সাকিবকে বলেছিলাম ঝুঁকি নিয়ে না খেলতে: বিসিবি সভাপতি

চাওয়া ছিল, তবে চাপ ছিল না। এশিয়া কাপ খেলতে সাকিব আল হাসানকে একটুও জোর করা হয়নি, দাবি করছেন নাজমুল হাসান। বরং ঝুঁকি থাকলে এই টুর্নামেন্ট না খেলতেই সাকিবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানালেন বিসিবি সভাপতি।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Oct 2018, 11:08 AM
Updated : 9 Oct 2018, 11:29 AM

বাঁ হাতের কনিষ্ঠায় চিড় নিয়ে এশিয়া কাপ খেলতে গিয়েছিলেন সাকিব। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল প্রচুর। চোট থাকার পরও ব্যথানাশক ইনজেকশন আর ওষুধ নিয়ে এই অলরাউন্ডার এশিয়া কাপে চারটি ম্যাচ খেলেছেন। তবে সুপার ফোরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগে হুট করেই আঙুল ফুলে ওঠায় ফিরে আসেন দেশে।

ফেরার পর দিনই আঙুলে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। তার হাত থেকে বের করা হয় অনেকটুকু পুঁজ, ডাক্তাররা জানান সংক্রমণ হয়ে গেছে আঙুলে। কয়েকদিন হাসপাতালে অবস্থা সামাল দেওয়ার পর তাকে পাঠানো হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়।

আঙুলের সংক্রমণের পর ফিরে এসেছে পুরোনো বিতর্ক, কেন তাকে খেলতে পাঠানো হলো এশিয়া কাপে! বিসিবি সভাপতি কিংবা বোর্ডের প্রচ্ছন্ন কিংবা প্রকাশ্য চাপ ছিল, এ রকম অভিযোগ উঠছে।

তবে সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন নাজমুল হাসান। মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিসিবি প্রধান জানালেন, হজের সময় সাকিবের সঙ্গে যখন তার কথা হয়েছিল, সাকিব নিজেই খেলার আগ্রহের কথা বলেছিলেন।

“মক্কা ও মদিনা, দুই জায়গাতেই আমার সঙ্গে ও দেখা করল। মক্কায় জিজ্ঞেস করল যে কি করবে। আমি বললাম, ‘এটা তোমাদের সিদ্ধান্ত।’ মদিনায় এসে শেষ আমি ওকে বললাম, ‘দেখো, তুমি এরকম ঝুঁকি নিও না, ডাক্তার-ফিজিওর সঙ্গে কথা বলো। সেরা কোনো ডাক্তারকে দেখিয়ে তার পর সিদ্ধান্ত নাও।’ ও আমাকে বলল, ‘ফিজিও বলে দিয়েছে কোনো সমস্যা নেই।”

“আমি আবার ওকে বললাম, ‘খেললে কি এটা খারাপ হতে পারে নাকি?’ ও বলল, ‘না।’ এরপরও আমি ওকে বলিনি খেলতে। আমি ওকে বলেছি, ‘একজন ভালো ডাক্তার দেখাও। তার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করো।’ এটাই ছিল ওর সঙ্গে আমার শেষ কথা।”

বিসিবি সভাপতির দাবি, সাকিব এশিয়া কাপ খেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটাও তিনি বেশ পরে জানতে পেরেছেন।

“হ্জ করে ঢাকায় ফেরার চার দিন পর আমি কোচের একটা মেইল পেলাম যে সাকিব দলের সঙ্গে যাচ্ছে না। আমেরিকা থেকে সরাসরি এশিয়া কাপ খেলতে যাবে। ওই প্রথম আমি জানলাম যে সাকিব এশিয়া কাপ খেলছে। তার আগ পর্যন্ত জানিই না যে ও খেলবে।”

নাজমুল হাসান জানালেন, এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগে আঙুলের অবস্থা দেখে তিনিই সাকিবকে বলেন এই অবস্থায় না খেলতে।

“পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচের আগে আমি দেশে এসে, একদিন পর আবার ফিরে যাই। হোটেলে গিয়ে দেখি সাকিব কয়েকজনের সঙ্গে বসে আছে। ওখানে ওর হাত দেখে আমি অবাক হয়ে যাই, অনেক ফোলা। আগেও ওর হাত দেখেছি, এরকম অবস্থা ছিল না। ও কথায় কথায় তখন বলল, ‘আমি তো খেলতে পারব না।’ কয়েকজন পাশ থেকে বলছিল যে, ‘না খেলতে হবে, এটা সেমি-ফাইনাল।’ আমি তখন স্পষ্ট বলেছি, ‘সাকিব, তুমি এখনই চলে যাবে। এখান থেকে কোথায় যেতে চাও বলো।’ ও বলল, ‘আমেরিকায় যাব।’ আমি বলেছি, ‘এখনই যাও। কোনো খেলাধুলার দরকার নেই।”

সাকিব যে দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে না গিয়ে দেশে ফিরেছেন, পরে আবার অস্ট্রেলিয়া গেছেন, এসবও অনেক পরে জেনেছেন বলে দাবি করলেন বিসিবি সভাপতি।

“পরদিন আমি শুনলাম ও অ্যাপোলো হাসপাতালে। তার আগে আমি জানতাম ও আমেরিকায়, কারণ আমাকে বলেছিল আমেরিকা যাবে। হয়ত কোনো কারণে যায়নি। আমি শুনে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললাম। সব ঠিকঠাক করলাম।’

‘ও বলেছিল যে আগে লন্ডন যেতে চায়। হাসপাতালে এটাই ঠিক করা হয়েছিল। লন্ডনে দেখার পর ঠিক হবে কোথায় করা হবে অপারেশন। এর পর আমি ইস্তাম্বুল গেলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম যে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়।”

