বিপিএল ফাইনাল শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই দর্শকের ঢল স্টেডিয়ামে, কালোবাজারির কাছ থেকে ৪০০ টাকার টিকেট ১৫০০ টাকায় কিনে মাঠে ঢুকতে গিয়ে অনেকে দেখেছেন টিকেট জাল।
Published : 07 Feb 2025, 06:02 PM
'চাচা, লঞ্চ এতো ফাঁকা কেন? মনুরা কই…!'- মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এক নম্বর গেটের বাইরে চিটাগং কিংসের কয়েকজন দর্শকের হাতে দেখা গেল এমন প্ল্যাকার্ড। তবে বাস্তবে চিত্রটা ভিন্ন। ম্যাচ শুরুর অনেক আগে থেকেই ফরচুন বরিশালের লাল জার্সি গায়ে সমর্থকদের ঢল দেখা যায় স্টেডিয়ামের চারপাশে।
দীর্ঘ ৩৯ দিন ও ৪৫ ম্যাচ শেষে বিপিএলের শিরোপার লড়াইয়ে চিটাগং ও বরিশাল। ফাইনাল ম্যাচ শুরুর আগে শুক্রবার সকাল থেকেই দুই দলের সমর্থকের ভিড় চোখে পড়ে স্টেডিয়াম এলাকায়। দুপুর গড়াতেই টিকেট পাওয়া দর্শকরা আনন্দ-উল্লাসে ঢুকতে থাকেন মাঠে আর সোনার হরিণ হয়ে যাওয়া টিকেট না পেয়ে বাইরে ঘুরতে থাকেন হাজারো টিকেটপ্রত্যাশী।
দর্শকের জোয়ারের সম্ভাবনা ভাবনায় রেখেই শুক্রবার দুপুর থেকে নেওয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা। খেলা শুরুর প্রায় চার ঘণ্টা আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয় মিরপুর ২ নম্বর থেকে প্রশিকা মোড় পর্যন্ত রাস্তা। রাস্তার পাশে থাকা সব দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি সীমিত করে দেওয়া হয় পথচারী চলাচলও।
এসবের মাঝে টিকেট কালোবাজারির হাত থেকেও অবশ্য মুক্তি পায়নি বিপিএলের ফাইনাল। আগের দিন থেকে সক্রিয় হয়ে ওঠে কালোবাজারি চক্র। অনলাইনে টিকেট কেটে সেগুলো কয়েক কপি বানিয়ে বিক্রির ঘটনাও দেখা গেছে স্টেডিয়ামের ৪ নম্বর ও ৫ নম্বর গেটের আশপাশে।
তবে স্টেডিয়ামের এক ও দুই নম্বর গেটের কাছে দর্শকদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। দল বেধে প্রিয় দলকে সমর্থন করতে খেলা শুরুর প্রায় তিন ঘণ্টা আগেই মাঠে ঢুকতে থাকেন বরিশাল ও চিটাগংয়ের সমর্থকরা।
নিজ বিভাগের দলকে সমর্থন জানাতে শুক্রবার সকালেই বরিশাল থেকে চলে আসেন কেএম হাসান। খেলা দেখে আবার রাতেই তিনি ফিরে যাবেন বরিশাল। মাঠে ঢোকার মুখে প্রিয় দলের কাছে নিজের প্রত্যাশা জানিয়ে রাখেন তিনি।
"অনেক ধকল সয়ে, তাড়াহুড়োর মধ্যে বরিশাল থেকে খেলা দেখতে এসেছি। কোনো আফসোস থাকবে না, যদি বরিশাল জিতে যায়। আমার একটাই ইচ্ছা, এবার লঞ্চে করে ট্রফি নিয়েই ফিরব বরিশাল।"
চিটাগংয়ের জন্য শুভকামনা জানালেও ট্রফির ব্যাপারে কোনো আপোস নেই হাসানের। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় চিটাগংকে একরকম সতর্কবার্তাই দিয়ে রাখেন তিনি।
"চাটগাইয়াগো লেইগা মনে করে মোগো দোয়া থাকপে। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী থাকপে। আম্নেরা খেলেন, মোরাও খেলি। যদি আম্নেরা ভালো খেলতে পারেন, কাপ নেন, সমস্যা নাই। কিন্তু আম্নেরা মনে রাইখ্যেন, হেহে (বরিশালের) টিকিড কিন্তু কাডা, ট্রফিসহ।"
এমনিতে বরিশালের মানুষ হলেও রাজধানীর শ্যামলীতে বাস করা হায়দার আলির ইচ্ছেটাও অভিন্ন।
"গত বছর আমরা প্রথম ট্রফি জিতেছি। এবার আরেকটা জিতব। তারপর দুই ট্রফি নিয়েই যাব বরিশাল। চট্টগ্রামবাসী, আপনাদেরও দাওয়াত।"
এক নম্বরে গেটের বাইরে চোখে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে ঢালিউডের পুরোনো সিনেমার ভাইরাল সংলাপের অনুকরণে চিটাগং সমর্থকদের আনা প্ল্যাকার্ড। ৮-১০ জনের ওই দলে থাকা শফিকুল ইসলাম তখন বরিশালকে দিয়ে রাখেন হুমকি!
