অভিষেকে পাকিস্তানকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বাদশা

৩৬ বছর ২৫৫ দিন। অনেকের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় এই বয়সে। কিন্তু জাহাঙ্গীর শাহ বাদশার হয়েছিল অভিষেক! বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে আন্তর্জাতিক অভিষেকের সেই রেকর্ড টিকে আছে এখনও। তবে বয়সের সংখ্যায় নয়, ম্যাচটি তিনি স্মরণীয় করে রেখেছেন বোলিং দিয়ে। দলের ছোট্ট পুঁজির পরও অসাধারণ বোলিংয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপ।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 March 2020, 03:57 AM
Updated : 31 March 2020, 03:57 AM

বাংলাদেশেরও ছিল সেটি প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ শ্রীলঙ্কায় এশিয়া কাপের ম্যাচে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। দেশের ও বাদশার অভিষেকের ৩৪ বছর পূর্ণ হলো মঙ্গলবার।

মোরাতুয়ার টাইরন ফার্নান্দো স্টেডিয়ামে সেদিন টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ ৯৪ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের সামনে। ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান নিয়েছিলেন ২টি। লেগ স্পিনার আব্দুল কাদির ৩টি। সেই স্কোর নিয়েও বাংলাদেশ লড়াই খারাপ করেনি। পাকিস্তান উইকেট হারিয়েছিল ৩টি। জয় পেতে খেলতে হয়েছিল ৩২.১ ওভার।

ম্যাচে বাংলাদেশের সেরা পারফরমার ছিলেন বাদশা। ৯ ওভারের টানা স্পেলে ২৩ রানে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। আউট করেছিলেন পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ওপেনার মহসিন খান ও তিনে নামা রমিজ রাজাকে।

বাদশার বয়স এখন পেরিয়ে গেছে ৭০। স্মৃতি প্রতারণা করে প্রায়ই। তবে নিজের আর দেশের অভিষেক ম্যাচের অনেক কিছুই মনের পটে ভেসে ওঠে স্পষ্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি ফিরে গেলেন ৩৪ বছর আগে।

‘চেয়েছিলাম আগ্রাসী থাকতে, লড়াই করতে’

“মাঝেমধ্যে বিদেশি দলগুলির সঙ্গে খেলার সুযোগ হতো আমাদের। এমসিসি আসতো আমাদের দেশে, ডেকান ব্লুজ আসত, আইসিসি ট্রফি খেলেছিলাম আমরা। এমসিসি বেশ শক্তিশালী দল পাঠাত। মার্ক নিকোলাস খেলে গেছে। আরও নামকরা কিছু ক্রিকেটোর খেলেছেন, এখন নাম অতটা মনে নেই। বাইরের দলের সঙ্গে ম্যাচ তাই আমরা খেলেছি বেশ। তবে আন্তর্জাতিক ম্যাচের ব্যাপার তো আলাদা। রোমাঞ্চ তাই ছিল সবার।”

“নিজেদের প্রথম ম্যাচের আনন্দ তো ছিলই। প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান, কত বড় বড় তারকা ছিল ওদের। তাদের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা, নিজেদের স্কিল দেখানো, লড়াই করার সুযোগ, এসবও আমাদের জন্য বড় পাওয়া ছিল।”

“আমরা চেষ্টা করেছি, উত্তেজনাটাকে দমিয়ে রেখে প্রতিটি ম্যাচ ধরে খেলতে। আমাদের দল কিন্তু খুব ভালো ছিল। সিনিয়র ক্রিকেটার, তরুণ প্রতিভা ও বেশ কজন অলরাউন্ডার মিলিয়ে দারুণ ব্যালান্সড দল ছিল। আমরা ভড়কেও যাইনি।”

“আমাদের বড় দুর্ভাগ্য ছিল টস হেরে যাওয়াটা। উইকেটে আর্দ্রতা ছিল অনেক। ওদের পেস আক্রমণ দুর্দান্ত। সেখানেই আগে ব্যাট করতে হয়েছে। আমরা আগে বোলিং করলে হয়তো ওদের আরও কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলতে পারতাম।”

