লেগ স্পিনার রিশাদকে নিয়ে অনেক আশা নির্বাচকদের

লেগ স্পিনার মানেই একটু বাড়তি আগ্রহ। তার ওপর ছেলেটি বেশ লম্বা। বাড়তি বাউন্স মেলে। লাইন-লেংথ দারুণ। টার্ন কিছু আছে, সহজাত গতিও ব্যাটসম্যানকে ভোগানোর মতো। সব শুনে নির্বাচকরা দেখতে গেলেন নেটে। কয়েকদিন দেখেই মুগ্ধ। হাই পারফরম্যান্সের অনুশীলনে বোলিংয়ে উন্নতি হলো আরও। বাড়ল নির্বাচকদের মুগ্ধতা। এতটাই ভালো লাগল যে সরাসরি ডাকা হলো বাংলাদেশ ‘এ’ দলে। নাম রিশাদ হোসেন।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2018, 07:19 AM
Updated : 30 June 2018, 07:42 AM

একজন কার্যকর লেগ স্পিনার খুঁজে বের করার মরিয়া চেষ্টায় নির্বাচকদের নতুন বাজি রিশাদ। শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষে অনঅফিসিয়াল টেস্ট সিরিজের বাংলাদেশ ‘এ’ দলের স্কোয়াডে রাখা হয়েছে ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা লেগ স্পিনারকে। একাদশে জায়গা পাননি প্রথম ম্যাচে। তবে জাতীয় নির্বাচক হাবিবুল বাশার জানালেন, পরের দুটি চারদিনের ম্যাচের অন্তত একটিতে রিশাদকে খেলাতে চান তারা।

জাতীয় দল নয় বলে হয়ত আলোড়ন কম। নইলে নীলফামারীর একটি একাডেমি থেকে ১৫ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ‘এ’ দলে জায়গা করে নেওয়া রূপকথার মতোই। স্বীকৃত ক্রিকেট বলতে গত মার্চে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে আফগানিস্তান অনূর্ধ্ব-১৭ দলের বিপক্ষে ৫টি ম্যাচ। তাতেই চলে এসেছেন ছায়া জাতীয় দলে!

গত বছর স্পিনার হান্টে যোগ দেওয়া থেকেই জীবনের বাঁক বদলের শুরু। নীলফামারী সদর উপজেলার নিজপাড়া গ্রামের ছেলে রিশাদ। অনুশীলন করতেন শহরের একটি ক্রিকেট একাডেমিতে। গত বছর যখন বিসিবির সঙ্গে মিলে দেশজুড়ে স্পিনার খোঁজার অভিযান শুরু করল মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবি। একাডেমির কোচদের পরামর্শে রিশাদ নাম লেখালেন প্রতিযোগিতায়। এর পর যেন কেবল চলন্ত সিড়িতে চেপে উঠে আসা।

জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও জিতে রিশাদ এলেন জাতীয় পর্যায়ে। সেখানেও নজর কাড়লেন বিচারকদের। শেষ পর্যন্ত স্পিনার হান্টের বিজয়ী হতে পারেননি, তবে ছিলেন সেরা দশে। নিখুঁত নিশানা ও ধারাবাহিকতার জন্য পেয়েছিলেন সেরা ‘অ্যাকুরেসি’ স্পিনারের পুরস্কার।

সেদিন ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার অফ স্পিনার ও প্রতিযাগিতার বিজয়ী নাঈম আহমেদকে নিয়েই হইচই ছিল বেশি। রিশাদ ছিলেন আড়ালে। পরে তিনিই ছড়িয়েছেন সবচেয়ে বেশি আলো।

স্পিনার হান্টের বিজয়ীদের নিয়ে দুটি ক্যাম্প করেছিল বিসিবি। সেখানে আলাদা করে নিজেকে চেনান রিশাদ। গত মার্চে জায়গা পান বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। এর আগে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে টুকটাক বয়সভিত্তিক দলে খেললেও জাতীয় পর্যায়ে ছিল সেটিই প্রথম। ভারত সফরে খেলেন আফগানদের বিপক্ষে সিরিজে।

স্পিন ক্যাম্প থেকেই নির্বাচকদের চোখ ছিল তার ওপর। স্বীকৃত ক্রিকেটে একদম আনকোরা স্পিনারকেই তারা জায়গা দেন হাই পারফরম্যান্সের স্পিন স্কোয়াডে। সেটি যদি বিস্ময়কর হয়, পরের ধাপ ছিল মহাবিস্ময়। সরাসরি ‘এ’ দল!

