ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের ১ বছর: কতটা পূরণ হলো দাবি-দাওয়া

কিছু দাবি পূরণ হয়েছে কিছুটা। কিছু পূরণের প্রক্রিয়া চলছে। দু-একটি দাবিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিবি মনে করছে অবাস্তব। পরে করোনাভাইরাস মহামারীতে প্রবলভাবে ব্যাহত হয়েছে প্রক্রিয়া। সব মিলিয়ে ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের এক বছর পর তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে আছে আশা-হতাশার নানা গল্প।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2020, 10:47 AM
Updated : 18 Oct 2020, 11:26 AM

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে থমকে দেওয়া সেই ধর্মঘটের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী বুধবার। গত বছরের ২১ অক্টোবর দুপুরে, মিরপুরে একাডেমি মাঠে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে ধর্মঘট ঘোষণা করেন ক্রিকেটাররা। ৬০ জনের মতো ক্রিকেটার উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সবার প্রতিনিধি হিসেবে সেই সময়ের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসান জানান, দাবি না মানা পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেট কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন তারা।

শুরুর ১১ দফা দাবির পর যোগ করা হয় আরও দুটি। সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রয়া জানিয়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বলেন, “এই ধর্মঘট দেশের ক্রিকেটকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত।” তিন দিনের টানাপোড়েনের পর বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে ক্রিকেটারদের বৈঠকে অবসান হয় অচলাবস্থার। বিসিবির আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন খেলোয়াড়রা।

ক্রিকেটারদের শুরুর ১১ দাবির ৯টিই তখন মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন বিসিবি প্রধান। সম্ভাব্য সময়সীমার কথাও উল্লেখ করেছিলেন তিনি, “এটা যে ৬ মাস বা ১ বছর পরে করব, তা নয়। আশা করছি, ২-৩ দিনের মধ্যে আর্থিক ব্যাপারগুলো আমরা করে দেব ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।”

এক বছর পর দেখে নেওয়া যাক বাস্তবায়নের কোন পর্যায়ে আছে সেই ১৩ দফা।

দাবি ১

“ক্রিকেটারদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে ও অকার্যকর সংগঠন কোয়াবের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্রিকেটারদেরই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বেছে নেওয়ার অধিকার দিতে হবে।”

ক্রিকেটারদের প্রাপ্য সম্মানের বিষয়ে যে কথা তখন বলা হয়েছিল বিসিবির পক্ষ থেকে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এখনও সেই উচ্চারণই শোনা গেল বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরির কণ্ঠে।

“ক্রিকেটারদের আমরা সবসময়ই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য ও সম্মান দেই। তাদেরকে ঘিরেই আমাদের সবকিছু। এমনকি আমাদের মাননীয় বোর্ড প্রেসিডেন্ট ছোটখাটো থেকে যে কোনো ব্যাপারে ক্রিকেটারদের খোঁজখবর রাখেন। তাদেরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন।”

ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা কোয়াবের নির্বাচন হয়নি এই এক বছরেও। সভাপতি পদে যথারীতি আছেন বোর্ড পরিচালক ও সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক পদে সাবেক পেসার দেবব্রত পাল। 

এখনও দায়িত্বে থেকে যাওয়ার পেছনে নিজেদের দায় খুব একটা আছে বলে মনে করেন না কোয়াবের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল।

“ধর্মঘট শেষ হওয়ার পরই আমরা ওদের সঙ্গে বসেছিলাম। সরাসরিই বলেছি, আমরা তো দায়িত্বে থাকতে চাই না। তোমরা দায়িত্ব নাও। এগিয়ে আসো। ওরা তিন দিন সময় নিয়েছিল। সেই তিন দিন এখনও শেষ হয়নি। আর কিছুই জানায়নি। প্রথম দাবিই ওরা এটা জানাল, তারপর আর খবর নেই। আমরা নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে চেয়েছি, কিন্তু ওরা সবাই এগিয়ে না এলে তো সম্ভব নয়।”