“ব্যাটিংয়ে আমরা ভালো করতে পারিনি। ওয়াসিম, ইমরান দারুণ বোলিং করেছিল। আমার ব্যাটিংয়ে নামার পর বেশ মজা হয়েছিল। কারণ আমি হেলমেট পরে নামিনি। পাকিস্তানীরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। ওয়াসিম তখন অনেক জোরে বল করে। কিন্তু আমার আসলে হেলমেট পরার অভ্যাস ছিল না। ভালো লাগত না। আর আমি বেড়ে উঠেছি ম্যাটে ক্রিকেট খেলে। ম্যাটে খেললে সবসময় বলের ওপর চোখ রাখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। হেলমেট ছাড়া নামলেও আমার গায়ে বল লাগত না কখনও। সবাই বারবার বলছিল হেলমেট পড়তে, জাভেদ মিয়াঁদাদসহ অন্যরা মজাও করছিল বেশ। কিন্তু আমি হেলমেট পরিনি।”

“কয়েকটি বল খেলেছিলাম, রান করতে পারিনি (১০ বলে শূন্য)। ওয়াসিম কয়েকটি শর্ট বল করে আমাকে ব্যাক ফুটে ঠেলে দিয়েছিল। এরপর গোলার মতো একটা ইয়র্কার করল লেগ মিডলে। আমি অন ড্রাইভ করতে চেয়েছিলাম। ব্যাটে লাগেনি, বোল্ড। তখন তো আসলে আমাদের কোচ-টোচ ছিল না, বলে দেওয়ার লোক ছিল না। বোলিং মেশিনও ছিল না যে গতিময় বোলিং খেলার প্র্যাকটিস করব। আমাদের জন্য অনেক কঠিন ছিল।”

“আমাদের রান বেশি না হলেও আমরা ঠিক করেছিলাম, ওদেরকে সহজে জিততে দেব না। আমি নিজে ঠিক করেছিলাম, দারুণ আক্রমণাত্মক বোলিং করব। জীবনে কখনও কাউকে ভয় পাইনি ক্রিকেট মাঠে নেমে। প্রতিপক্ষের নাম দেখে ভড়কে যাইনি। মনে আছে, একবার ডেকান ব্লুজ দল খেলতে এলো। ওদের একজন ব্যাটসম্যান ছিল, জয়ন্তিলাল (ভারতের হয়ে টেস্ট খেলা ব্যাটসম্যান কেনিয়া জয়ন্তিলাল)। আমাদের সবাই বলল, দারুণ ব্যাটসম্যান। ৭টা সেঞ্চুরি করে নাকি এসেছে। আমি নেমেই আউট করে দিলাম। ভারতে মইন-উদ-দৌলা ট্রফি খেলতে গিয়েছি, প্রতিপক্ষ এক দলে নাকি ভারতের বড় বড় ব্যাটসম্যান। নেমেই ২ উইকেট নিয়ে নিলাম। আমি কখনও প্রতিপক্ষের নাম দেখিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কনরাড হান্ট এলো এমসিসির হয়ে। আমাকে টানা তিনটা চার মারল। পরে আমি আউট করে দিয়েছি।”

“যাই হোক, ৯৪ রান করার পর আমাদের বোলিং শুরু করল প্রিন্স (গোলাম নওশের) আর সামি (সামিউর রহমান)। লিপু (অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন) আমাকে নানাভাবে ব্যবহার করত। কখনও নতুন বলে, কখনও একটু পরে। ২-৩ ওভারের স্পেল করাত। কখনও একটু বেশি। ওই ম্যাচে আমাকে এনেছিল চার নম্বর বোলার হিসেবে।”

“পাকিস্তান বেশ ভালো শুরু করেছিল। মহসিন খান ও মুদাসসর নজর খুব সাবধানে ব্যাট করছিল। ওদের জুটি জমে যাওয়ার পরও আমি বোলিংয়ে এসে আগ্রাসী ফিল্ডিং সাজালাম। ৭-২ ফিল্ডিং সাজিয়েছিলাম, অন সাইডে শুধু শর্ট মিড অন আর ডিপ স্কয়ার লেগ। মাঝের পুরো জায়গা ফাঁকা।”

“আমার টার্গেট ছিল, আউট সুইঙ্গার করাব। ওরা অন সাইডে ফাঁকা জায়গায় খেলতে চাইবে। মাঝেমধ্যে ভেতরে ঢোকাব বল। কুকাবুরা বলে বল করা আমাদের জন্য ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। দেশে নিম্নমানের ভারতীয় আর পাকিস্তানী বলে খেলতাম আমরা। মাঝেমধ্যে ম্যাচে ভালো বল পেতাম, সেটিও খুব ভালো নয়। তবে প্রথমবার হলেও কুকাবুরা বেশ ভালো সামলেছিলাম আমরা।”