ঘোর লাগা সময়

বয়স ১৭, মাত্রই এবার এসএসসি পাশ করেছেন। গত এক বছরে পেছন ফিরে তাকালে রিশাদের নিজেরই কেমন অবিশ্বাস্য লাগে। ক্রিকেট খেলতেন মূলত মনের আনন্দে। কিন্তু জীবন তাকে নিয়েই বিস্ময়কর খেলার অপেক্ষায়, সেটা কী আর ভাবতে পেরেছিলেন!

ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন মনের কোনে ছিল বটে। তবে জানতেন, পথটা অনেক লম্বা। অনেক বন্ধুর। জাতীয় পর্যায়ে খেলা তো ভাবনার সীমানায়ই ছিল না। স্পিনার হান্ট তাকে এক লহমায় তুলে আনল স্বপ্নপূরণের আঙিনায়। তিনি নিজে ভাবলে যতটা ভালো লাগে, তার চেয়েও বেশি জাগে তার বিস্ময়।

‘এ’ দলে খেলার ওজন বা গুরুত্বও হয়ত সেভাবে বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে তাকে নিয়ে গুঞ্জন, নির্বাচকদের আশা, বড় কোনো সুযোগ অপেক্ষায়, সেটি বুঝতে পারছেন রিশাদ।

“স্পিনার হান্টের সময় যখন মিরপুর একাডেমি মাঠে গেলাম, সেটিই আমার জন্য ছিল অনেক বড় ব্যাপার। সেখান থেকে এক দ্রুত ‘এ’ দলে, এত বড় বড় ক্রিকেটারের সঙ্গে ড্রেসিং রুমে, কত জাতীয় দলের ক্রিকেটার আছেন এখানে, ভাবলেই আমার অবাক লাগে।”

কিভাবে কী হয়ে গেল, রিশাদ নিজেও বুঝে উঠতে পারেন না। শুধু এটুকু জানেন, ভালো বোলিং করতে হবে।

“ক্যাম্পের সময় কোচরা বলতেন যে বোলিং ভালো হচ্ছে। এইচপি দলে নির্বাচকরা দেখতে এসেছেন। তার পরও এখনই ‘এ’ দলে সুযোগ পাব, কল্পনাও করিনি।”

“খেলার সুযোগ পাওয়া নিয়ে ভাবছিই না। স্যাররা (কোচ) বলেছেন ভালো বোলিং করে যেতে। সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্র্যাকটিস করছি, একসঙ্গে আছি, অনেক অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এসবই অনেক বড়।”

লেগ স্পিনের মতো কঠিন শিল্প আয়ত্ত করার জটিল পথে কেন পা রাখলেন, সেই প্রশ্নে ধন্দে পড়ে যান। বরাবরই যে লেগ স্পিনই করেন! কাউকে দেখে বা কারও পরামর্শে নয়, শুরু থেকেই তিনি লেগ স্পিনার। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় যেদিন প্রথম ক্রিকেট বল হাতে নিয়েছেন, সেদিনও কবজির মোচড়েই বল ছুঁড়েছেন।

জীবন তাকে এত দ্রুতগতির ট্র্যাকে তুলে দিয়েছে যে, লক্ষ্য বা ভবিষ্যত পথচলা, এসব ভাবনায়ও গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। আপাতত চান দেখতে। শিখতে। ঘাম ঝরাতে। একটু একটু করে উন্নতি করতে। 

সৌজন্য ছবি: জাহিদ রেজা বাবু

নির্বাচকের চোখে

রিশাদকে পাওয়ার উৎসমুখ অনুসন্ধানে শুরুতেই বেরিয়ে এলো একটি তাড়না। নির্বাচক হাবিবুল বাশার বলছিলেন সেই চাওয়ার কথা, “একজন লেগ স্পিনার তো এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে, অনেক দিন থেকেই খুঁজছি আমরা।”

সেই খোঁজাখুজির একটা সূত্র হয়ে তাদের সামনে আসে রিশাদের নাম। তাকে অনুসরণ করে নির্বাচকদের মনে হলো, এই সূত্র ধরেই মিলতে পারে একটি সমাধান। সেই বিশ্বাস থেকেই আনকোরা লেগ স্পিনারের জায়গা ‘এ’ দলে, জানালেন হাবিবুল।

“ক্যাম্পে ওর বোলিং আমাদের ভালো লেগেছে। এইচপিতেও ভালো করছিল। ওখানকার কোচরা খুব ভালো বলেছে।”

