ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় পেঁয়াজে ‘সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা’

পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন ভরা মৌসুম। কাজেই ভারত থেকে রপ্তানি না হলে ক্ষতি নেই।

আবুল বাসার সাজ্জাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2024, 05:13 PM
Updated : 24 March 2024, 05:13 PM

ভারত অনির্দিষ্টকালের জন্য রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর দেশের আড়তে পেঁয়াজের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। অথচ কদিন আগেই ছোট কিছু চালান দেশে আসার খবরে দাম কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতের ঘোষণার পর কৃষকরা দাম বেশি চাইছেন। আর এর প্রতিক্রিয়ায় উৎপাদনের স্থান আর ঢাকায় আড়ত ও পাইকারিতে বেড়েছে দাম। খুচরাতেও পড়েছে প্রভাব। বড় বাজারের তুলনায় মহল্লার দোকানে প্রভাব বেশি।

ফরিদপুরে আড়ত, শ্যামবাজার ও কারওয়ানবাজারে পাইকারিতে কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা আর পাড়া মহল্লার দোকানে ১০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি দাম বাড়িয়েছেন বিক্রেতারা।

মহল্লার দোকানিরা দাবি করছেন, পাইকারিতে দাম বেড়ে গেছে অনেকটা, যদিও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি আড়তে গিয়ে।

ক্রেতাদের মধ্যে তাড়াহুড়োও দেখা গেছে। দাম দ্রুত বেড়ে যাবে, এমন আশঙ্কায় বেশি বেশি কেনার প্রবণতাও দেখা গেছে।

তবে বাজারে সরবরাহের কমতি নেই। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন পেঁয়াজ উঠার মূল মৌসুম। ভারত থেকে না এলে ভয়ের কিছু নেই।

গত কয়েক মাস ধরে এমনিতেই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ আছে ভারত থেকে। তবে রোজায় বিশেষ বিবেচনায় ৫০ হাজার টন রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার খবর দিয়েছিল দুই দেশের সরকারই।

গত কয়েক দিনে স্থলবন্দর দিয়ে কয়েকটি চালান আসার খবরে দেশে রান্নার উপকরণটির দাম কমে ১১০ টাকা থেকে ৬০ টাকায় নেমে আসতে খুব একটা সময় নেয়নি।

এর মধ্যে শুক্রবার পেঁয়াজ রপ্তানি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। এতে তৈরি হয়েছে নতুন পরিস্থিতির।

রোববার কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে ভারতীয় ও দেশীয় পাবনার পেঁয়াজ মানভেদে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

খুচরায় ভারতীয় পেঁয়াজ ও পাবনার পেঁয়াজ ৬৫ টাকা এবং ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৫৬ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে কিনছে ক্রেতারা।

বিক্রেতাদের কেউ বলছেন, বৃষ্টির কারণে বাজারে কৃষকের পেঁয়াজ আনা ও সরবরাহ প্রক্রিয়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দাম বেড়েছে।

কারওয়ানবাজারের পাইকারি বিক্রেতারা কী বলছেন

পেঁয়াজের পাইকারি দোকান মেসার্স মাতৃভান্ডার এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা সজিব শেখ বলেন, “কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে। গতকাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা ছিল পাইকারিতে। আজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি করছি।”

দাম বাড়ার কারণ বিষয়ে তিনি বলেন, “ভারতের ঘোষণার কারণে বাড়ে নাই আসলে। বৃষ্টি হইছে অনেক এলাকায়। ক্ষেত থেকে পেঁয়াজ খুব বেশি তুলতে পারে নাই। তাই সাময়িক জোগান কম দেখা গেছে। আর যখন জোগান কম থাকে তখন একটু দাম বাড়ে।”

কারওয়ান বাজারে পাইকারি দোকান মেসার্স কুতুবপুর বাণিজ্যালয়ে ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০, দেশীয় পাবনার পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০ ও ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

দেশি পেঁয়াজ পর্যাপ্ত আছে জানিয়ে বিক্রেতা মো. আজাদ মোল্লা বলেন, “তাই ভারতের ঘোষণার কারণে বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়েনি।”

অবশ্য ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগও আছে। তারিক আজিজ নামে এক ক্রেতাকে ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনতে দেখা গেল। এক পাল্লা কিনলে দাম কিছুটা কম পড়ে বলে তার ব্যয় হয়েছে ২৮০ টাকা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গতকাল ভারতের ঘোষণা শুনে কিছুটা আতঙ্কিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, এখন পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেয় কিনা ব্যবসায়ীরা। তাই আজই তাড়াতাড়ি করে ৫ কেজি কিনে ফেললাম।

“এর আগে তো পেঁয়াজ নিয়ে কম নাটক হয়নি। রাতারাতি দাম বেড়ে গেছে ২০ থেকে ৩০ টাকা বা তারও বেশি। তাই এখন আর ব্যবসায়ীদের উপর বিশ্বাস নেই।”

‘কৃষক দাম বেশি চাইছে’

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার কৃষক হাবিব খান জানান, ফরিদপুরে তিনি কেজিপ্রতি ৪৫ টাকা থেকে ৪৮ টাকা দাম পেয়েছেন। আগের দিন বিক্রি করেছেন ৪২ থেকে ৪৪ কেজি। সে হিসেবে কেজিতে দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা।

