স্টুয়ার্ট ব্রডকে দেখে নতুন গ্রিপ রপ্ত করেছি: মাশরাফি

প্রায় দেড় যুগ কাটিয়ে দিয়েছেন ক্যারিয়ারে। এই পর্যায়ে এসেও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে গড়েছেন সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড। কিভাবে ধরা দিল সেই অর্জন? বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মাশরাফি বিন মুর্তজা যেন আওড়ে গেলেন পেস বোলিংয়ের ধারাপাত। শোনালেন স্টুয়ার্ট ব্রডকে দেখে শেখা, ম্যাকগ্রা-আসিফের পরামর্শ মেনে এখনও টিকে থাকা, প্রতিনিয়ত শেখা আর নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তাড়না আর নিবেদনের গল্প। বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক কথা বললেন বোলিং কোচ বিতর্ক আর ২০১৯ বিশ্বকাপ ভাবনা নিয়েও।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2018, 08:57 AM
Updated : 13 April 2018, 05:52 PM

প্রিমিয়ার লিগে উইকেটের রেকর্ড নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। খুব উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এখন, কদিন পর পেছন ফিরে তাকিয়ে কেমন মনে হচ্ছে?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: সত্যি বলতে কিছুই না। দেশের জন্য গৌরবময় কিছু হলে অন্য কথা। নইলে এসব আমাকে টানেই না।

এমনিতে টুর্নামেন্ট শেষের কদিন পর পেছন ফিরে তাকিয়ে ভালো লাগছে। দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, নিজে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। ভালো লাগা আছে। তবে বৃহত্তরভাবে দেখলে মনে যে খুব দাগ কেটেছে, তেমন কিছু নয়।

এরপরও, এতগুলো উইকেট নেবেন, লিগ শুরুর আগে ভাবতে পেরেছিলেন?

মাশরাফি: এত এত উইকেট নেওয়ার পরিকল্পনায় আমি যাইনি। আমার প্রথম চাওয়া ছিল যে ১৬টি ম্যাচের সবকটি খেলব। এর পর বোলিংয়ে গত ত্রিদেশীয় সিরিজে যে বোলিং করেছি, সেটা ধরে রাখব। ওই ছন্দ যেন থাকে। ত্রিদেশীয় সিরিজ হারার পর মানসিকভাবে হতাশ ছিলাম বেশ। সময়ের সঙ্গে সামলে নিয়েছি। চেষ্টা করেছি ওই টুর্নামেন্টের বোলিংয়ের ছন্দ ধরে রাখতে।

ছন্দ ধরে রাখতে চাই বলেই বিসিএলের শেষ রাউন্ড খেলব। আমি এখন কেবল একটা ফরম্যাটই খেলছি বাংলাদেশের হয়ে। এত খেলা তো নেই। নিজেকে তৈরি রাখতে চাই এই ম্যাচগুলো খেলা জরুরি।

সেদিন আড্ডায় বলছিলেন যে, ‘এবারের লিগে মনে হয় আমার একটা বলও পেটে পড়েনি।’ মানে বোঝাচ্ছিলেন, প্রায় সব বল সিমে পিচ করিয়েছেন। সিমে ফেলতে পারা সবসময়ই আপনার বড় শক্তি। তার পরও এতটা ধারাবাহিকতা খুব কঠিন, সম্ভব হলো কি করে?

মাশরাফি: সিমে বল ফেলার কাজটা বরাবরই ভালো হয় আমার। পেস কমে যাওয়ার পরও টিকে আছি সিমে বল নিয়মিত ফেলতে পারি বলেই। কবজির একটা ব্যাপার আছে এখানে। অনেকটা হোমওয়ার্কের মতো। আমি বাসায় সবসময় তিন-চারটি বল রাখি। হয়ত শুয়ে বা বসে আছি, মনের অজান্তেই বল নিয়ে ব্যাক স্পিন করতে থাকি। এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। খাওয়া বা গোসলের মত একটা দৈনন্দিন ব্যাপার। ব্যাক স্পিন করতে করতে রিস্ট পজিশন ভালো হতে থাকে। এটা করতে করতে ৬ মাস, ৮ মাস বা ১ বছর পর দেখা যাবে, স্বয়ংক্রিয় ভাবেই বল সিমে পড়া শুরু হয়েছে। এটা কোনো রকেট সায়েন্স না। সিম্পল ব্যাপার। কিন্তু নিয়মিত করতে হবে।

