স্মরণীয় দ্বৈরথ: আতহারের ইডেন জয় ও টেন্ডুলকারের উইকেট

উপেক্ষার জবাব দেওয়ার জেদ ছিল। আর ছিল ইডেন গার্ডেনসে খেলার স্বপ্ন পূরণের মুহূর্তটি রাঙানোর তাড়না। আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা রূপ নিয়েছিল ভালো খেলার প্রতিজ্ঞায়। অসাধারণ এক ইনিংস খেলে আতহার আলি খান হয়েছিলেন ম্যাচের সেরা। চ্যালেঞ্জ জয়ের সেই অধ্যায় নিয়ে এখনও গর্ব করেন আতহার। তার মনে দোলা দেয়, আরেক ম্যাচে শচিন টেন্ডুলকারের উইকেট নেওয়াও।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2020, 11:27 AM
Updated : 11 May 2020, 11:27 AM

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত আয়োজন ‘স্মরণীয় দ্বৈরথ’-এ সাবেক অলরাউন্ডার আতহার তুলে আনলেন তার ক্যারিয়ারের সোনালী স্মৃতি।

১৯৯০ এশিয়া কাপে কলকাতায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন আতহার। পরাজিত দলে থেকেও সেদিন হয়েছিলেন ম্যান অব দা ম্যাচ, বাংলাদেশের যেটি ছিল প্রথম।

প্রতিপক্ষের বোলিং আক্রমণ সামলানোর চ্যালেঞ্জ তো ছিলই, আতহারের আরও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিজের সঙ্গে। নিজেদেরই কিছু মানুষকে চেয়েছিলেন জবাব দিতে। ইনিংসটি তাই যেমন তাকে তৃপ্তি দিয়েছিল তখন, পেছন ফিরে তাকালে মনে ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে আজও।

‘জীবনের কঠিনতম চ্যালেঞ্জ ছিল সেটি’

“আমার দুটি ইনিংস একসময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড ছিল। ১৯৯০ এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৭৮, পরে ১৯৯৭ এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮২। যদি প্রতিপক্ষের বোলিং আক্রমণের তুলনা করা হয়, অবশ্যই পাকিস্তানের বোলিং ছিল বেশি শক্তিশালী। আকিব জাভেদ, কবির খান, সাকলায়েন মুশতাক, শহিদ আফ্রিদি, আরশাদ খান ছিল পাকিস্তানের। শ্রীলঙ্কার বোলিংয়ে ছিল গ্রায়েম ল্যাব্রয়, চাম্পাকা রামানায়েকে, প্রমোদ্য বিক্রমাসিংহে, ডন আনুরাসিরি ও সনাৎ জয়াসুরিয়া।”

“কিন্তু চ্যালেঞ্জ জয়ের কথা বললে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ইনিংসটিই সেরা। একটা কারণ, তখন আমরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগই পেতাম না। প্রতিটি ম্যাচই ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। ১৯৯৭ এশিয়া কাপ নাগাদ আমরা একটু বেশি খেলছিলাম। তখন আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, আত্মবিশ্বাসও একটু বাড়তি ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের বাস্তবতা ছিল অনেক কঠিন।”

ছবি: কিরন স্পোর্টস ডেস্ক

“আমার নিজের জন্যও ১৯৯০ আসর ছিল বড় এক চ্যালেঞ্জ। সেবার আইসিসি ট্রফির দলে আমাকে নেওয়া হয়নি। ঘরোয়া ক্রিকেটে আমি ছিলাম এক নম্বর ব্যাটসম্যান, তারপরও সুযোগ দেওয়া হয়নি আইসিসি ট্রফিতে। তার আগে হংকংয়ে ১৯৮৮ সাউথ-ইস্ট এশিয়ান টুর্নামেন্টে তিন ম্যাচে আমার রান ছিল অপরাজিত ৯২, অপরাজিত ৬৯ ও ৬১। এত ভালো পারফরম্যান্সের পরও আইসিসি ট্রফিতে সুযোগ না পাওয়ায় হতাশ হয়েছিলাম খুব। এশিয়া কাপে সুযোগ পাওয়ার পর তাই নিজেকে প্রমাণ করার জেদ ছিল আমার। কিছু করে দেখাতে চেয়েছিলাম। জবাব দিতে চেয়েছিলাম। সত্যি বলতে, আমাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল ওই সময়টা।”

“টুর্নামেন্টের আগে একটু অনিশ্চয়তা ছিল। পাকিস্তান নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিল, আমরা তখন ভাবছিলাম যে টুর্নামেন্ট হবে কিনা! অনিশ্চয়তার মধ্যেও অবশ্য প্র্যাকটিস চালিয়ে গেছি আমরা। সেখানেও ছিল বিপত্তি। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের কথা বলছি, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল উত্তাল। একদিন তো স্টেডিয়ামে আমাদের প্র্যাকটিস থামাতে লোক এসেছিল। আমরা বলেছিলাম যে, ‘আমরা ভাই রাজনীতিতে নাই, ক্রিকেট নিয়েই আছি।’ তারপর প্র্যাকটিস চালাতে পেরেছি।”

“টুর্নামেন্টের সূচি হওয়ার পর থেকেই ইডেন গার্ডেনসের ম্যাচটায় চোখ ছিল আমাদের। এত ঐতিহ্যবাহী মাঠ, সবারই স্বপ্ন ছিল ওই মাঠে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার। আর কলকাতা বলে বাংলার একটা ফ্লেভার ছিল। সব মিলিয়েই ইডেনে খেলা একটা স্বপ্ন পূরণের মত ব্যাপার ছিল।”

“শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগে ভারতের বিপক্ষে চন্ডিগড়ে ভালো একটা ইনিংস (৪৪ রান) খেলেছিলাম। ফারুকের সঙ্গে একশ রানের জুটি (১০৮) হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি জুটি সেটি। কপিল দেবের মতো বোলারকে খেলে কিছু রান করেছিলাম, তাই আত্মবিশ্বাস ছিল শ্রীলঙ্কা ম্যাচে ভালো করার।”

“আড়াইশ রান করেছিল শ্রীলঙ্কা (২৪৯), অত রান তাড়া করার কথা তো আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। আমরা চেয়েছিলাম স্রেফ নিজেদের মত খেলতে। শুরুটা খুব বাজে হয়েছিল। নোবেল (নুরুল আবেদীন), শান্টু (আজহার হোসেন) ও ফারুক আউট হয়ে গেল তাড়াতাড়িই (৩ উইকেটে ৪৬)।”

“ইডেনে তখন নতুন বল সামলানো একটু কঠিন ছিল। তবে উইকেটে কিছু সময় কাটালে ব্যাটিং তুলনামূলক সহজ হয়ে যেত। আমার লক্ষ্য ছিল উইকেটে থাকা। শুরু থেকেই বল মাঝব্যাটে লাগছিল। মনে হলো, দিনটি আমার। স্রেফ টিকে থাকতে হবে। নান্নু (মিনহাজুল আবেদীন) ছিল ক্যাপ্টেন, ওর সঙ্গে ভালো একটা জুটি হলো।”

“স্পষ্ট মনে পড়ে, সেট হওয়ার পর ওদের বাঁহাতি স্পিনার ডন আনুরাসিরিকে একটা হাফ পুশ-হাফ ড্রাইভ মতো করেছিলাম। বল দেখলাম লং অফ দিয়ে উড়ে সীমানার বাইরে চলে গেল। নিজেই অবাক হয়েছিলাম, ভালোও লাগছিল। ছক্কা মারতে চাইনি আমি, হয়ে গিয়েছিল। বুঝলাম, উইকেট ভালো, ব্যাটও ভালো। এক বল পর আরেকটি ছক্কা মারলাম লং অফ দিয়েই। এবার মারতে চেয়েই মেরেছি।”

ছবি: কিরন স্পোর্টস ডেস্ক

“একটু পর আরেকটি ছক্কা মারলাম, অরবিন্দ ডি সিলভা ছিল সম্ভবত বোলার। ৯-১০ বলের মধ্যে তিনটি ছক্কা মারার পর রান রেট ভালোই বেড়ে গেল। আমার মনে হলো, রান রেট ধরে রাখতে পারলে জয় অসম্ভব নয়। জয় নিয়ে তখন আমরা চিন্তাও করতাম না। ওই অবস্থায়ই যাইনি কখনও। ওই তিন ছক্বার পর সত্যিই মনে হচ্ছিল, দারুণ কিছু সম্ভব। কিন্তু নান্নু আউট হওয়ার পর একের পর এক উইকেট পড়তে থাকল। তখন আমাকে আবার উইকেট ধরে রাখার মন দিতে হলো।”

“শেষ পর্যন্ত বড় ব্যবধানেই হেরেছি আমরা। তবে আমি অপরাজিতই ছিলাম। আমার ব্যক্তিগত একটা ভালো লাগা ছিল যে দুই ম্যাচেই ভালো খেলে জবাবটা দিতে পেরেছিলাম। আর দলের বড় প্রাপ্তি ছিল আত্মবিশ্বাস। সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, বড় দলগুলির বিপক্ষে আমরা লড়াই করতে পারি। কিন্তু ম্যাচ খেলার সুযোগই তো ছিল না! আমরা পরের ওয়ানডে ম্যাচ খেললাম ৫ বছর পর!”

‘টেন্ডুলকার-দ্রাবিড়ের উইকেট’

“ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৬টি উইকেট আছে আমার। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উইকেট নিঃসন্দেহে শচিন টেন্ডুলকার। ১৯৯৮ সালে ভারতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ম্যাচ ছিল সেটি, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে।”

“আমরা মাত্র ১১৫ রানেই আউট হয়েছিলাম। ওদের শুরুটা করল দুর্দান্ত। নভজোত সিং সিধু ও টেন্ডুলকার প্রচণ্ড মারছিল। ফার্স্ট চেঞ্জ বোলার ছিলাম আমি, টেন্ডুলকার আমার এক ওভারে তিনটি চার মারল। অধিনায়ক আকরাম আমাকে হাত উঁচিয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইউ, আর লাগবে না বোলিং।’ কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, আমি টেন্ডুলকারকে আউট করতে পারব। কারণ সে বলতে গেলে সব বলেই মারছিল, অনেক ঝুঁকি নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, তাকে ভুল শট খেলতে প্রলুব্ধ করা যাবে”।

“আকরামকে গিয়ে বললাম, ‘আরেকটা ওভার দাও, দেখি চেষ্টা করে।’ পেলাম বোলিং। টেন্ডুলকার আরেকটি চার মারল। এরপর পরিষ্কার মনে আছে, একটি স্লোয়ার করলাম। সে উড়িয়ে মারতে গিয়ে বল তুলল আকাশে। কাভারে বুলবুল (আমিনুল ইসলাম) ক্যাচ নিল। আমি এবার আকরামকে গিয়ে বললাম, ‘থ্যাংক ইউ, বোলিং দেওয়ার জন্য।’ ওই ম্যাচটিই আমার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।”

“ওই টুর্নামেন্টে আরেক ম্যাচে রাহুল দ্রাবিড়কেও আউট করেছিলাম। কট অ্যান্ড বোল্ড। টেন্ডুলকার ও দ্রাবিড়ের মত ব্যাটসম্যানকে আউট করা, খুব খারাপ স্মৃতি নয়!”