ফরিদপুরের শান্তা বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন বলেন, “গতকালের তুলনায় আজ ১০০ টাকা বেশি হইছে প্রতি মণে। আজ বাজার গেছে ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা মণ।“

ফরিদপুর থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে আসা আব্দুর রশিদ বলেন, “ফরিদপুরের বাজারে গতকাল এক মণ পেঁয়াজ ছিল ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা। আর আজ গেছে ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকা।”

হঠাৎ দাম বাড়ল কেন- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “কৃষকরা জেনেছে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের কথা। তাই তারা বাড়িয়েছে। আর এখানের কৃষকরা পেঁয়াজ তোলায় ব্যস্ত। তাই বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উঠে নাই। যারা উঠিয়েছে তারা দাম বাড়িয়েছে।”

রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি বিক্রেতা শেখ শাহেদ বলেন, “আমাদের এখানে শুক্রবারের তুলনায় গতকাল শনিবার বাজার কম গেছে। আর গতকালের তুলনায় আজ রোববার বেশি গেছে।

“গতকাল পাইকারিতে বাজার গেছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি। আর আজ গেছে ৪৬ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত কেজি।

"তবে ৫০ টাকার মাল মানুষ নেয় না। ঘুরে ফিরে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা কেজির পেঁয়াজ বেশি চলেছে।"

ভারতের ঘোষণার ‘ভয়ের কারণ নেই’

ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম চলছে। বাজারে ও ক্ষেতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আছেও। তাই এই মুহূর্তে ভারত থেকে না এলে পেঁয়াজের সংকট হওয়ার কারণ নেই।

কারওয়ান বাজারে পাইকারি দোকান মেসার্স কুতুবপুর বাণিজ্যালয়ের বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, “এখন যে দাম আছে বাজারে এই দামই ঠিক আছে। কৃষকও লাভবান হচ্ছে। পাশাপাশি মানুষেরও খুব বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ব্যাপারটা এমন না। নাগালের ভেতরেই আছে দামটা।”

ভারতের পেঁয়াজ বন্ধ হওয়ায় ‘ভালো হয়েছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দেশের টাকা এখন দেশেই থাকতেছে। যেহেতু এটা পেঁয়াজের সিজন তাই আমদানি করে দেশের টাকা বাহিরে দিয়ে লাভ নাই।”

পাশের পাইকারি দোকান মেসার্স মিনহাজ বাণিজ্যালয়ের বিক্রেতা মো. রাজিব বলেন, “ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধই ছিল, এখন শুধু সময় বাড়াল। এতে খুব একটা প্রভাব পড়েনি বাজারে। ফরিদপুরের পেঁয়াজ বাজারে বেশি চলে৷ এ পেঁয়াজ আমি বিক্রি করছি ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়।”

পাড়া-মহল্লায় কী প্রভাব

কারওয়ান বাজারে ৫ থেকে ৬ টাকা বাড়লেও ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পাড়া-মহল্লাসহ অন্যান্য বাজারে।

তেঁজগাওয়ের ফকিন্নি বাজার দেখা যায়, ভারতীয় ও দেশীয় পাবনার পেঁয়াজ ৮০ টাকা এবং ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

বিক্রেতা সামিউর রশিদ বলেন, “গতকাল কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখলাম চাহিদা কম ছিল। কিন্তু আজ দেখলাম অনেক বেশি। গতকালের চেয়ে আজকে ১৫ টাকার মতো বেশিতে কিনতে হয়েছে পাইকারিতে আমাদের।”

পাইকারিতে কত টাকায় কিনেছেন- প্রশ্নে তিনি বলেন, “ভারতীয় পেঁয়াজ ৬৫ টাকা কেজি, পাবনার পেঁয়াজ ৬৫ টাকা আর ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৪৫ টাকা কেজিতে কিনছি।”

তবে সামিউরের তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। কারওয়ান বাজারে ভারতীয় ও পাবনার পেঁয়াজের পাইকারি দর ৫৫ থেকে ৬০ টাকা।

পাশের দোকানি পারুল আক্তার বলেন, “আমার কাছে পাবনা আর ফরিদপুরের পেঁয়াজ আছে। দুইটাই একই দামে বেচি ৭০ টাকা কেজি করে।”

এ বাজারে ক্রেতা আব্দুল আওয়াল বলেন, “এখানে পেঁয়াজের দাম আজ বেশি চাইতেছে। আমার মনে হয় না দাম আসলে এত বেশি, যেহেতু ভরা মৌসুম এখন। ভারতের ঘোষণার কারণে যারা এখন দাম বাড়াবে তারা আসলে অসাধু ব্যবসায়ী।”

ফার্মগেট এলাকায় ভ্যানে করে আলু-পেঁয়াজ ও সবজি বিক্রি করছেন কয়েকজন। তারাও কারওয়ান বাজারের তুলনায় কিছুটা বেশিতে বিক্রি করছেন। মানভেদে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দাম চাইছেন।

গত ৮ ডিসেম্বর থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পেঁয়াজ রপ্তানিকারক দেশ ভারত রান্নায় বহুল ব্যবহৃত এ পণ্য রপ্তানি বন্ধ রেখেছিল। সেই সময়ের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত এখন নতুন করে রপ্তানি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।