মালিকানার দ্বন্দ্ব মেট্রোনেটে, পরিচালনা নিয়ে ‘পাল্টাপাল্টি’

“দুই পক্ষই গ্রাহকের কাছ থেকে সেবামূল্য তোলার চেষ্টা করছে।”

ফয়সাল আতিকজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2023, 05:40 PM
Updated : 5 March 2023, 05:40 PM

দেশের প্রথমদিকের ইন্টারনেট সেবাদাতা কোম্পানি মেট্রোনেট শেয়ারধারীদের দ্বন্দ্ব এবং পরিচালনার কর্তৃত্ব নিয়ে পাল্টাপাল্টিতে জটিলতার মুখে পড়েছে; ‘অচলাবস্থার’ মত পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কাও করছে এক পক্ষ।

এতে কোম্পানিটির বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আর্থিক কোম্পানি, স্টক এক্সচেঞ্জের ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা বিঘ্নের মুখে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বর্তমানে নিজেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা মোস্তফা রফিকুল ইসলাম (ডিউক)।

তার আগে মেট্রোনেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন। তিনি অপর পক্ষের বিরুদ্ধে কোম্পানি দখলের চেষ্টার পাশাপাশি নগদ অর্থ তুলে নেওয়া, ডেটা সেন্টারে হামলার মত অভিযোগ করেছেন।

ইন্টারনেটের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম টেলিযোগাযোগ সেবা দিচ্ছে মেট্রোনেট। ইন্টারনেট সেবাখাতে দেশের অন্যতম বৃহত্তম কোম্পানি হিসেবে এর পরিচিতি রয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবিরকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে সেখানে আরেক শেয়ারধারী ফ্লোরা টেলিকমের প্রতিনিধি ডিউক নিজেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবি করছেন। মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ফ্লোরা টেলিকমেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

দুই পক্ষেই গ্রাহকের কাছ থেকে সেবামূল্য তোলার চেষ্টা করছেন; কোম্পানির ব্যাংক হিসাব থেকেও টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টায় আছেন বলে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন।

আলমাস কবিরের অভিযোগ, সম্প্রতি অপর পক্ষের লোকজন মেট্রোনেটের ডেটা সেন্টারে হামলা করেছেন, যাকে নিছক হাতাহাতি ও ভুল বোঝাবুঝি বলছেন ডিউক।

পর্ষদ থেকে বাদ রহিম আফরোজ

মেট্রোনেটের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়েও বর্তমানে পরিচালনা পর্ষদে নাম নেই রহিম আফরোজের। আলমাস কবিরের রয়েছে ২ শতাংশের মালিকানা। কোম্পানির বাকি মালিকানা রয়েছে ফ্লোরা টেলিকমের কাছে। এ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে ডিউক কোম্পানির কর্তৃত্ব নিতে রহিম আফরোজের প্রতিনিধিদের ও আলমাস কবিরকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ।

আলমাস কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভুল বশত আরজেএসসির রেজিস্ট্রারে রহিম আফরোজের নাম বাদ পড়েছে, যা আবার যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।

তার দাবি, ডিউক আদালতের নির্দেশ অমান্য করে কোম্পানিতে ‘হাঙ্গামা’ তৈরি করছেন। আদালতের নির্দেশেই রহিম আফরোজ গ্রুপের চারজন প্রতিনিধিকে পর্ষদে আনার প্রক্রিয়া চলছে। বোর্ডে ফ্লোরা টেলিকমের দুইজন প্রতিনিধি রয়েছেন।

পর্ষদের কাজে ফ্লোরা যেন বিঘ্ন না করে এবিষয়ে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে দাবি করে তার অভিযোগ, তারা এখন যা করছে তা আদালত অবমাননার সামিল। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

এর আগে রহিম আফরোজ, ফ্লোরা টেলিকমসহ অন্য অংশীদারদের থেকে কোম্পানির পুরো শেয়ার কিনতে আলমাস কবির সমঝোতা চুক্তি করলেও তা ভেস্তে যায়। এ নিয়েও পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রয়েছে তাদের।