“আমার দুটি উইকেটই এলবিডব্লিউ, দুটিই একই ভাবে। আউট সুইঙ্গার করতে করতে জোরের ওপর ইনসুইঙ্গার করে দিয়েছি। এটা আমার স্পেশাল ডেলিভারি ছিল। আমি কিপারকে বলে রাখতাম, ‘থান্ডার আসছে।’ ওরা বুঝে যেত। সবসময় গতি দিয়ে বোলিং করতাম না আমি। ওই ইনসুইঙ্গারটা করতাম হুট করে অনেক জোরে। উইকেটে পিচ করে বল গুলির বেগে ঢুকে যেত। সারপ্রাইজ ডেলিভারি। ব্যাটসম্যান চমকে যেত আচমকা এত গতির বল পেয়ে। মহসিন খান ও রমিজ রাজা বুঝতেই পারেনি।”

“তিনটা উইকেট পেতে পারতাম। মুদাসসর নজরের ক্যাচ মিস করল সানি (উইকেট কিপার হাফিজুর রহমান)। আউট সুইঙ্গার ছিল সেটা। মুদাসসর খোঁচা দিয়েছিল। স্লিপ রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন মুদাসসর জমে গিয়েছিল, জাভেদ মিয়াঁদাদ উইকেটে ছিল। সিঙ্গেল নিয়ে খেলত। সিঙ্গেল আটকাতে চেয়েছিলাম। স্লিপ থাকলেও হতে পারত ক্যাচটি। পরে লিপু এসে মিয়াঁদাদকে আউট করল।”

“টানা ৯ ওভারের স্পেল করেছিলাম। ম্যাচের পরে পাকিস্তানীরা সবাই খুব প্রশংসা করেছিল। ইমরান, ওয়াসিম, জাকির খান…ওরা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিল আমি এত আগ্রাসী ফিল্ডিং সাজিয়ে ফিল্ডিং অনুযায়ীই বোলিং করে গেছি দেখে।”

“ম্যাচের পর অনেক কাভারেজ পেয়েছিলাম শ্রীলঙ্কায়। ওদের বড় পত্রিকায় আমার দুটি ছবি ছাপানো হয়েছিল, একটি বোলিং অ্যাকশনের, আরেকটি উদযাপনের। পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও ভালো করেছিলাম, তবে উইকেট পাইনি (৬-০-১৮-০)।”

“আমার জন্য ওই টুর্নামেন্ট ব্যক্তিগত দিক থেকে ছিল অনেক ভালোলাগার। অনেক দিন থেকে খেলছিলাম। আমার সবসময় শক্ত দলের বিপক্ষে খেলতে ভালো লাগত। ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক সময়ই অনেক ম্যাচে নিজেকে অনুপ্রেরণা জোগাতে পারতাম না। অনেক ম্যাচে এফোর্ট দিতে মন টানত না। কিন্তু কঠিন ম্যাচ হলে আমি জ্বলে উঠতাম। বড় ম্যাচের জন্য অপেক্ষা করতাম।”

“এরপরও কয়েক বছর খেলে গেছি। আমি তো ফুটবলও খেলতাম। লেফট ফুল-ব্যাক ছিলাম। পূর্ব পাকিস্তান যুব দলে খেলেছি। ঢাকা জেলা দল, ওয়ারিতে খেলেছি সিনিয়র ডিভিশনে। তই ফিটনেস ভালো ছিল। নেটেও অনেক সময় কাটাতাম।”

“ছোট্ট আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আমার সেরা স্মৃতি ওই ম্যাচ অবশ্যই। তবে আমি খুব ভাবি না। এখন আমাদের দেশ কত ভালো খেলে! এই যে এত রেকর্ড করছে ওরা, এত অর্জন, আমাদের ওসব কে মনে রাখে! সত্যি কথা বলতে, ক্রিকেট অনেক এগিয়ে গেছে। অনেক ভালো ভালো ছেলে আসছে আমাদের। ওদের দেখতেই আমার ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে খেলা দেখে মনে হয়, ‘এই কাজটা ওভাবে করলে পারত’, তখনই আবার মনে হয়, এখন এত এত কোচ, ছেলেরা এত ভালো বোঝে, ওরাই ঠিক করে ফেলবে। নিজের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকার চেয়ে ওদের দেখতেই আমার ভালো লাগে।”