অনেকের ভেতর সহজাতভাবেই থাকে। হয়ত এমনই সিমে পড়ে। তবে ৯৫ শতাংশেরই হয় না। আমি এই ৯৫ ভাগের দলেই, কাজেই আমাকে হোমওয়ার্ক ও অনুশীলন করতে হয়। আমি এটা করতে করতে যখন দেখলাম কাজ হতে শুরু করেছে, তখন মজা পেয়ে গেলাম। আরও বেশি করলাম। ফল মিলবেই।

ক্যারিয়ারের শুরুতে তো এতটা ধারাবাহিকভাবে সিমে ফেলতে পারতেন না…

মাশরাফি: শুরুতে ওভাবে পড়ত না। ২০০৭ সালে আফ্রো-এশিয়া খেলতে গেলাম ভারতে। অনুশীলনে আমার ইনসুইঙ্গার দেখে মোহাম্মদ আসিফ (সাবেক পাকিস্তানি পেসার) বলল, “এটা কি ইচ্ছে করে করালে নাকি হয়ে গেছে?” আমি বললাম, “আউট সুইঙ্গার আমার মূল শক্তি। ইনসুইং পারি না, এমনিই হয়ে যায়।” তখন সে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে দেখাব প্র্যাকটিসে।”

আসিফ তো ইনসুইংয়ের মাস্টার ছিল। সে আমাকে অনেক কিছু দেখাল। তখনই বলেছিল যে রিস্ট পজিশনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তার কথা শুনেই ব্যাক স্পিনের অভ্যাস করেছি। ফলও পাই। পরে ২০০৯ সালে যখন বড় ধরনের আরেকটা ইনজুরি হলো (ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে), এর পর যখন ফিরলাম, গতি তখন অনেক কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। তখন আসিফের পরামর্শটা শুনেই রিস্ট পজিশন নিয়ে কাজ করে আজ পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছি।

রিস্ট পজিশন নিয়ে কাজ করার পরই আমি সত্যিকার অর্থে বলের কন্ট্রোল শিখেছি। আগে অনেক কিছু ছিল যে এমনিই হয়ে যেত। কিন্তু তখন থেকে সেগুলো নিজের ইচ্ছায় করতে শিখি। জানতাম কিভাবে করতে হয়। ভালো-খারাপ দিন এরপরও আসবে। কিন্তু নিজের বোলিংয়ে নিজের কন্ট্রোলটা থাকলে ভালো দিনই বেশি আসবে।

এবারের লিগের আগেও কি রিস্ট পজিশন নিয়ে কাজ করেছেন কোনো?

মাশরাফি: আলাদা করে নয়, সবসময় যেমন করি, রিস্ট পজিশন নিয়ে তেমনই করেছি। তবে এই টুর্নামেন্টের আগে আমি অন্য কিছু দিক নিয়ে কাজ করেছি। মূল লক্ষ্য ছিল, ফ্ল্যাট উইকেটে কিভাবে ভালো করা যায়। ওয়ানডেতে ক্রিকেট বিশ্বের ৯০ শতাংশ মাঠেই এখন ফ্ল্যাট উইকেট থাকে। ইংল্যান্ডে গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ছিল ভীষণ ফ্ল্যাট উইকেট, আগামী বিশ্বকাপেও হয়ত তেমনই থাকবে। ওটা মাথায় রেখেই মনে হলো, কিছু করতে হবে। এবারের ঢাকা লিগের উইকেটগুলো ছিল বেশিরভাগই ফ্ল্যাট। আমি দেখলাম, এটা অনুশীলনের ভালো সুযোগ।

আমি কাজ করেছি বলের গ্রিপ নিয়ে। নতুন কিছু করে যদি ব্যাটসম্যানকে এক শতাংশও বেশি ডিস্টার্ব করা যায়, বোলার হিসেবে তা আমার পক্ষে আসবে। সিম আপ আর ক্রস সিম আগে থেকেই করি। এবার সেমিক্রস কিছু গ্রিপ নিয়ে কাজ করেছি।

ভাবনা কি নিজেরই এলো নাকি কারও পরামর্শে?