"দেখেছেন তো আমাদের লেখা? বরিশাইল্যা লঞ্চ এবার কিন্তু ফাঁকাই যাবে। এবার আর সুযোগ নাই। (চিটাগং কিংসের লোগো দেখিয়ে) সিংহ যখন লঞ্চে হামলা করবে, লঞ্চের কিন্তু অস্তিত্ব থাকবে না। এবার ট্রফি নেব আমরাই।"
তবে শফিকুলের মতো চিটাগংয়ের জন্য গলা ফাটানো দর্শকের দেখা খুব বেশি পাওয়া গেল না স্টেডিয়াম প্রাঙ্গনে। পুরো আসরের মতো শেষ দিনও লাল জার্সি পরা দর্শকদের জোয়ার নামে পুরো এলাকায়। কিছুক্ষণ পরপর ‘বরিশাল… বরিশাল’ স্লোগানে তারা মাতিয়ে রাখেন পুরোটা সময়।
এর মাঝেই চলে আসে বরিশালের টিম বাস। তখন যেন দলটির সমর্থকদের উল্লাস আর থামে না। স্লোগানে স্লোগানে পুরো এলাকা কাঁপিয়ে প্রিয় দলকে স্বাগত জানান তারা। পিছু পিছু আসা চিটাগংয়ের টিম বাসে 'ভুয়া... ভুয়া' বলতেও ছাড়েননি বরিশালের সমর্থকরা।
স্টেডিয়ামের ১ ও ২ নম্বর গেটের মতোই ভিড় দেখা যায় ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গেটেও। তবে ৫ নম্বর গেটের কাছে অন্তত ৮-১০ জন দর্শকের কাছ থেকে পাওয়া গেল কালোবাজারি থেকে টিকেট কিনে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ।
সাভার থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এসে কালোবাজারে পূর্ব গ্যালারির ১০টি টিকেট কেনেন তরিকুল ইসলাম। শুক্রবার বিকেল ৪টায় মাঠে ঢোকার সময় তাদের ৭ জন ঢুকতে পারলেও তিনজনকে ফিরিয়ে দেন গেটে টিকেট চেক করার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। জানানো হয়, ৩টি টিকেট জাল।
পরে জিজ্ঞেস করা হলে নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন তরিকুল।
"সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকি। তবু (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায় এসে ৪০০ টাকার টিকেট ১৫০০ টাকা করে কিনেছিলাম। কিন্তু তিনজন ঢুকতে পারলাম না। এতগুলো টাকা বাড়তি খরচ করেও খেলা দেখতে পারব না।"
অনলাইনে টিকেট ছাড়ার পরও কালোবাজার থেকে টিকেট কেনার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন অনভ্যস্ততার কথা।
"সবসময় আসলে কাউন্টার থেকে কেনার চেষ্টা করি। অনলাইনে কখনও কাটিনি। ব্যাংকের কর্মঘণ্টা চলাকালে সময় করে উঠতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়েই এতগুলো টাকা খরচ করতে হয়েছে। উল্টো শিক্ষা হয়ে গেছে।"
আরও খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এমন অভিযোগ আছে আরও অনেকের। মূলত একই টিকেট কয়েকটি কপি বানিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দর্শকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে কালোবাজারিরা। যে কারণে প্রথম ব্যক্তি কিউআর কোড স্ক্যান করিয়ে মাঠে ঢোকার পর অকার্যকর হয়ে যায় টিকেট। একই কিউআর কোড থাকা অন্যরা আর মাঠে প্রবেশ করতে পারেননি।
খেলা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগেও দেখা যায়, ৪ ও ৫ নম্বর গেটের কাছে কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য। পূর্ব গ্যালারির ৪০০ টাকার টিকেট ২ হাজার টাকা দাম হাঁকাতেও দেখা যায় তাদের। তবে জাল টিকেট প্রতারিত হওয়ার অভিজ্ঞতা শুনে অনেকেই সেসব টিকেট কেনা থেকে নিজেদের বিরত রাখেন।