রিভার্স সুইং বা বৈচিত্র্য বাড়ানো, এসব চাওয়া আছে?

তাসকিন: কাজ করছি, সব তো একসঙ্গে পারা যাবে না। অফ কাটার নিয়ে মাশরাফি ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি সময় দেবেন হয়তো। অন্য আরও অনেক কিছুও অনুশীলন করছি। আস্তে আস্তে ম্যাচে করা শুরু করব। ম্যাচে যদি টুকটাক ভালো করতে থাকি এসবে, তখন হয়তো আরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে করতে পারব।

আপনার সহজাত লেংথ তো শর্ট অব লেংথ। থেকে থেকে আরেকটু আগ্রাসী লেংথে বল করা বা সীমিত ওভারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, বৈচিত্র্য মিশিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত বল করা, এসব নিয়ে ভাবনা আছে?

তাসকিন: খেলতে খেলতে হবে আশা করি। আগে একরকম ছিল, এখন আরেকরকম। খেলতে খেলতে এখন আমার উন্নতি হবে এসবে, এই বিশ্বাস আছে। সবকিছু নিয়ে কাজ করছি, প্রত্যেক ম্যাচে এক ভাগ, দুই ভাগ উন্নতি করতে পারলেও অনেক।

ফিটনেসের দিক থেকে এখন যে অবস্থা, টেস্টে এরকম করার পর লিমিটেড ওভারে সমস্যা হবে না বলেই আশা করি। স্কিল অবশ্যই ভিন্ন এখানে, বৈচিত্র্য বেশি লাগবে এখানে, আরেকটু প্রোঅ্যাক্টিভ হতে হবে, পরিস্থিতি মাথায় রেখে বল করতে হবে। সবই আছে ভাবনায়।

আমি এখন প্রসেসটা ঠিক রাখাতেই মন দিচ্ছি। অন্য যা কিছুই হোক, এখানে আপোস করতে দিচ্ছি না।

২০১৫-২০১৬ সালের সময়টায় শুধু গতি নয়, সীমিত ওভারে আপনার বোলিং সবদিক থেকেই বেশ কার্যকর ছিল। সেই তাসকিনকে পাওয়া যাবে আবার?

তাসকিন: আরও ভালো তাসকিনকেও তো পাওয়া যেতে পারে! আমি জানি না, শেষ পর্যন্ত কী হবে। তবে আরও ভালো হওয়াই লক্ষ্য। আমি চাই, নিজের সেরা ভার্সনটা যেন হতে পারি।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই আপনার একটা লক্ষ্য ছিল ১৫০ কিলোমিটার গতিতে বল করা। সেই লক্ষ্য এখনও আছে নাকি সার্বিক স্কিলে উন্নতিতে সব মনোযোগ?

তাসকিন: এখনও মাথায় আছে। এটা আমার একটা ইচ্ছার জায়গা, স্বপ্নের জায়গা। কিন্তু ১৫০ কিলোমিটারের কথা ভেবে অ্যাকুরেসি বা অন্যান্য কিছু খারাপ করতে চাই না। স্কিলই আগে। গতি নিয়ে অফ সিজনে টুকটাক কাজ করে যেতে হবে। ফিট থাকতে পারলে হয়তো বাড়বে গতি। আপাতত আমার চাওয়া, ১৪০ কিলোমিটার গতিটা ধরে রেখে নিশানা, স্কিল বাড়ানো।

ক্যাচিংয়ে ফেরা যাক। আপনার বলেই যখন এত ক্যাচ পড়ে, নিজেকে দুর্ভাগা মনে হয় না?

তাসকিন: ক্যাচ পড়ার হিসাব আসলে করি না। ভেবেও লাভ নেই, উইকেটগুলো তো আর পাব না। আগেই বলেছি, খারাপ লাগে, বিশেষ করে খেলার পর। দুর্ভাগ্য হিসেবে মেনে নেই, আর কী-ই বা করতে পারি। ভালো বোলিং করা আমার দায়িত্ব। উইকেট একদিন পাব, আরেকদিন পাব না।

শ্রীলঙ্কায় একটা ক্যাচ পড়ার পর দেখা গেল, আপনি হেসে আবার রান আপের দিকে হাঁটা দিলেন। এতটাই সহজ মেনে নেওয়া?

তাসকিন: এছাড়া তো উপায় নেই। নরম্যালই নেওয়ার চেষ্টা করি। যারা ক্যাচ ছাড়ে, ওরা তো সরি বলে অনেক সময়। আমি ওদেরকে বলি, ‘নো প্রবলেম, পরেরবার হবে।’ এভাবে উজ্জীবিত করতে হবে।

কোচ রাসেল ডমিঙ্গো, বোলিং কোচ ওটিস গিবসন, আপনার বোলিং দেখে তারা কি বলেছে?

তাসকিন: ভালোই বলেছে। আমার লক্ষ্য হলো, ওয়ার্ল্ডক্লাস বোলার হওয়া। তারা বলেছেন, আমি সেই পথেই আছি। এখন এটাকে ধরে রেখে আরও উন্নতি করে যেতে হবে।

ক্রিকেটার তাসকিনের কথায়, পারফরম্যান্সে পরিণত হওয়ার ছাপ দেখা যাচ্ছে। মানুষ তাসকিন এখন কতটা পরিণত?

তাসকিন: আগের চেয়ে একটু পরিণত হয়েছি মনে হয়! উন্নতি হচ্ছে। ছেলে বড় হচ্ছে, দুই বছর বয়স। ওকে দেখছি একটু একটু করে বেড়ে উঠতে। প্রতি সফর থেকেই এসে দেখি, আমার ছেলে দু-একটি বাড়তি শব্দ শিখছে, আরেকটু লম্বা হচ্ছে, নতুন কিছু শিখছে, এসব উপভোগ করি। পরিবারে সময় বেশি দেই, সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করি।

আমার পরিবারও আমাকে নানাভাবে সমর্থন দেয়। তাদের চাওয়া, আমি যেন এভাবেই থাকি।

দুঃসময়ে অনেক কিছু শিখেছি। সে সময়ে যে বন্ধুরা চলে গেছে, আমার জন্য খুব ভালো হয়েছে। আমি চাই, তারা যেন আমার জীবনে আর না আসে।

এখন আপনার সামনের চাওয়া কি?

তাসকিন: চাওয়ার শেষ নেই। প্রত্যেক সিরিজ, প্রতিটি ম্যাচই সুযোগ। জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। অনেক ঠেকে শিখেছি। না ঠেকলে কেউ শিখে না, সে যতবড় পণ্ডিত হোক। এখন ওয়ার্ল্ডক্লাস বোলার হতে চাই। রিল্যাক্সড হওয়ার কোনো সুযোগ আমি দেখি না, অতীতের দুঃসময় আমাকে রিল্যাক্সড হতে দেবে না। আর থামতে চাই না।