মাশরাফি: পরিকল্পনা নিজেরই ছিল। টিভি, ভিডিও দেখেও অনেক শিখেছি। স্টুয়ার্ট ব্রডকে দেখেছি সেমিক্রস গ্রিপে বল করে অনেক। ৪০০ টেস্ট উইকেট পেয়েছে, নিশ্চয়ই কার্যকর এটা। ওর কিছু গ্রিপ দেখে দেখে অনুশীলন করেছি। রপ্ত করেছি। কাজে লাগিয়েছি।

যদিও আমার ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে, এরপরও নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চাই। উন্নতি করতে চাই। লিগে ভালো করায় নতুন এই গ্রিপগুলো নিয়ে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। আরও অনুশীলন করব, আরও কাজ করে এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করব। আশা করি ভালো হবে। কারণ শুরু থেকেই বেশ ভালো হচ্ছে এসব।

আমার মূল শক্তি যেটি, সেই লেগ কাটার এবার লিগে খুব বেশি করিনি। নতুনগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ওটা একটু অবহেলিত হয়ে গেছে। পরে ম্যাচে দেখলাম, লেগ কাটার করতে গিয়ে কেমন যেন ভয় লাগছে যে ঠিকমতো হবে কিনা। আত্মবিশ্বাস একটু কমে গিয়েছে এটা নিয়ে। যেহেতু এটা আমার মূল শক্তি, আন্তর্জাতিক সিরিজের আগে এটাও আবার ভালো করে অনুশীলন করতে হবে।

বল সিমে ফেলতে পারাটা দারুণ। তবে লেংথটাও তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবারের ঢাকা লিগে খেলা অনেক ব্যাটসম্যান বলেছেন, আপনার লেংথ নিখুঁত ছিল বলেই খেলা কঠিন ছিল…

মাশরাফি: লেংথটাই সবসময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গতি দেড়শ কিলোমিটার হোক বা একশ, লেংথ ছাড়া সব অচল। গ্লেন ম্যাকগ্রা আমাকে একটা কথা বলেছিল একবার, “লাইন ভালো না থাকলেও… তোমার যদি শুধু লেংথ ঠিক থাকে, তাহলে খুব বাজে দিন হলেই কেবল তুমি মার খাবে। নইলে বেশিরভাগ সময়ই পার পাবে। কারণ লেংথ ভালো হলে ব্যাটসম্যানকে কিছুটা হলেও ঝুঁকি নিয়ে মারতে হবে। বোলার হিসেবে এটাই চাওয়া যেন ব্যাটসম্যান ঝুঁকি নেয়।”

লেংথ ভালো থাকা মানেই একজন বোলারের ৭০ ভাগ এগিয়ে থাকা। লাইন পরে। বেশির ভাগ বোলার যারা অধারাবাহিক বা ঠিকমতো পারছে না, তাদের ওই লেংথই মূল সমস্যা।

ম্যাকগ্রা কবে বলেছিলেন কথাটি?

মাশরাফি: ২০০৩ সালে আমরা যখন সফরে গেলাম। আমি তার কাছে টিপস চেয়েছিলাম। সে বলেছিল, “তুমি আগে একদিন আমাকে ফলো করো। এরপর কথা বলব।”

টেস্ট ম্যাচ চলছিল তখন। তার পর দিনের রুটিন জেনে নিলাম। সকাল সাতটায় সুইমিং সেশন। দেখলাম বসে। পরে স্ট্রেচিং। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট। কি কি খায়, সেসব দেখলাম। এরপর মাঠে গিয়েও দেখলাম। সেদিন তার বোলিং ছিল। কিভাবে গা গরম করছে, প্রস্তুত হচ্ছে, সবই দেখলাম। তার পর টেস্ট ম্যাচ শেষে অনেক কথা বলল। তার রুটিনের প্রতিটি অংশ বোলিংয়ের জন্য কতটা জরুরি, সেসব বুঝিয়ে বলল।

সুমন (হাবিবুল বাশার) ভাই, সুজন (খালেদ মাহমুদ) ভাইরা বলেছিল আমাকে ব্রেট লির সঙ্গে কথা বলতে। যেহেতু আমার গতি তখন ভালো ছিল। ওই সিরিজেও ১৪৩-১৪৪ কিলোমিটারে বল করেছি। লির সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। এমনকি জেসন গিলেস্পির সঙ্গেও বলেছিলাম। তবে সত্যি বলতে, নিজে বেশি আগ্রহী ছিলাম ম্যাকগ্রার ব্যাপারে। তার ধরনটাই বেশি ভালো লাগত আমার।

আসিফের কথা বললাম আগে। ম্যাকগ্রা আর আসিফের পরামর্শ আমার ক্যারিয়ারে অনেক কাজে লেগেছে। ওদের টিপস মেনেই এখনও টিকে আছি।

