ইয়াসির-সাইফদের কাছে আরও বেশি চান নির্বাচকেরা

জাতীয় দলে নতুন প্রাণের সঞ্চার চান নির্বাচকেরা। কিন্তু তাদের আশা যাদের ঘিরে, তারাই আছেন ঝিমিয়ে! জাতীয় দলের দুয়ারে সজোরে কড়া নাড়তে পারছেন না তেমন কেউই। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের খুব কাছেই মনে করা হচ্ছিল যাদের, সেই সাইফ হাসান ও ইয়াসির আলী চৌধুরীর পারফরম্যান্স ভরাতে পারছে না মন।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2019, 11:34 AM
Updated : 4 Oct 2019, 12:26 PM

প্রতিভাবান দুই ব্যাটসম্যানের কাছে নির্বাচকদের চাওয়া আরও বেশি কিছু।

গত বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের বাংলাদেশ দলে ছিলেন ইয়াসির। ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। সাইফ এখনও মূল দলে সুযোগ পাননি। তবে ডাক পেয়েছিলেন প্রাথমিক দলে। দুজনই অপেক্ষায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের। তাদের অপেক্ষায় বাংলাদেশ দলও।

কিন্তু সেই অপেক্ষা কেবল দীর্ঘায়িতই হচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরেই জাতীয় দলের আশেপাশে থাকলেও শেষ ধাপটুকু পেরোতে পারছেন না দুজন। আশেপাশের ম্যাচগুলিতে যে যথেষ্ট ধারাবাহিক নন তারা!

দুজনের উঠে আসা

ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফরমার দুই জনই। ২১ ছুঁইছুঁই সাইফ দুটি যুব বিশ্বকাপ খেলেছেন। একটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশকে। বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকেই তাকে মনে করা হচ্ছে বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের জন্য আদর্শ। তার টেকনিক, টেম্পারামেন্ট প্রশংসিত সেই পর্যায় থেকেই।

২৩ বছর বয়সী ইয়াসির বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে জাতীয় পর্যায়ে সেভাবে নজর কাড়তে পারেননি। তবে ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। তার ধারাবাহিকতাও বেশি বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটেই।

তবে দুজনই সময়ের সঙ্গে বেশ উন্নতি করেছেন সীমিত ওভারের ব্যাটিংয়ে। বেড়েছে শটের পরিধি। গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে সাইফ ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। ১৬ ইনিংসে ৮১৪ রান করেছিলেন ৬২.৬১ গড়ে, সেঞ্চুরি ছিল ৩টি, ফিফটি ৪টি। ইয়াসির ১১ ইনিংসে ৪৪১ রান করেছিলেন ৭৩.৫০ গড়ে। নজরকাড়া ছিল তার স্ট্রাইক রেটও, ৯৬.০৭।

ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্সেই নিয়মিত দুজনের সুযোগ মিলছে পরের ধাপের ম্যাচগুলোয়। ‘এ’ দল, হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) দল, ইমার্জিং দল বা বিসিবি একাদশে খেলছেন নিয়মিত। রানও করছেন। কিন্তু রানের এমন কোনো জোয়ার নেই, যা তাদের বয়ে আনতে পারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। 

কদিন আগেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে ভারত সফর করে এলেন দুজন। সেখানে চারটি একদিনের ম্যাচে সাইফের রান ছিল ২৭, ৭, ৬৪ ও ১২। ইয়াসিরের পারফরম্যান্স ছিল আরও হতাশাজনক, ১, ৫, অপরাজিত ৭ ও ৬।

তার আগে বাংলাদেশ ইমার্জিং দলের হয়ে দুজন খেলেছেন শ্রীলঙ্কা ইমার্জিং দলের বিপক্ষে। সেই সিরিজে বেশ রান করেছিলেন সাইফ। তিনটি একদিনের ম্যাচে করেছিলেন ৫০, ২৭ ও ১১৭। ইয়াসির এক ম্যাচে খেলেছিলেন ৫ ছক্কায় ৮৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। কিন্তু অন্য দুই ম্যাচে রান ছিল ০ ও ৯।

লঙ্কানদের বিপক্ষে চার দিনের ম্যাচের সিরিজে কথা বলেনি দুজনের কারও ব্যাট। তিন ইনিংসে সাইফের রান ছিল ১৮, অপরাজিত ৪০ ও ৪। ইয়াসিরের রান ৪, ৩ ও শূন্য। ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজের আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে বিসিবি একাদশে সুযোগ পেয়ে ইয়াসির করেছিলেন ১০ বলে ৬।