“ওকে দেখলে প্রথমেই যেটা নজর কাড়বে, বাংলাদেশের বিবেচনায় বেশ লম্বা। বাড়তি বাউন্স পায়। বাংলাদেশের স্পিনাররা তো সাধারণত সহজাত টার্নার হয় না। রিশাদেরও টার্ন খুব বেশি নেই, লিখনের (জুবায়ের হোসেন) বরং টার্ন বেশি ছিল। তবে রিশাদের পেসটা খুব ভালো। ওপর থেকে একটু জোরের ওপর বল ছাড়ে, অনেকটা কুম্বলে ঘরানার বোলার।”

ভারতীয় কিংবদন্তি অনিল কুম্বলের নাম নেওয়ার পরই হয়ত হাবিবুলের মনে হলো, আরেকটু ব্যাখ্যা করা দরকার।

“লেগ স্পিনার তো অনেক ঘরানার হয়। কুম্বলের নাম নিয়েছি স্রেফ বোলিংয়ের ধরনটা বোঝাতে। আমাদের মনে হয়েছে রিশাদের সম্ভাবনা আছে। কার্যকর হতে পারে।”

“তবে মনে রাখতে হবে, মাত্রই ওর শুরু। এখনও একদম কাঁচা। অনেক কিছু শেখার বাকি। অনেক পথ হাঁটার বাকি। আমরা স্রেফ লেগ স্পিনার ও ভালো মনে হয়েছে বলেই ওকে পরখ করে দেখছি। পরের ‘এ’ দলের দুই ম্যাচের একটিতে অন্তত দেখতে চাই ওকে।”

এবং জুবায়ের

একজন লেগ স্পিনার পাওয়ার নির্বাচকদের এই মরিয়া প্রচেষ্টায় আরেকটি নামের উকিঁঝুকি অবধারিতই। রিশাদের টার্নের প্রসঙ্গে হাবিবুল নিজেই নামটি উচ্চারণ করায় প্রশ্নটি হয়ে ওঠে আরও প্রাসঙ্গিক। জুবায়ের হোসেন কি তবে বাতিলের খাতায়? ২০ বছরের আগেই ৬টি টেস্ট খেলা লেগ স্পিনার, বয়স তো এখনও কেবলই ২২!

‘এ’ দলে নেই জুবায়ের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে প্রাথমিক দলের যে বিশাল বহর ছিল, সেই তালিকায়ও ছিল না নাম। এখন আছেন কেবল এইচপির স্পিন ক্যাম্পে। হাবিবুল নতুন করে শোনালেন সেই পুরোনো কথাই।

“অবশ্যই ওকে নজরে রাখছি আমরা। এইচপিতে সেজন্যই আছে। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে না খেলালে তো আমাদের কাজটা কঠিন হয়ে যায়। ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচরা ঝুঁকি নিয়ে খেলাতে চায় না।”

জুবায়ের

নির্বাচকদের এই যুক্তি একদমই ফেলনা নয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর ঘরোয়া কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচে জুবায়েরকে খেলানো হয়নি। এই সময়টায় একটিই কেবল প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন, গত অক্টোবরে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে আয়ারল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে।

একসময়ের দারুণ সম্ভাবনাময় লেগ স্পিনারের এভাবে আড়ালে চলে যাওয়া, পথ হারানোয় তার নিজেরও দায় দেখেন অনেকে। উন্নতির স্পৃহা, যথেষ্ট পরিশ্রমের ইচ্ছা তার ছিল না, সেই অভিযোগও উঠেছে। তবে গত কয়েক মাসে জুবায়ের চেষ্টা করেছেন নিজেকে বদলানোর। কাজ করেছেন বোলিং ও ফিটনেস নিয়ে। করে যাচ্ছেন এখনও। সেসব নির্বাচকদেরও চোখে পড়েছে। জুবায়েরের জন্য তাই আশার কথা শুনিয়ে রাখলেন হাবিবুল।

“কোচরা ঘরোয়া ক্রিকেটে না খেলালে উন্নতি করা কঠিন। তার পরও আমাদের দায়িত্বের জায়গা থেকে আমরা চেষ্টা করে যাব। দেখা যাক, শ্রীলঙ্কার ‘এ’ দলের বিপক্ষে কোনো ম্যাচে খেলানো যায় কিনা। নইলে সামনে ‘এ’ দলের আরও সিরিজ আছে, ওকে অবশ্যই দেখা যাবে।”