দেশের কোচদের মধ্যে সরওয়ার ইমরান ভাই অনেক সাহায্য করেছেন। আর সবচেয়ে বড় প্রভাবের কথা বললে, পরের দিকে চম্পকা রামানায়েকের সংস্পর্শ দারুণভাবে কাজে লেগেছে। আমার চোখে তিনি বিশ্বের সেরা বোলিং কোচদের একজন।

একটি ঘরোয়া লিগের আগে নতুন কিছু নিয়ে কাজ করা, নতুন কিছু শেখা, ক্যারিয়ারের এই পর্যায়েও এই তাড়না, এতটা অনুপ্রেরণার উৎস কি?

মাশরাফি: প্রথমত, নিজের কাছে নিজের ভাবমূর্তির ব্যাপার আছে। ছোটদের সঙ্গে খেলছি, নিজেকে সেভাবে তুলে ধরা ও মেলে ধরার ব্যাপার আছে। একটা বার্তা দেওয়া, ওদের সামনে উদাহরণ তৈরি করার ব্যাপার আছে।

আর শুধু লিগই নয়, জাতীয় দলের জন্যও অনেক কিছু করার তাড়না কাজ করে। আগেও যেটা বললাম যে এখন বিশ্ব ক্রিকেটে ওয়ানডেতে এমন সব ফ্ল্যাট উইকেট পাচ্ছি আমরা, পেসারদের টিকে থাকা কঠিন। আর ৬ মাস খেলি বা এক বছর, যদি নতুন কিছু না শিখি, টিকে থাকা কঠিন।

হ্যাঁ, চাইলে তো কোনো রকমে খেলে যাওয়া যায়। কিন্তু আমি কখনোই খেলার জন্য খেলে যেতে চাইনি। নিজের কাছে নিজের চ্যালেঞ্জ আছে। আমি দেশের হয়ে খেলছি, দেশকে আরও অনেক কিছু দেওয়ার ইচ্ছা আছে। সেসব থেকেই নতুন কিছু শেখার তাড়না আসে। শিখতে আমার কখনোই আপত্তি নেই, ক্লান্তি নেই। নিজে যেটা অনুভব করি যে করা প্রয়োজন, সেটা করতে পিছপা হইনা।

খেলে যাওয়ার জন্য খেললে অনেক আগেই ছেড়ে দিতাম। আমি ওই জায়গা থেকে ক্রিকেট খেলি না। খেলতে চাই প্রপার ক্রিকেটার হিসেবে। অনেকে বলে ইনজুরি বা এত কিছু, ওই সহানুভূতি নিয়ে ক্রিকেট খেলার চেয়ে না খেলাই ভালো। প্রতিনিয়ত চাই নিজেকে ভাঙতে, নতুন কিছু করতে, কিছু শিখতে, আরও উন্নতি করতে।

কিন্তু দেড় যুগের ধকল বয়ে বেড়ানো শরীর কি সব সময় সাড়া দেয় এখনও?

মাশরাফি: সত্যি বলতে, সবসময় দেয় না সাড়া। কাজটা কষ্টকর। বয়স ৩৫ হবে অক্টোবরে। ইনজুরিগুলোও বুড়ো হচ্ছে আমার সঙ্গে। অনেক দিনই হয়ত সকালে উঠে শরীর সাড়া দিতে চায় না। কিন্তু সেটাকে প্রশ্রয় দেই না।

কিছু মজার ব্যাপার করি আমি। আগের রাতেই পরিকল্পনা করে রাখি। হয়ত ঠিক করে রাখলাম, “কালকে জিমে গিয়ে ধুমধাড়াক্কা কিছু গান শুনব আর জিম করব। এক ঘণ্টা গান শুনব আর ফাটিয়ে জিম করব।” রাতে কোনো টিভি দেখলাম না বা গান শুনলাম না। পরদিন ওই গানশোনাই আমার অনুপ্রেরণা। গান শুনতে শুনতে জিম করে ফেলি।

আবার অনেক সময় থাকে, একজন পার্টনার খুঁজে নেই। কাউকে বলি, “চল কালকে দৌড়াই, জিম করি।” ওর ভেতর থেকেই আমি হয়ত অনুপ্রেরণা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি। এভাবেই আমাকে যেটা চাঙা রাখতে সাহায্য করে, আমি সেটা বের করে নেই। গড়পড়তা চিন্তা করে ক্রিকেট আমি খেলি না।

