“পথই আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আর পথে যাদের সঙ্গে পরিচয় তারাই আমার শিক্ষক,” বলছেন ভারতীয় এই যুবক।
Published : 12 Oct 2022, 10:13 PM
পরিবেশ রক্ষা ও হিংসা ছাড়ার আহ্বান নিয়ে বিশ্বের ১৫টি দেশে যেতে চান রোহান আগরওয়াল। ভারতের ২৭টি রাজ্য ঘুরে তিনি এসেছেন বাংলাদেশে।
দুই বছর আগে এই যাত্রা যখন শুরু করেন, তখন রোহানের বয়স ছিল ১৮ বছর। ২০২০ সালের ২৪ অগাস্ট ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসিতে গঙ্গার তীর থেকে শুরু হয় তার হাঁটা।
সেখান থেকে রাজস্থান, হরিয়ানা, দিল্লি, চণ্ডিগড়, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, পন্ডিচেরি, কর্ণাটক, কেরালা ও গোয়া হয়ে ভারতের মোট ২৭টি রাজ্য পরিভ্রমণ শেষে বাংলাদেশে এসেছেন তিনি।
গত ৮ অক্টোবর ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢোকেন এই যুবক। তারপর পৌঁছান চট্টগ্রামে।
পথ চলতে চলতেই পরিচয় বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে। পথের ওই মানুষেরাই রোহানকে সহযোগিতা করেছেন, খরচ, খাবার, থাকার ব্যবস্থা করেছেন। রোহান বললেন, “পথই আমার বিশ্ববিদ্যালয়। আর পথে যাদের সঙ্গে পরিচয় তারাই হলেন আমার শিক্ষক।”
বুধবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় রোহানের। তিনি জানান, নাগপুরে থাকে তার পরিবার। তার বাবা-মা ও ছোট বোন আছেন।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঢাকা, খুলনা ও যশোরে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
রোহান বলেন, “কক্সবাজারে সবচেয়ে বড় সৈকত। এই সৈকতের শুরু থেকে টেকনাফে একদম শেষ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতে চাই। শুনেছি এখনও কেউ পুরো সৈকত হাঁটেনি। সেখানে হেঁটে বিশ্ব রেকর্ড করতে চাই। পরিবেশ রক্ষার ব্যানার নিয়েই সৈকতে হাঁটব।”
‘ওয়াক অ্যান্ড লিফট’
৮০০ দিনের এই যাত্রায় এ পর্যন্ত ১৫ হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করেছেন দাবি করে রোহান জানান, এর পুরোটাই হেঁটে কিংবা অন্য কারও গাড়িতে লিফট নিয়ে চলেছেন তিনি।
যাত্রাপথের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রোহান বলেন, “পথে অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। প্রায় সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছে।
“উত্তর প্রদেশের চম্বল খুব বিপজ্জনক এলাকা হিসেবে পরিচিত। সেখানে একা পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমাকে এক ব্যক্তি আটকান। তিনি আমাকে ব্যাগসহ সবকিছু দিয়ে দিতে বলেন। আমি তখন বলি, ৫ মিনিট আমার কথা শুনুন। ২ মিনিট আমার যাত্রারা কথা শুনে তিনি আমাকে এক হাজার টাকা দেন। আবার খাবারও খাওয়ান।”
কেরালার বর্ষার অভিজ্ঞতা জানিয়ে রোহান বলেন, “সেখানে বৃষ্টি খুব ঝড়ে। একদিন সেরকম বৃষ্টিতে আমি আটকা পড়ি। ফেসবুকে পরিচিত একজন সেদিন আমাকে লিফট দেওয়ার কথা ছিল। ওই ভয়াবহ বৃষ্টির মধ্যেই তিনি নির্ধারিত সময়ে আমাকে নিয়ে যান।”
রোহান বলেন, “আমার কোনো স্পন্সর নেই। ভারতে অনেকে আমাকে সহযোগিতা করেছে। যাদের সঙ্গে দেখা করেছি ৫০০ থেকে ১০ হাজার রুপি পর্যন্ত অনেকে দিয়েছে। এ যাত্রা আমার নয়, এ যাত্রা সবার।”
বাংলাদেশে আসার পর ফেনী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীলও আর্থিক সহযোগিতা করেছেন বলে জানান রোহান।
পরিবেশে অধিকার সবার
রোহান বলেন, “এ পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়। সব প্রাণী ও উদ্ভিদেরও। তাই পরিবেশের বিষয়ে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। এটা সব মানুষের দায়িত্ব।”
তিনি বলেন, “যে রাজ্যেই গিয়েছি, সেখানকার স্কুল-কলেজে গিয়েছি, বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে গিয়েছি। সবাইকে বলেছি পরিবেশ রক্ষার জন্য। ৯৯ শতাংশ মানুষই ভালো। কেউ কোনোদিন জানতে চায়নি, আমি কোন ধর্মের। মানুষ হিসেবে সবাই ‘হেল্প’ করেছে।”
‘হাঁটছি এবং পৃথিবী ঘুরছি, পরিবেশ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করছি’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন রোহান।
ফেনীর অভিজ্ঞতা জানিয়ে রোহান বলেন, “ফেনীতে রাস্তায় যেখানে-সেখানে ময়লা পড়ে থাকতে দেখেছি। দোকানের বাইরে ডাস্টবিনও নেই। ফেনী শহরের বাইরে অনেক বড় ডাম্প ইয়ার্ড। সেখানে প্রচুর প্লাস্টিক দেখেছি।”
প্লাস্টিক পণ্যে বেশি কর আরোপ এবং বিকল্প পণ্যগুলোতে বাজার সুবিধা দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান রোহান।
তিনি বলেন, “প্লাস্টিক অন্যতম দূষণের কারণ। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, কৃষক বা ব্যবসায়ী সবাই প্লাস্টিক ব্যবহার করে। মানুষকে বোঝাতে চাই কীভাবে পরিবেশের সুরক্ষা করা যায়। প্লাস্টিক বন্ধ করা যাবে না।
“কিন্তু রিইউজ এবং রিসাইক্লিং করে পলিথিনের ব্যবহার কমানো যাবে।”
যেতে চান সাইবেরিয়া
গভর্নমেন্ট সিকিম প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটির স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রোহান এই যাত্রায় ১৫টি দেশ যেতে চান।
বাংলাদেশের পর মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, চীন, হংকং, ম্যাকাও, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় যাওয়ার ইচ্ছা রোহানের।
তিনি বলেন, “সাইবেরিয়ার ওমিয়াকম নামের স্থানে তাপমাত্রা মাইনাস ৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়। এভাবে ‘ওয়াক অ্যান্ড লিফট’ উপায়ে ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার কেউ এখনও সেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রার অঞ্চলে পৌঁছাতে পারেনি। এই যাত্রায় আমি ৫০ হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করতে চাই।”
রোহান বিশ্বাস করেন, হিংসা ত্যাগ না করলে এবং পরিবেশ সংরক্ষণ করা না গেলে এই পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
তাই যাত্রা পথে সবার প্রতি তার আহ্বান- “যদি আপনার কাছে কিছুমাত্র থেকে থাকে তাহলে মানুষকে সহযোগিতা করুন। আমরা প্রকৃতি থেকে এসেছি এবং আবার প্রকৃতিতেই মিশে যাব। এটাই মানব জীবনের যাত্রা।”