“তারপরও আমরা নির্বাচন দিতাম, কিন্তু কোভিড মহামারী শুরু হয়ে গেল। এখন আমাদের পরিকল্পনা হলো, সামনে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ হলে, তখন মোটামুটি সব ক্রিকেটারকে পাওয়া যাবে। লিগের আগে বা লিগ চলার সময় আমরা নির্বাচন দিয়ে দেব।”

দাবি ২

“ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ হতে হবে আগের মতো করে। সেখানে পারিশ্রমিকের কোনো মানদণ্ড থাকবে না। কোন ক্লাবে, কত টাকায় খেলবেন, সেই স্বাধীনতা দিতে হবে ক্রিকেটারদের।”

এই দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে ধর্মঘট শেষের পরপরই। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে উন্মুক্ত দলবদলের পরিবর্তে ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েজ’ নামে একটি পদ্ধতি তৈরি করেছিল বিসিবি, যেখানে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে দিয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে রাখা হতো। তাদের বেছে নিত ক্লাবগুলি। শুধু এক মৌসুমেই এই পদ্ধতি থাকবে বলে বিসিবি সভাপতি কথা দিলেও পরে তা একরকম নিয়মিত হয়ে যায়। ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের পর শেষ হয় ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েজ’ অধ্যায়।

তবে এটি নিয়ে এখন ক্রিকেটারদের অনেকের মধ্যেই অনেক দ্বিধা আছে। বিশেষ করে, মধ্যম সারির অনেক ক্রিকেটার ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পর্যাপ্ত ও প্রাপ্য পারিশ্রমিক না পেয়ে আক্ষেপ করছেন যে ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েজ’ হয়তো মন্দের ভালো ছিল। সঙ্গত কারণেই নাম প্রকাশে ইচ্ছুক নন তারা।

অনেকে যেটা প্রকাশ্যে বলতে পারছেন না, তাদের কথা মুখ ফুটে বলতে আপত্তি করলেন না কোয়াবের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল।

“দেখুন, ওদের দাবিতে এটা ছিল, আমরা সমর্থন করেছি। সবাই চাইলে তো পাশে থাকতেই হবে। কিন্তু এখন অনেকেই হাহুতাশ করছে। এই যে এবার মহামারীতে খেলা হলো না, কজন টাকা পেয়েছে?”

“প্লেয়ার্স বাই চয়েজ বাদ হওয়ায় লাভবান হয়েছে বড়জোর ৩-৪ জন ক্রিকেটার। তাদের পারিশ্রমিক হয়তো ৩০-৩৫ লাখ থেকে ৬০ লাখ হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্রিকেটারের জন্য খারাপ হয়েছে। আমাদের ক্লাব ক্রিকেটের বাস্তবতা তো অন্যরকম, কারণ নিয়ে বিতর্ক যতোই থাকুক। ছেলেরা অনেকেই এখন ঠিকমতো টাকা পায় না, বোর্ডের কাছে যেতেও অস্বস্তি থাকে।”

দাবি ৩

“এবার বিশেষ বিপিএল হলেও আগামী বছর থেকে বিপিএলকে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক নিয়মে ফেরাতে হবে। বিদেশি ক্রিকেটারদের সঙ্গে স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের সামঞ্জস্য রাখতে হবে। ড্রাফটে ক্রিকেটাররা কে কোন গ্রেডে থাকবেন, সেটা বেছে নেবার অধিকার দিতে হবে।”

মুজিববর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু বিপিএল আয়োজনের পর কোভিড মহামারীর কারণে এবছর বিপিএল হচ্ছে না। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আগামী মার্চে নিউ জিল্যান্ড সফরের পর এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের একটা ভাবনা বিসিবির আছে, তবে আপাতদৃষ্টিতে সম্ভাবনা কমই। পরের বিপিএল নিয়ে তাই এমনিতেই অনিশ্চয়তা আছে।