অনেকে বলতে পারেন যে কেন এত নিজের সঙ্গে লড়াই। আমি বলি, এটাও একটা মজা। কষ্ট করে খেলছি, এই চ্যালেঞ্জটা জেতাও একটা মজা। এটার মজা আমি পেয়ে গেছি। আমি নিশ্চিত, এই মজাটা কোনো তরুণ ক্রিকেটার পেয়ে গেলে, তার ক্যারিয়ারে আর পেছনে তাকাতে হবে না।

ইনজুরি ম্যানেজমেন্টও তো একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। নিউ জিল্যান্ডে আঙুলের চোট বাদ দিলে এই দফায় (২০১৪ সালে) অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর আপনি তেমন কোনো ইনজুরিতে পড়েননি…

মাশরাফি: আগে ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট আমার এত ভালো ছিল না। বুঝতামই না সেভাবে। দোষ স্বীকার করতে সমস্যা নেই, ভুল তো ভুলই। আমার ক্যারিয়ার শুরুর পর থেকে ২০০৫-০৬ পর্যন্ত আসলে সেভাবে কাজই হতো না এসব নিয়ে। তখন সিনিয়র যারা ছিলেন, সুমন ভাই, সুজন ভাই, উনারাও আসলে ঘোরের মধ্যে ছিলেন। উনাদের জন্যও অনেক কিছু ছিল নতুন। ২০০৬ সালে আর্মি স্টেডিয়ামে গিয়ে আমরা প্রথম জিম করি। এরপর কার্পিনেনের কথা বললাম একটু আগে, সে এসে ছোট একটা জিম করে।

একটা ব্যাপার ছিল, জেনেটিক্যালি আমার লিগামেন্টগুলো খুব লুজ। আমার বাবা যখন অস্ট্রেলিয়ায় গেলেন, তখন পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল। ডাক্তাররা দেখেছিলেন, আব্বারও লিগামেন্ট ছেঁড়া। উনি এক সময় এলাকায় নামকরা ফুটবলার ছিলেন, অ্যাথলেট ছিলেন জাতীয় পর্যায়ে। তো আব্বার লিগামেন্টও ছেঁড়া দেখে অস্ট্রেলিয়ার ডাক্তাররা নিজেরাই আগ্রহী হয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা করলেন। করে দেখলেন যে জেনেটিক্যালি আমাদের লিগামেন্ট লুজ। আব্বার যত লুজ, আমার তার চেয়ে দ্বিগুণ লুজ।

লুজ হওয়ার সুবিধা-অসুবিধা দুটিই আছে। ফ্লেক্সিবল থাকে বলে একটা এক্সটেনশন পর্যন্ত যায় টান লাগলে। তবে সেটা যদি বেশি টান লেগে ছিঁড়ে যায়, তাহলে বাজেভাবে হয়ে যায়। সেটাই হয়েছে আমার সঙ্গে বারবার। এটাও একটা সমস্যা ছিল।

অনেকে মনে করেন, আমি এক সময় খুব দুরন্ত ছিলাম, নিজের প্রতি অবিচার করেছি বলে এত চোট। আসলে কিন্তু ততটা নয়। ক্রিকেট নিয়ে আমি বরাবরই সিরিয়াস ছিলাম। ক্রিকেটের ব্যাপারে অন্তত সবসময়ই ডিসিপ্লিনড ছিলাম। 

হ্যাঁ, অনেক সময় হয়েছে খেলে হুট করে রাতে নড়াইল চলে গিয়েছি। সেটা শরীরে প্রভাব ফেলেছে। বা এরকম টুকটাক কিছু কাজ হয়ত কাল হয়ে গেছে। এজন্যই এই সময়ের ছেলেদের আমি বোঝাই। আমাদের সময় গাইড করার লোকও ছিল না। এখন তো সবকিছু আছে।

আমার সবশেষ অপারেশন ২০১০ সালে। এরপর খুব ভালোভাবে নিজেকে ম্যানেজ করেছি। সেটা করতে পেরেছি বলেই এখনও খেলে যাচ্ছি। কিন্তু এটাকে সহানুভূতির জায়গায় আমি কখনও নিতে চাই না। বিন্দুমাত্র সুবিধাও নিতে চাইনি কখনও।

সহানুভূতির কথা বারবার বলছেন। এই যে আপনার এত এত ইনজুরি, এত বার অপারেশনের কথা বারবার বলা হয়, এসবে তাহলে কি খারাপ লাগে?