নির্বাচকের চোখে

নির্বাচক ও ম্যানেজার হিসেবে এই সিরিজগুলোয় দুজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন হাবিবুল বাশার। সাইফ ও ইয়াসিরের পারফরম্যান্স তার কাছে ভালো-মন্দের মিশেল।

“হ্যাঁ, সত্যি বলতে, আমাদের ভাবনায়ও ওরা দুইজন জাতীয় দলের কাছাকাছি। তবে এই ম্যাচগুলোয় পারফরম্যান্স খুব সন্তোষজনক নয়। সাইফ অবশ্য খুব খারাপ করেনি। ভারতে ‘এ’ দলের হয়ে ভালোই করেছিল। শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছে একটি। পরে আবার রান করেনি। ভারতে গিয়ে ১০০ ও ৬০ করেছে। পরে আবার করেনি।”

“ইয়াসির যখন এলো, খুব ভালো করে এসেছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ওর ৮৫ রানের ইনিংসটি দুর্দান্ত ছিল। আন্তর্জাতিক মানের ইনিংস। কিন্তু পরে আর রানই করছে না। এভাবে একজন ক্রিকেটারকে বিচার করা কঠিন।”

এই জোয়ার-ভাটার পারফরম্যান্স দিয়ে যে জাতীয় দলে আসা কঠিন, সেটিও পরিষ্কার করে দিয়েছেন হাবিবুল। তিনি দেখতে চান এই দুজনের ব্যাটে রানের ধারাবাহিক স্রোত।

“অবশ্যই যথেষ্ট করছে না ওরা। আমাদেরকে বাধ্য করতে পারছে না জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা করতে। আরও অনেক রান চাই ওদের কাছে। আরও ধারাবাহিক হতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়ার আগে এই সব পর্যায়ে অনেক রান করতে হবে। যত বেশি সম্ভব করতে হবে। যেটা ওরা করতে পারছে না।”

“সাম্প্রতিক ভারত সফরের কথাই ধরুন। ওদের অনূর্ধ্ব-২৩ দলের অধিনায়ক প্রিয়ম গার্গ প্রায় প্রতি ম্যাচেই রান করেছে। বা রান করলেই বড় রান করেছে। বয়স তার মাত্র ১৮। কিন্তু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভালো করে তার পরের ধাপেও ভালো করছে। আমাদের ক্রিকেটারদেরও তা করতে হবে।”

বাংলাদেশে বেশির ভাগ সময় বয়সভিত্তিক কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে সরাসরি জাতীয় দলে আনা হয়েছে ক্রিকেটারদের। আরেকটু বড় পর্যায়ে দেখার সুযোগ হয়েছে সামান্যই। কিন্তু গত কিছুদিনে ‘এ’ দল, ইমার্জিং দল, হাই পারফরম্যান্সের খেলা হয়েছে প্রচুর। সাইফ-ইয়াসিররা সেসব ম্যাচে নিয়মিতই খেলেছেন।

প্রতিভা আছে, যত্ন করা হচ্ছে, সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তারপরও কেন পারছেন না তারা? হাবিবুল নিজেও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।

“জানি না মূল সমস্যা কোথায়। ওদের সবকিছুই দেওয়া হচ্ছে। সময়, সুযোগ-সুবিধা, সমর্থন, সবই পাচ্ছে। তারপরও কেন পারবে না? অনেক কথা বলছি, উৎসাহ দিচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা, ওরা অনেক সুযোগ পাচ্ছে। একের পর এক খেলা হচ্ছে। ক্রিকেট বোর্ড কিন্তু অনেক খেলার ব্যবস্থা করছে ওদের জন্য। আগে ঘরোয়া থেকেই নিতে হতো, এখন এরকম ‘এ’ দল বা এইচপির খেলা হচ্ছে। ওদের না পারার কারণ নেই।”

“টেকনিক্যাল সমস্যা আছে খুব মনে হয় না। হতে পারে মানসিকতার সমস্যা। সম্প্রতি অনূর্ধ্ব-২৩ দলের সফরের সময় আমি ভারতীয় দলটির কোচদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা সবাই বলেছে, আমাদের ছেলেরা বেশ ভালো। এখন, খুব ভালো সামর্থ্য, কিন্তু রান করতে পারছি না, তাহলে তো লাভ নেই!”

