করোনাভাইরাস: অবরুদ্ধ কালের ডায়েরি

মোরশেদ তালুকদার
Published : 17 April 2020, 04:33 PM
Updated : 17 April 2020, 04:33 PM

ছবি – রয়টার্স

১৪ এপ্রিল দিবাগত রাত। রাত পৌনে চারটা বেজে গেছে। ঘুম আসছে না। জানালা খুললাম। অন্ধকারে খুবে বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। অদূরের উড়াল সড়কটিও দেখতে পাচ্ছি না। দেখবই বা কী করে? কোটি টাকা খরচ করে লাগানো সড়কবাতিগুলো জ্বলছেই না।

প্রতিদিন জানতে পারছি করোনাভাইরাসে সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়ছেই। সেই সঙ্গে আমার উদ্বেগও বাড়ছিল। তবে পুরোপুরি ভীত ছিলাম না। কিন্তু আজ কেন জানি একটু আতংক ভর করেছে। বিশেষ করে রাত পৌনে ১০টার দিকে যখন শুনলাম, চট্টগ্রামে একদিনেই ১১ জন আক্রান্ত তখন থেকে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে কী হবে আমাদের?

আইসিইউর অভাবে ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের দু'জন সংক্রমিত মারাও গেছেন। যদিও এতদিন শুনে আসছিলাম, যথেষ্ট না হলেও মোটামুটি প্রস্তুতি আছে আমাদের। এখনো আক্রান্তের সংখ্যা কম। এই অবস্থায়ও আমরা সেই প্রস্তুতির প্রমাণ দিতে পারিনি। সংখ্যা বাড়লে তখন কীভাবে সামাল দিতে পারবো?

দূর, কি সব ভাবছি! সরকার নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ করছে। তাই সেই ভাবনা বাদ। এখন বরং রাতের সৌন্দর্যই উপভোগ করি।

শহুরে জীবনে এমন গ্রামীণ অন্ধকার আগে দেখার সুযোগ হইনি। এমন সুনসান নিরবতাও ছিল না কখনো। কোন অমাবস্যার রাতে লোডশেডিংয়ের কৃপায় অন্ধকারের সৌন্দর্যে মগ্ন হওয়ার সুযোগ এসেছিল হয়তো। কিন্তু সেটা ছিল ক্ষণিকের। ব্যস্ত সড়কে দ্রুতগামী গাড়ির আলো তখন হয়ে ওঠে প্রধান প্রতিবন্ধক। তাছাড়া অন্ধকারের সঙ্গে মিতালী করার প্রধান শর্তই হচ্ছে নিরবতা। সেটা কখনো পাইনি এ শহরে। তাই নাগরিক জীবনে অন্ধকার ধরা দেয়নি আমাকে। অথচ একসময় বাড়ির পুকুর পাড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা রাতের আধারে ভাবনার পেখম খুলেছিলাম। বহুদিন পর সেই সোনালী মুহূর্তে ফিরে যাচ্ছি।

এখানেও আপদ। এলাকার প্রহরী (নাইট গার্ড) তার বাঁশিতে ফুঁ দিয়েছে। কি বিশ্রী সুর! লোকটার মনে হয় ঘুম ভেঙ্গেছে, তাই কাজ দেখাচ্ছে। বাঁশি বাজিয়ে কাকে সতর্ক করতে হবে? করোনাভাইরাসের ভয়ে চোর-ডাকাত তো এলাকায় থাকার কথা না। পত্রিকায়ও পড়েছি, থানায় নাকি মামলার সংখ্যা কমে গেছে। মানে অপরাধ কমেছে। এটা অবশ্য আমি বিশ্বাস করি না। মামলার সংখ্যা দিয়ে অপরাধের সংখ্যা নির্ণয় করা বোকামি।

কয়েকদিন আগে আমার কাজিন ছিনতাইকারীর খপ্পড়ে পড়ে নগদ অর্থ এবং মোবাইল ফোনও হারান। ঘটনা পাঁচলাইশ থানা এলাকায় হলেও সে কোনো মামলা করেনি। এখন রেকর্ড না হওয়া সে ঘটনা কি অপরাধভুক্ত নয়?

রাতের প্রহরীর বাঁশি ক্ষনিকের জন্য অন্য ভাবনায় নিয়ে গেলেও ফিরে আসি করোনাভাইরাস চিন্তায়। চাইলেও যেন মাথা থেকে বাদ দিতে পারছি না করোনাভাইরাসকে।

চলমান পরিস্থিতিতে কর্মহীন হওয়া এবং অর্থের সংকটে পড়া লোকগুলোর কী হবে? তারা খেতে পারছেন? এদের পেটের ক্ষুধা দূর করতে না পারলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধও অসম্ভব। পেঠে যখন দানা-পানি থাকবে না তখন তারা ভয়ংকর হয়ে উঠবে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, যে যত নিঃস্ব সে তত ভয়ংকর। নিঃস্ব লোকগুলো যদি পেটের যন্ত্রণায় লকডাউন না মেনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, তখন কি কমিউনিটি সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে?

গত ১২ এপ্রিলের একটা সংবাদ মনে পড়ে গেলো। ওইদিন 'জামালপুরের পৌরসভায় ত্রাণের গাড়ি থেকে সব খাদ্যসামগ্রী লুট করে নিলো ক্ষুর্ধাতরা' শিরোনামে খবর বেরিয়েছিল। ওএমএস চাল নিতে গিয়ে লম্বা লাইনও তো সেটা বলে।

ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়লো হুমায়ূন আহমেদ'র 'দেয়াল' উপন্যাসের অংশবিশেষ। সেখানে লেখা ছিল, "শফিক বারান্দায় কাঠের বেঞ্চে বসে আছে। বৃষ্টিভেজা উঠান চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। এই রূপ শফিককে স্পর্শ করছে এরকম মনে হচ্ছে না। সে ক্ষুধায় অস্থির। ক্ষুধার সময় দেবতা সামনে এসে দাঁড়ালে তাকেও নাকি খাদ্যদ্রব্য মনে হয়।"