মাশরাফি: সব সময় তো ভালো লাগেই না। যদিও লোকের কথায় আমার খুব প্রতিক্রিয়া নেই। খুব ভালো কথায় আমি যেমন ফুলে যাই না, তেমনি খারাপ সমালোচনায় কষ্ট পাই না, খুব কষ্টের কথায়ও অতটা দুঃখ পাই না। একেকজনের ভাবনা, ধরন, দৃষ্টিভঙ্গি একেকরকম। আমি বলতে পারি আমার ভাবনা। সেটাই শেষ কথা নয়। সবারই মতামত আছে। কেউ তার নিজের মতো করে বলতে চাইলে আমি থামাতে পারি না।

আমার একটা ব্যাপার আছে, নিজের ভাবনা বা সিদ্ধান্তের ওপর আমার অসম্ভব আস্থা ও শ্রদ্ধা আছে। অন্যায় সিদ্ধান্ত না নেওয়ার চেষ্টা করি। আর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পছন্দ করি।

আপনি যেটা পারছেন, অন্য পেসাররা সে কেন পারছে না? লেংথের ব্যাপারটিই ধরা যাক, একদমই প্রাথমিক ও মৌলিক ব্যাপার। এরপরও বালাদেশের বেশিরভাগ পেসার এটুকুই কেন ধারাবাহিকভাবে করতে পারে না?

মাশরাফি: লেংথটাকে আমি সবসময়ই গুরুত্ব দিয়েছি। যখন খেলা শুরু করেছি, তখন থেকেই। পরে যখন গতি বাড়ল, তখন আর লেংথ নষ্ট হয়নি। ২০০১ সালে যখন নিউ জিল্যান্ডে গেলাম, টানা ১২ ওভার বোলিং করলাম, একটা সময় আর পারছিলাম না। বয়স ১৮ বছর, কিছুটা ভেঙে পড়েছিলাম। এরপরও আমি লেংথ ছাড়িনি। জায়গায় বল করার চেষ্টা করেছি। হয়তো কিছুটা সহজাতও ছিল আমার।

তুলনায় যাওয়া ঠিক না। আমি অন্যদের সঙ্গে তুলনাও করছি না নিজের। তবে যেটা বলতে পারি, ফাস্ট বোলারদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘ডিসিপ্লিন’। বোলিং আর শরীরের সঙ্গে ডিসিপ্লিনের সম্পর্কই বোলিংয়ের আসল ব্যাপার। আমাদের ছেলেরা যে অনুশীলন করছে না, তা নয়। বিশ্বের সেরা ট্রেনিং পদ্ধতিই ওরা পাচ্ছে। কিন্তু অনুশীলনের পর শরীরকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম কি দিচ্ছে ওরা? শরীরের যে রিকভারি দরকার, সেটির সঙ্গেই সমস্ত শক্তির উৎস জড়িয়ে আছে। ওই শক্তিটা থাকলে বোলিংয়ের সামর্থ্যও বাড়বে। ম্যাচে যেমন, তেমনি অনুশীলনেও।

শক্তি বাড়তে থাকলে আস্তে আস্তে অনুশীলনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে। ৪ মাস, ৬ মাস ফোকাসড হয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে গেলে লেংথ ঠিক হবে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না।

তো পেসারদের ডিসিপ্লিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিশ্রমের পাশাপাশি বিশ্রামও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রাতে ঘুমটা খুব জরুরি। সঙ্গে খাদ্যাভাসও গুরুত্বপূর্ণ। পেস বোলিং খুব সস্তা কিছু নয়। অনেক ত্যাগ স্বীকার করে ধরে রাখতে হয়। আমারও ভুল ছিল। ছিল বলেই এতবার ভেঙে পড়তে হয়েছে। কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো যে মানসিকভাবে শক্ত থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি। সবার ক্ষেত্রে তো সেটা হবে না। এজন্যই সবাইকে বলি আমার মত ভুল না করতে।