সামনের পথচলা

এই দুজনকে নিয়ে হাবিবুলের হতাশা আছে। আস্থার জায়গায় চোটও লেগেছে। তবে এখনও হতাশার চেয়ে আশার পাল্লা বেশি ভারী তার কাছে। তাই জানালেন, তাদেরকে আরও সুযোগ দেওয়া হবে।

“ওদের অগ্রগতি হতাশার তো বটেই। তবে আমি এখনই হাল ছাড়ছি না। ভেতরে কোথাও আমার বিশ্বাসটা আছে যে এই ছেলেগুলোর সামর্থ্য আছে। এজন্যই একটু সময় দিতে চাই। এখনই অবশ্যই জাতীয় দলে দেখতে চাই না। আরও ২-১ বছর দেখতে চাই। আরও বিনিয়োগ করতে চাই। তারপর আগামী ১-২ বছর পর যখন আসবে জাতীয় দলে, প্রস্তুত হয়ে যেন আসে।”

তবে সেই আশারও শেষ আছে। দেখার শেষ আছে। সুযোগের শেষ আছে। সবকিছুর শেষে যে সামনে তাকাতে হবে, সেটিও মনে করিয়ে দিলেন হাবিবুল।

“ওরা যদি সুযোগ কাজে না লাগায় তাহলে অন্য কেউ ওদের জায়গা নিয়ে নেবে। ওদেরকেও সেটা বলছি যে, ‘ভেবো না তোমরা সুযোগ পেতেই থাকবে। হুট করে দেখবে কেউ এসে জায়গা নিয়ে নিয়েছে।’ এটাই নিয়ম। এখন ওরা এটা যত দ্রুত বোঝে, ততই ভালো।”

এবং অন্যরা

সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দলে আশেপাশের আরও বেশ কয়েকজনের খেলা মনে ধরেছে হাবিবুলের। দেখছেন সম্ভাবনা। নাম ধরে বলতে যদিও শুরুতে আপত্তি ছিল, তার পরও কয়েকজনের কথা বললেন নিজেই।

“ফারদিনকে (ফারদিন হাসান, বাঁহাতি টপ অর্ডার) দেখে মনে হয়েছে ভালো সম্ভাবনা আছে। শফিকুল আছে, বাঁহাতি পেসার। গতি বেশি নেই, তবে সুইং করাতে পারে। মেহেদিকে (অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার) তো অনেক দিন থেকেই দেখছি। এখনও ভালো সম্ভাবনা আছে ওর।”

সম্ভাবনার আলোচনাতেই চলে এলো আরেক জনের প্রসঙ্গ। যাকে নিয়ে একসময় অনেক আশা ছিল দেশের ক্রিকেটের, নির্বাচকদের। কিন্তু আশা পূরণের পথ ধরে শক্ত ভাবে হাঁটতে তিনি পারছেন না। জাকির হাসান।

বয়স যদিও কেবলই ২১, সময় আছে অনেক। কিন্তু বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের অগ্রগতি খুব সন্তোষজনক নয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব ধারাবাহিক হতে পারেননি তিনি। তার ‘এ’ দল, একাডেমি, এইচপি দলে সুযোগ পেয়েছেন নিয়মিত, মূলত তার প্রতিভা ও সম্ভাবনার কারণেই। তার পেছনেও আছে অনেক বিনিয়োগ। কিন্তু ফল মিলছে সামান্যই।

জাকিরকে নিয়েও হতাশার টান হাবিবুলের কণ্ঠে। তবে আরও সময় ও সুযোগ দিতে চান তাকেও।

“জাকির কিন্তু এমনিতে খুব ভালো ব্যাটসম্যান। ব্যাক ফুটে খুব ভালো খেলে। অসাধারণ ফিল্ডার। দারুণ প্রতিভাবান। কিন্তু রান করতে পারছে না। লাভ কী তাহলে!”

“জাকির ও আরও কয়েকজন, যথেষ্ট ভালো করতে পারেনি, ধারাবাহিক হতে পারেনি, এজন্য এখন দলে নেই। জাকিরসহ ওদের ব্যাচের কয়েক জনের কিন্তু এখন জাতীয় দলে খেলার কথা! ওরা পারেনি, কেবল ওদেরই কারণে, আর কিছু না। আরও বছরখানেক দেখব ওদের। তারপর ভাবব আবার।”