পারিশ্রমিকের দাবি নিয়ে খুব বেশি ভাবনার কিছু আছে বলে মনে করেন না বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরি।

“বিপিএল তো আল্টিমেটলি ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিকই হবে, এটা আসলে দাবি জানানোর মতোও নয়। আর পারিশ্রমিকের ব্যাপারে আমরা সবসময় বলে এসেছি বাংলাদেশের বাস্তবতার কথা। আমাদের সামাজিক ও আর্থিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই আমরা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করার চেষ্টা করি। বাড়ানোর সুযোগ সবসময়ই থাকে, আমরা অবশ্যই দেখব।”

দাবি ৪

“প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচ ফি অন্তত এক লাখ টাকা করতে হবে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতন কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে।”

ধর্মঘট শেষ হওয়ার পাঁচ দিন পরই ম্যাচ ফি বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিসিবি। জাতীয় লিগের প্রথম স্তরে ম্যাচ ফি ৩৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৬০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় স্তরে ২৫ হাজার থেক বেড়ে হয় ৫০ হাজার।

টাকার অঙ্ক যদিও ক্রিকেটারদের চাওয়ার কাছাকাছি নয়, তবে বাড়ানোর পর তখন আপাতত সন্তুষ্টির কথাই বলেছিলেন ক্রিকেটাররা। 

প্রথম শ্রেণির চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বাড়ানোর দাবি পূরণ হয়নি এখনও। বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরি জানালেন, উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

“এখানে একটু দেরি হয়েছে সত্যি। তবে প্রক্রিয়া চলছে। সামনেই হয়তো ঘোষণা দিতে পারব আমরা। ওরা ৫০ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলেছিল, আমরা চেষ্টা করব সব বাস্তবতা মেনে যতটুকু বাড়ানো যায়।”

দাবি ৫

“ক্রিকেটারদের অনুশীলনের সুবিধা বাড়াতে হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে ১২ মাস কোচ, ফিজিও, ট্রেনারের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভ্রমণ ভাতা, দৈনিক ভাতা উপযুক্ত পর্যায়ে আনতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো বলে খেলা হতে হবে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের টুর্নামেন্টের সময় জিম, সুইমিংপুলসহ হোটেলে রাখা ও ভালো বাসে যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে।”

দৈনিক ভাতা ও ভ্রমণ ভাতা বাড়ানো হয় ম্যাচ ফি বাড়ানোর সঙ্গেই। দৈনিক এক হাজার ৫০০ থেকে বাড়িয়ে করা হয় দুই হাজার ৫০০। ভ্রমণ ভাতা ছিল দুই হাজার ৫০০, যে টাকায় বিমানে যাতায়াত ছিল কঠিন। সেটি বাদ দিয়ে বিমানে যাতায়াত নিশ্চিত করা হয়। যেসব ভেন্যুতে বিমানে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে ভ্রমণ ভাতা করা হয় তিন হাজার ৫০০ টাকা।

এছাড়াও আবাসন ভাতা আগের চেয়ে বাড়ানো হয় ৮০ শতাংশ। ফিটনেস সহায়ক খাবার দেওয়ার জন্য ক্যাটারিং ফি বাড়ানো হয় ৮৫ শতাংশ।

জাতীয় লিগের ম্যাচে অনেক সময়ই খুবই নিম্নমানের বাসে হোটেল থেকে মাঠে যাতায়াত করতে হতো ক্রিকেটারদের। সেখানে এসি বাস নিশ্চিত করা হয়।

অনুশীলন ও কোচিংয়ের সুযোগ-সুবিধা খুব একটা বাড়েনি, মেনে নিলেন প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরি।