আমাদের সময় এত ফ্যাসিলিটিও ছিল না। টেস্ট খেলা যখন শুরু করি, জিমনেসিয়াম বলে কিছু আছে, জানতাম না। বাংলাদেশ দলের জন্য প্রথম জিমনেসিয়াম হয় ২০০৬ সালে। অস্ট্রেলিয়ান ট্রেনার স্টুয়ার্ট কার্পিনেন এসে কয়েকটি বাইসাইকেল আর টুকটাক কিছু নিয়ে জিম চালু করে। ততদিনে অনেক ইনজুরি আমার হয়ে গেছে। তাছাড়া আমাদের সময় তো বলে দেওয়ারও কেউ ছিল না। এখনকার ছেলেরা এসে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক জিমগুলোর একটি পাচ্ছে। সেরা সব ট্রেনার-ফিজিওর সঙ্গে কাজ করছে। টাকা পয়সার কমতি নেই। ফোকাসড হয়ে কাজ করে গেলে ভালো না করার তো কারণ নেই। সেই ফোকাসটা থাকতে হবে।

আপনি বা আপনারা সেসব কথা পরবর্তী প্রজন্মকে কতটা বলেন?

মাশরাফি: বলি তো বটেই। তবে বলাই শেষ কথা নয়। হ্যাঁ, কাউন্সেলিং তো করতে হবেই। দায়িত্বে যারা আছে তারা করে। আমরা সিনিয়র ক্রিকেটাররা করি। কিন্তু দিনশেষে ডিসিপ্লিন ঠিক রাখা, রাতে ঠিকমত ঘুমানো, শরীরকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া, লাইফ কে কিভাবে নেবে, এসব তো যার যা নিজের ব্যাপার।

আমি প্রচুর বলি। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এখন আমি, এজন্য আরও বেশি করে বলি। দলে বা দলের আশেপাশে যারা, তরুণরা যারা, তাদেরকে তো বলিই। এমনকি সেদিন শাহাদাত হোসেন রাজীবকেও বললাম যে, “এভাবে ধুঁকে ধুঁকে খেলার মানে কি? বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে দারুণ সব পারফরম্যান্স আছে তোর। এখনও সত্যিকার অর্থে চেষ্টা করলে আরও অন্তত ২ বছর টেস্ট খেলতে পারে। পড়ে থেকে লাভ কি? চেষ্টা কর!”

এখন আমি বলতে পারি, তার পর কে কি করবে, এটা তো তার নিজের ব্যাপার।

বোলিং কোচের ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা হয় প্রচুর। ওয়ালশের চেয়ে স্ট্রিক অনেক ভালো ছিলেন, এটা এখন জনপ্রিয় ধারণা। আপনার জায়গা থেকে খোলামেলা বলা কঠিন। তার পরও তুলনা করতে বলা হলে, কাকে এগিয়ে রাখবেন?

মাশরাফি: আমি সবসময় চম্পকার কথা বলি। হিথ স্ট্রিক যখন আসেন, তখন চম্পকা তৈরি করে রেখে গেছেন। চম্পকা বীজ বুনে যত্ন করেছেন, পরে সেই ফসল পাওয়া গেছে। এখন আবার চম্পকা আছেন, কোর্টনি ওয়ালশ আছেন। দুজনের ধরন দুই রকম। কিন্তু দুজনের কাছ থেকেই শেখার আছে। আমি নিশ্চিত এসবের ফল সামনে মিলবে।

ইয়ান পন্টের সঙ্গে খুব বেশি কাজ করিনি। তাই বলছি না। অন্যদের ক্ষেত্রে, ঘাটতি তো সবারই কম-বেশি থাকে। আমি ভালো দিকগুলো বলি। চম্পকাকে আগেই বলেছি সেরা। স্ট্রিকের ম্যান-ম্যানেজমেন্ট ভালো ছিল। ওয়ালশের বোলিং জ্ঞান অসাধারণ। সত্যিকার অর্থে শিখতে চাইলে উনার কাছ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। এ রকম একজনকে নিজেদের ড্রেসিং রুমে পাওয়াও বিশাল ব্যাপার। যে কথাটি বারবার বলে আসছি, উনার কাছ থেকে কিছু নিতে না পারলে সেটা আমাদের ব্যর্থতা।

কিন্তু ওয়ালশকে ব্যর্থ বলে দেওয়ার লোকই সাধারণ্যে বেশি দেখা যায়!