সংবাদ সম্মেলনে পাল্টা অভিযোগ ডিউকের

২০০৪ সালে দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার ব্যবসা শুরু করে মেট্রোনেট। দেশে ফাইবার অপটিকসের মাধ্যমে সর্বপ্রথম মেট্রোনেটই দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দেওয়া শুরু করেছে বলে কোম্পানিটির দাবি। বর্তমানে ছোট বড় মিলিয়ে আট হাজার গ্রাহকের মেট্রোনেটে চার শতাধিক কর্মী কাজ করছেন।

রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে মেট্রোনেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবি করা ডিউক বলেন, ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বরের পর থেকে বর্তমান পর্ষদ কোম্পানির দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ফ্লোরা টেলিকমের আরেক প্রতিনিধি ফারাহ ইসলাম, আরেক পরিচালক ফেরদৌস আজম খান, সাবেক এমডি আলমাস কবির ও মাহবুবুল আলম পর্ষদে রয়েছেন।

তিনি জানান, “কোম্পানি বিরোধী কার্যকলাপের কারণে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদধারী সৈয়দ আলমাস করিবকে প্রথমে সিইও পদ থেকে অ্যাডভাইজার পদে; পরবর্তীতে কোম্পানির বিপক্ষে অসাধু কার্যকলাপ ও ধারাবাহিকভাবে তিনটির অধিক বোর্ড মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকার কারণে তাকে পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক উভয় পদ হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”

আগের এমডির বিরুদ্দে ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তুলে ডিউক বলেন, “আলমাস কবির ৮ ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে লেনদেন বন্ধের জন্য বেআইনিভাবে চিঠি দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন ব্যাংকসহ গ্রাহকদের বিল পরিশোধ না করার জন্য চিঠি দিয়েছেন।”

বিভিন্ন ব্যাংক ও গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, গুলশান- ২ রেজিস্টার্ড অফিসের ইন্টারনেট সংযোগ, ফোন ও পিএবিএক্স সংযোগ, ইমেইল, ইআরপি, বিভিন্ন সার্ভারসহ নেটওয়ার্ক এক্সেস সার্ভিস পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দিয়েছে আলমাস।

“আমাদের বিল কালেকশন টিমের ই-মেইল, ফোন এক্সটেনশন ক্লোন করে বনানী অফিসে নিজস্ব লোক দিয়ে বেআইনিভাবে মানি রশিদ প্রিন্ট করে বিল আদায় করছে। এসব বিষয়ে থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।”

এসব বিষয়ে বিদেশে অবস্থানরত আলমাস কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রহিম আফরোজ গ্রুপের সমর্থন নিয়ে গত ১৮ বছর ধরে এই কোম্পানি চালিয়ে আসছি। এখন ফ্লোরা টেলিকমের ডিউক সাহেব কোম্পানি দখলের চেষ্টা করছে। গত ডিসেম্বর থেকে তারা দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। নিজেরা মিটিং করে নিজেরা পদ ঘোষণা করেছে।

“তারা এখন যা করছে তার সবই আদালত অবমাননার সামিল। বর্তমান বোর্ডকে যেন ডিস্টার্ব করা না হয় সেকথাও আদালত থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল।”

এমন প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ’ রাখতে বলেছেন জানিয়ে তার অভিযোগ, “তবুও তারা ছলছাতুরি করে ব্যাংক থেকে ৭ কোটি টাকা নগদ তুলে নিয়েছে। আমরা সাধারণত নগদ টাকা উত্তোলন করি না। গত ১ মার্চ তারা ১২/১৪ জন লোক নিয়ে এসে বনানীতে ডেটা সেন্টারে হামলা চালিয়েছে, দখলের চেষ্টা করেছে। কর্মীদের ওপর আক্রমণ করেছে।

“আমাদের ডোমেইন নেইম ১৬ বছর ধরে ব্যবহার করে আসছি। এটা বাদ দিয়ে তারা নতুন ফেইক ডোমেইন তৈরি করেছে। ফেইক ইমেইল অ্যাড্রেস খুলে কাস্টমারদের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করছে।”

ডিআরইউর সংবাদ সম্মেলনে কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌস আজম খান, উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুল আলম, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহাত খান উপস্থিত ছিলেন।