“অনেক কিছুই রাতারাতি করা সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভেন্যুগুলোতে উন্নয়ন কাজ চলছে। জিমসহ যা কিছু আমাদের সক্ষমতার মধ্যে সম্ভব, আমরা করছি। মহামারীর কারণে বড় একটা বিরতি পড়েছে। ক্রিকেটারদের সম্ভব সেরা ফ্যাসিলিটিজ নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যাব আমরা।”

দাবি ৬

“বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তিতে আরও বেশি সংখ্যক ক্রিকেটারকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তাদের বেতন বাড়াতে হবে।”

এই দাবির ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। বিসিবির প্রধান নির্বাহী শুরুতে বললেন, এবার চুক্তিতে ক্রিকেটারের সংখ্যা বেড়েছে। তখন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো, আগের বছরের চুক্তিতে ‘রুকি’সহ ছিল ১৭ ক্রিকেটার। এবার লাল-সাদা বলের আলাদা ক্যাটাগরি করেও জায়গা হয়েছে ১৬ জনের। প্রধান নির্বাহী তখন দাবি করলেন, আরও কিছু এবার ‘রুকি’ যোগ করা হয়েছে।

তবে প্রধান নির্বাহী স্পষ্টই বলে দিলেন, কেন্দ্রীয় চুক্তিতে খুব বেশি ক্রিকেটার বাড়াতে চায় না বোর্ড। সেটির যুক্তিও দেখালেন তিনি।

“কেন্দ্রীয় চুক্তি অনেক বড় ব্যাপার। আমরা মনে করি, এখানে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা উচিত এবং যারা সত্যিকার অর্থেই ডিজার্ভ করে, তাদের জায়গা পাওয়া উচিত। কেবল সংখ্যা বাড়ানোর স্বার্থেই রাখলে মান বাড়বে না। দুটির একটা সমন্বয় করতে হবে এবং আমরা সেটিই চেষ্টা করব।”

দাবি ৭

“ক্রিকেটারদের পাশাপাশি দেশীয় কোচ, আম্পায়ার ও গ্রাউন্ডসম্যানদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। একই সঙ্গে যথাযথ পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে হবে।”

এই দাবি নিয়ে প্রধান নির্বাহী পাল্টা প্রশ্ন করলেন এই প্রতিবেদককে, ‘আপনি কি মনে করেন?’ তাকে বলা হলো, ‘কিছু জায়গায় পারিশ্রমিক হয়তো ঠিক আছে, কিছু জায়গায় বাড়ানো উচিত।’ প্রধান নির্বাহী তাতে সায় দিলেন।

“আমিও আপনার সঙ্গে একমত। কিছু জায়গায় অবশ্যই বাড়ানোর সুযোগ আছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের বাস্তবতাও বুঝতে হবে। আইসিসিতে এখন ডেভেলপমন্টে ম্যানেজার হয়তো ১০-১২ হাজার ডলার বেতন পান। আমাদের দেশে সেটা কি সম্ভব? আমাদের স্ট্যান্ডার্ডে আমরা যথেষ্টই চেষ্টা করি, আরও চেষ্টা করব।”

“গ্রাউন্ডসম্যানদের কথা ভাবুন, আপনারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খেলা কাভার করেন। অনেক জায়গায় দেখেছেন ২-৩ জন মিলে সব করে ফেলে। আমাদের এখানে ৫০-৬০ জনও আছে কোনো ভেন্যুতে। সব মিলিয়ে ২০০ জনের বেশি গ্রাউন্ডসম্যান আমাদের। সামগ্রিকভাবে টাকার অঙ্কে কিন্তু কম নয় আমাদের ব্যয়। তাদের স্কিলের গভীরতাও দেখতে হবে। তারপরও দেশের প্রেক্ষাপটে আমরা ভালো পারিশ্রমিকই দেওয়ার চেষ্টা করি।”

দাবি ৮

“জাতীয় ক্রিকেট লিগের ওয়ানডে ফরম্যাট চালু করতে হবে। বিপিএলের ঠিক আগে আরেকটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে।”