এশিয়া কাপ খেলার সময় ফিজিওর প্রতিনিয়ত পরিচর্যার পরও সাকিবের হাতে সংক্রমণ কিভাবে হলো, এত পুঁজ জমা হওয়ার ব্যাপারটি কেন কেউ বুঝতে পারলেন না আগে, এই প্রশ্নগুলো গত কিছুদিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। পাওয়া যাচ্ছে না সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা। বিসিবি সভাপতি জানালেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে বোর্ডও।

“কালকে ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম যে ডাক্তাররা কি বলছে, এরকম হলো কেন। কারণ, ও তো খেলতে গিয়ে ব্যথা পায়নি। আমাদের কাছে এটা বিরাট প্রশ্ন যে হঠাৎ করে ইনফেকশনে হয়ে এত পুঁজ, এসব হলো কি করে? এটা জানার চেষ্টা করছি।”

“আমি দেবাশীসের (বিসিবির প্রধান চিকিৎসক) ও অন্যান্যদের কাছে জানতে চেয়েছি এ রকম হলো কেন। একদিনের মধ্যে এত পুঁজ, এরকম ইনফেকশন হলো কিভাবে? সবার কাছেই এটা আশ্চর্যের বিষয়। কেউ বুঝতে পারছে না কিভাবে হলো, কারণ ভেতরের ব্যাপার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যে ইনজেকশন দিয়েছে, সেটা থেকেও হতে পারে। হাতে আগে থেকেই হালকা ইনফেকশন থাকলে ইনজেকশনে আরও বাড়তে পারে। তবে সবই ধারণা, আসল কারণ কেউই বুঝতে পারছে না। সাকিব নিজেও আগে অভিয়োগ করেনি। সব মিলিয়ে ইনফেকশনের মূল কারণ আমরা এখনও জানি না। আপনারা যেমন জানতে চান, আমরাও জানার চেষ্টা করছি।”

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ শেষে দেশে ফিরে সাকিব বলেছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব অস্ত্রোপচার করিয়ে ফেলতে চান। সেই সময় বিসিবি সভাপতি বলেছিলেন, তিনি চান সম্ভব হলে সাকিব যেন এশিয়া কাপ খেলে তার পর অস্ত্রোপচার করান। সরাসরি চাপ না দিলেও বিসিবি সভাপতির কথা প্রচ্ছন্ন চাপ ছিল কিনা, সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। বিসিবি সভাপতি এবার ব্যাখ্যা দিলেন নিজের কথার।

“আমি বলেছিলাম, যদি খেলতে পারে, যদি কিছু না হয়, তাহলে এশিয়া কাপের পরে হতে পারে সার্জারি। অনেকে ভাবছে যে কেন বললাম আমি। এখন মুশফিক ইনজুরি নিয়ে খেলছে, মাশরাফি প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে খেলছে, এমনকি মিরাজও বড় ক্র্যাম্প নিয়ে ফাইনাল খেলেছে। তামিমকে কি আমরা বলেছিলাম মাঠে নামতে? আমি এটাই বলেছিলাম যদি পারে তাহলে খেলতে। কোনো চাপ নেই।”

সাকিবের এই চোটের সূত্রপাত গত জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে। সাকিব পরে মাঠে ফেরেন মার্চে শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফি দিয়ে। ওই টুর্নামেন্টে যদিও তার খেলার কথা ছিল না, কিন্তু বিসিবি সভাপতি ফোন করে ডেকে তাকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন অভিযোগ উঠেছিল, চোট পুরোপুরি সেরে ওঠার আগেই সাকিবকে মাঠে নামতে বাধ্য করেছিলেন বিসিবি সভাপতি।

বিসিবি সভাপতি বললেন অন্য কথা। সেই ঘটনার সঙ্গে এবারের যোগসূত্রও মিলিয়ে দিলেন।

“নিদাহাস ট্রফির আগে ব্যাংককে, অস্ট্রেলিয়ায় ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে। ওর পছন্দ মতোই করেছে। এরপর যখন আইপিএল খেলার জন্য পাসপোর্ট জমা দিয়ে এসেছে, তখন আমি ওকে ফোন করলাম যে তাহলে নিদাহাস খেলতে পারবে নাকি। কারণ ডাক্তাররা বলে দিয়েছে সে আইপিএল খেলতে পারবে, সে নিজেও বলছে পারবে। তাহলে দুই দিন আগে আমাদের হয়ে খেললে সমস্যা কি?”

“এবারও এটাই হয়েছে। বলেছিলাম যদি পরে করানো যায় অপারেশন, তাহলে করাতে। কিন্তু যদি ব্যথা থাকে, তাহলে তোর জোর করে খেলানোর প্রশ্নই আসে না।”

সাকিবের চোটের অবস্থা, তার মাঠে ফেরার ভবিষ্যত নিয়ে অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়েছে গত কয়েক দিনে। উঠেছে অনেক গুঞ্জন। বিসিবি সভাপতি আশ্বাস দিলেন, ভালোর পথেই এগোচ্ছে সাকিবের অবস্থা।

“ও ভালো হয়ে যাবে। এখনও পর্যন্ত খুব ভালো ভাবে রিকভারি হচ্ছে। কালকেই কথা হয়েছে। ও আমাকে যেটা বলেছে যে, ডাক্তাররা বলেছে তিন মাস পর খেলতে পারবে। অপারেশনের কথা জিজ্ঞেস করেছি। বলল যে অপারেশন করে কোনো লাভ নেই। আপাতত অপারেশন লাগবে না। এখন ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে।”