মাশরাফি: আমি তো উনার চেষ্টায় কোনো ঘাটতি দেখি না। ছাত্র হিসেবে আমার নিজের কাছেই প্রশ্ন করা উচিত, কতটা পারছি। উনি উনার কাজ করছে। তার পর সেটি রপ্ত করা, ধরে রাখা, সত্যিকার অর্থে অনুশীলন করা, এসব নিজের ব্যাপার। একজন কোচ মাঠে তার কাজটুকু করবেন। একজন পেসারের মাঠের ভেতরে-বাইরে অনেক কাজ থাকে। কোচ তো সব করে দিতে পারবেন না! লোকে হয়ত কার্যকারিতা দেখে মন্তব্য করে। কিন্তু ভেতর বা আড়ালের অনেক কিছু তাদের অজানা থাকে। একেক জনের সময়ে প্রেক্ষাপট একেক রকম।

আবারও বলছি, হিথ স্ট্রিক যখন দায়িত্ব পান, চম্পকার তৈরি করে যাওয়া ফসল পেয়েছেন। আমাকে নতুনভাবে গড়েছেন চম্পকা। রুবেলের প্রায় সবকিছুই চম্পকার হাতে গড়া। মুস্তাফিজের ক্ষেত্রে স্ট্রিকের কোনো হাত ছিল না। সে বয়সভিত্তিক ও ‘এ’ দলে খেলেছে, নির্বাচকরা নেটে এনেছেন, সেখানে তাকে দেখে হাথুরুসিহের মনে ধরেছে। আমি অধিনায়ক, আমি বলতে পারি যে বোলিং কোচের কিছু ছিল না। তবে তাসকিনের ক্ষেত্রে স্ট্রিকের ভালো প্রভাব ছিল। সেটা বলতেও আপত্তি নেই।

যাই হোক, আমি কাউকে খাটো করতে চাই না। স্ট্রিক বা সবার গুণের কথাই বললাম আগে। আমার কাছে চম্পকার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি মনে হয়েছে সবসময়। আমার কথা অবশ্যই শেষ কথা নয়। তবে ব্যক্তিগত মতামত চাইলে, চম্পকাই সেরা।

ক্যারিয়ারের যে পর্যায়ে আছেন, ভবিষ্যৎ পথচলার ভাবনা কি মাথায় উঁকি দেয় মাঝেমধ্যে?

মাশরাফি: অনেকেই বলে ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা জ্ঞানীর কাজ। আমার মতে, ক্রিকেটে এটা বোকার কাজ। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। সব সময় বর্তমানে থাকতে চাই। আপাতত যেমন ভাবছি শুধু বিসিএলের শেষ রাউন্ড খেলা নিয়ে। ওটা শেষে পরেরটা ভাবব। এমনও হতে পারে, কয়েকটা ম্যাচ খারাপ খেললাম, মনে হলো আর ভালো লাগছে না, দুম করে ছেড়ে দিলাম। তো খুব দূর ভবিষ্যৎ ভেবে লাভ নেই।

এরপরও বিশ্বকাপে চোখ নিশ্চয়ই আছে?

মাশরাফি: অবশ্যই, বিশ্বকাপ আমার মূল লক্ষ্য, এটা বলতে পারেন। আগে-পরে অনেক কিছুই হতে পারে। তবে লক্ষ্য বিশ্বকাপই। শুধু ক্রিকেটার হিসেবে বললে, বিশ্বকাপ পর্যন্ত নিজেকে নিয়ে যাওয়া। আর কোনো কিছু নয়।

আর দলের কথা বললে, কিছু ভাবনা তো আছেই। তামিমের সঙ্গে একজন থিতু ওপেনিং পার্টনার পাওয়া, তিনে একজন প্রপার ব্যাটসম্যান পাওয়া, একজন ভালো পেস বোলিং অলরাউন্ডার, ম্যাচ জিততে গেলে সুনির্দিষ্ট কিছু জায়গায় কিছু ক্রিকেটার দরকার, এসব ভাবনা মনে আসে। সৌম্য, ইমরুল, বিজয় (এনামুল হক), ওদের কিভাবে উজ্জীবিত করে ফর্মে আনা যায়, মুমিনুল আনা যায় কিনা, এসব ভাবি।

এর মানে নতুন কাউকে আনার চেয়ে অধিনায়কের আস্থা পুরোনোতেই বেশি?

মাশরাফি: নতুন যদি সেই রকম কোনো প্রতিভা আসে কিংবা কেউ অসধারণ পারফর্ম করে, তার জায়গা আপনাআপনি হয়ে যাবে। কিন্তু যদি গড়পড়তাই হয় কিংবা খুব দারুণ কিছু না হয়, তাহলে পুরোনোদের ধরে রেখে ওদের ফর্মে ফেরানোর চেষ্টাতেই আমার আস্থা। কারণ সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ফ্লেভারটা জানে। অনেক কিছু যেভাবে সামলাবে, একই মানের নতুন ছেলেটি সেটি পারবে না।