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সবচেয়ে ধারাবাহিক ওয়ানডেতে। এই সংস্করণেই বাংলাদেশে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট মাত্র একটি। এই দাবি পূরণ হয়নি। সামনেও পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই বোঝা গেল প্রধান নির্বাহীর কথায়।

“টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বিপিএলের বাইরে আরেকটা টুর্নামেন্ট আমরা আগে করেছি। এবার কর্পোরেট লিগ হবে। ওয়ানডে টুর্নামেন্টও বাড়ানো অসম্ভব নয়। একসময় তো জাতীয় লিগের ওয়ানডে ছিল। তবে সময়ের দাবি বুঝতে হবে আমাদের। কোন ফরম্যাট বেশি জরুরি, ওয়ানডে টুর্নামেন্ট কতটা ভ্যালু অ্যাড করবে, কতটা সুবিধা হবে, সবকিছুই বিবেচনা করতে হবে।”

দাবি ৯

“ঘরোয়া ক্রিকেটের টুর্নামেন্টগুলোর জন্য নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার থাকতে হবে।”

ঘরোয়া ক্রিকেটে সুনির্দিষ্ট সূচি কখনোই ছিল না বাংলাদেশের ক্রিকেটে। প্রতি মৌসুমেই অবস্থা বুঝে সূচি করা হয়। সেখানে বদলও আসে অনেক। এবছর কোভিড মহামারীর কারণে ঝুলে গেছে সবকিছুই। গত মার্চে স্থগিত হয়ে যাওয়া ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ আবার শুরু হওয়া নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা। তবে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান কিছুদিন আগে বলেন, পরিস্থিতি আরেকটু ভালো হলে ঢাকা লিগ ও ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্য সব টুর্নামেন্ট আয়োজন নিয়ে বোর্ড আন্তরিক।

দাবি ১০

“বিপিএল ও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের বকেয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।”

এই দাবির ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরি বললেন, “যে কোনো পর্যায়েই ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক নিয়ে বিসিবি খুবই আন্তরিক এবং সামনেও সমস্যা কিছু হলে বোর্ড দেখবে।”

বিপিএলের পারিশ্রমিক নিয়ে ঘাপলার সেই আগের দুর্নাম এখন আর সেভাবে নেই। গত অগাস্টে অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের সংগঠন ফিকার একটি জরিফে উঠে এসেছিল, বিপিএলে তিন ক্রিকেটার ও এক কোচ ভোগান্তিতে পড়েছেন পারিশ্রমিক নিয়ে। বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক তখন বলেছিলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং ঘটনা জানার পরই তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন।

দাবি ১১

“দুটির বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার অনাপত্তি পত্র না দেওয়ার নিয়ম শিথিল করতে হবে।”

এই দাবি নিয়ে বিসিবি সভাপতি তখনই বলেছিলেন, ‘আমাদের তো ওরকম ক্রিকেটার অনেক নাই, যারা দুটির বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে সুযোগ পায়। যদি ওরকম কখনও হয়, তাহলে আমরা কেস টু কেস দেখব। কারও যদি ডাক আসে এবং যদি সুযোগ থাকে, তাহলে আমরা দেখব।”

বিসিবির অবস্থান এখনও একই আছে। দুটির বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে বাংলাদেশ থেকে ডাক পান এমনিতে কেবল সাকিব আল হাসান। তিনি গত প্রায় এক বছর ধরে নিষিদ্ধ। অন্য কারও ক্ষেত্রে সুযোগ আসেনি।

পরে যোগ হওয়া দুই দাবি

“বোর্ডের রাজস্বের ভাগ দিতে হবে ক্রিকেটারদের এবং নারী ক্রিকেট দলকেও দিতে হবে ন্যায্য ভাগ। পুরুষ ক্রিকেটাররা যে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে তার সব নারী ক্রিকেটারদেরকেও দিতে হবে।”

ধর্মঘট শেষ হওয়ার সময় বিসিবি সভাপতি বলেছিলেন, রাজস্বের ভাগ নিয়ে তারা আলোচনা করবেন। কিছুদিন পর তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই দাবির ভিত্তি খুব একটা নেই। বোর্ড এখনও সেই অবস্থানেই আছে। প্রধান নির্বাহীর মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দাবি বাস্তবিক নয়।

নারী ক্রিকেটারদের পুরুষদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিসিবির প্রধান নির্বাহী বললেন, “আমরা নারী ক্রিকেটের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। তাদের পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। অবশ্যই আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই এসব দেখছি।”

ঘরোয়া ক্রিকেটে পারিশ্রমিক বাড়ানোসহ ১১ দফা দাবিতে ধর্মঘটের ঘোষণা দেন সাকিব আল হাসান। সোমবার মিরপুর বিসিবি একাডেমি মাঠে এসময় তার সঙ্গে ছিলেন অন্য ক্রিকেটাররা।

গত ১ বছরের আরও অনেক বাস্তবতা

ধর্মঘটের পর এই এক বছরের অর্ধেকের বেশি সময় খেয়ে নিয়েছে কোভিড মহামারী। তবে তার আগের সময়টুকুতে যতটা সংঘবদ্ধ থাকার কথা ছিল ক্রিকেটারদের, ততটা দেখা যায়নি।

ধর্মঘট শেষ হওয়ার রেশ থাকতে থাকতেই সাকিবের নিষেধাজ্ঞার খবরে স্তম্ভিত হয়ে যায় দেশের ক্রিকেট। ধর্মঘটে কার্যত নেতার ভূমিকায় ছিলেন এই অলরাউন্ডার। তিনি ক্রিকেটের বাইরে চলে যাওয়ার পর দাবি-দাওয়াগুলোও যেন আড়ালে চলে যায়।

ক্রিকেটারদের আর এসব দাবি নিয়ে পরে উচ্চকিত দেখা যায়নি। বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও বোর্ডের সঙ্গে আলোচনার কোনো দৃশ্যমান ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগও দেখা যায়নি। কোয়াবের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগের পাশাপাশি পেশাদার ক্রিকেটারদের আরেকটি সংগঠনের দাবি ধর্মঘটের সময় তুলে ধরেছিলেন ক্রিকেটাররা। সেটি নিয়েও পরে তাদের আর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করলেও ঘরোয়া ক্রিকেটারদের অনেকেই অনেক সংশয়, প্রশ্নের কথা নানা সময়ে বলেছেন। কোয়াব সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল অবশ্য সরাসরিই তুলে ধরলেন কিছুটা।

“ওই ঘটনা নিয়ে পরে অনেক কিছুই আমরা জেনেছি। ওদের দাবিগুলো অবশ্যই যৌক্তিক ছিল, কিন্তু আন্দোলনের প্রক্রিয়াটা সুষ্ঠু ছিল না। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের একটা বড় অংশ তখনও ধুম্রজালে ছিল, এখনও আছে। অনেক ক্রিকেটার জানত না সবকিছু। এসব দুইশ ভাগ সত্যি। এখন যদি পেছন ফিরে তাকান, দেখবেন আন্দোলন থেকে হয়তো গুটিকয় ক্রিকেটার লাভবান হয়েছেন।”

ধর্মঘটের এক বছর হওয়া নিয়ে জাতীয় দলের নিয়মিত ক্রিকেটারদের বেশ কজনের সঙ্গেই কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউই কোনো মন্তব্য এখন করতে রাজি হননি।

দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় দলের বিবেচনায় না থাকা সিনিয়র ক্রিকেটার এনামুল হক জুনিয়র অবশ্য কথা বলতে আপত্তি করলেন না। ধর্মঘট ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে শুরুর ১১ দফার একটি উচ্চারিত হয়েছিল তার কন্ঠে। প্রথম শেণির ক্রিকেটে দেশের দ্বিতীয় সফলতম বোলার এই বাঁহাতি স্পিনার বললেন, ধর্মঘট থেকে প্রাপ্তি তাদের কিছু হয়েছে, আরও অনেক কিছুর অপেক্ষায় তারা আছেন।

“প্রাপ্তি কিন্তু বেশ কিছু আছে। যেমন, জাতীয় লিগে ম্যাচ ফি বেড়েছে, ভ্রমণ-খাবারের মান বেড়েছে। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটারদের বেতন বাড়বে বলে কোয়াব জানিয়েছে আমাদের, প্রক্রিয়া নাকি চলছে। সেটাও ভালো খবর। টেস্টে ম্যাচ ফি বেড়েছে। যারা শুধু টেস্ট খেলে, তাদের জন্য এটা বড় অনুপ্রেরণা। ইতিবাচক প্রভাব তাই কিছু পড়েছে।”

“জিম ও ট্রেনিং-কোচিংয়ে সুযোগ-সুবিধা অল্প হলেও বেড়েছে। তবে আরও বাড়ার সুযোগ আছে। ঢাকায় মিরপুরে সব ক্রিকেটারের ট্রেনিং সম্ভব নয়। ঢাকার বাইরে সুযোগ-সুবিধা আরও কম। এসবে এখন নজর দিতে হবে। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে পারিশ্রমিক ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। আশা করি, বিসিবি আস্তে আস্তে এসব করবে।”

ধর্মঘটের পূর্বাপর এবং পরবর্তীতে ক্রিকেটারদের অবস্থানের প্রসঙ্গে না গিয়ে বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরি জানালেন নিজেদের করণীয়।

“তাৎক্ষনিকভাবে ওদের দাবি যা পূরণ করা সম্ভব ছিল, আমরা করেছি। কয়েকটির পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছিল। কিছু আছে পলিসি মেকিংয়ের ব্যাপার, একটা প্রক্রিয়া ধরে এগোতে হয়। একটু সময় লাগে। তারপর তো কোভিডের চ্যালেঞ্জিং সময় চলে এলো। এর মধ্যেও যতটা সম্ভব, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

“বেতন বা পারিশ্রমিক সংক্রান্ত ব্যাপারগুলি খব বড় কিছু নয়। প্রক্রিয়া চলছে, হয়ে যাবে। আরও অনেক কিছুই করা সম্ভব আলোচনায় বসলে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক, সব কার্যক্রমে স্বাভাবিক গতি আসুক, আমরা চেষ্টা করব সাধ্যমতো করতে।”

তবে কোভিডের কারণে অনেক বাস্তবতা যে বদলে গেছে, সেটাও সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে বললেন প্রধান নির্বাহী।

“এখন ক্রিকেট মাঠে রাখা, টুর্নামেন্ট-সিরিজ আয়োজন করাই কিন্তু আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ। অনেক পরিকল্পনা করে এগোতে হচ্ছে। সূচি নতুন করে ঠিক করার ব্যাপার আছে। নতুন স্পন্সর, টিভি স্বত্ব খুঁজতে হচ্ছে। গোটা দুনিয়াতেই স্পন্সরশিপে ভাটা নেমেছে এই সময়ে। সব বোর্ডের আয়ে ভাটা পড়েছে। সব দাবি এখনই পূরণের ক্ষেত্রে তাই সক্ষমতার কথাও মনে রাখতে হবে।”

“একটা কথা আমরা বরাবরই বলে আসছি, ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের ব্যাপারে আমরা সবসময়ই আন্তরিক। প্র্যাকটিক্যালি যা করা সম্ভব ছিল, আমরা করেছি, কিছুর প্রক্রিয়া চলছে। অবকাঠামোসহ অন্যান্য কিছু সময়ের সঙ্গে হতে থাকবে।”