স্বাধীনতার ৫৩ বছর: জয় বাংলা কণ্ঠে নিয়ে সোনার বাংলার পথে

পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার সেই দিন উদযাপনে লাল-সবুজের বর্ণিল সাজে সেজেছে গোটা দেশ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2024, 06:08 PM
Updated : 25 March 2024, 06:08 PM

পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলনের পথ ধরে নয় মাস মরণপণ যুদ্ধের পর এসেছিল যে স্বাধীনতা, পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনার শৃঙ্খল ভেঙে উড়েছিল লাল-সবুজের পতাকা; সেই স্বাধীন স্বদেশ বিনির্মাণের ৫৩তম বার্ষিকীতে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। 

ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে অগ্রযাত্রার ধারায় এখন উন্নয়নশীল হওয়ার পথে এগোনো দেশ স্বপ্ন দেখছে উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হওয়ার; মঙ্গলবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে ঝরছে সেই পথে দৃঢ় থাকার প্রত্যয়। 

পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার সেই দিন উদযাপনে লাল-সবুজের বর্ণিল সাজে সেজেছে গোটা দেশ; মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণ করে আনন্দক্ষণ উদযাপনে প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে।

উদযাপনে নতুন মাত্রা দিয়ে এবার সঙ্গী হচ্ছেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া দেশ ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগুয়েল ওয়াংচুক ও রানী জেৎসুন পেমা। 

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্তির প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য, যে উন্নয়ন-অগ্রগতি আমরা এখন পর্যন্ত সাধন করেছি, তা আরও এগিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। যে বাংলাদেশ হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-মুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ।”

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সোমবার সন্ধ্যায় তিনি সব কূট-কৌশল-ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণ করে স্বাধীনতার সংগ্রামে পাশে দাঁড়ানো বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্র, ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন তারা। 

স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে জনমুখী ও টেকসই উন্নয়ন, সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন রাষ্ট্রপ্রধান। 

তিনি বলেন, “গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহত করতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।” 

এ মাহেন্দ্রক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক স্মার্ট ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের শপথ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ সরকারের গণমুখী দর্শনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের দর্শনে বিশ্বাসী। সাধারণ মানুষের জীবনমান এবং দেশের উন্নয়নে আমরা আশু, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। 

“এছাড়া নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন অগ্রগতি আমরা নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। এ সকল কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আস্থা এবং জোরালো সমর্থন অব্যাহত রয়েছে।” 

মুক্তির সংগ্রাম 

বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, চলেছিল গণহত্যা। 

ওই আক্রমণ বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধের পথ তৈরি করে দেয়; ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করে দেন, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। 

পাকিস্তানিরা বন্দি করলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম, মুজিবনগর সরকারের পরিচালনায় নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরে বাঙালি জাতি পৌঁছায় মুক্তির বন্দরে, বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছাড়লেও মুক্তি মেলেনি বাংলার মানুষের। জীবন ছিল পাকিস্তানি শেকলে বাঁধা। সেই শেকল ভাঙার মন্ত্র দিয়ে বাঙালিকে জাগিয়ে তোলেন শেখ মুজিব। বাংলার মানুষ যাকে ভালোবেসে নাম দেয় বঙ্গবন্ধু। 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্রবাণীর পর ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকাকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। 

রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানা ইপিআরসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ হলেও পাকিস্তানি সেনাদের ভারী অস্ত্রের সামনে তা টিকেনি বেশিক্ষণ। 

মেশিনগান, কামানের গোলার পাশাপাশি আগুন ধরিয়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় শহরজুড়ে। 

পৈশাচিক বর্বরতার মধ্যেই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে পাকিস্তানি বাহিনী। তার আগেই বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করে দেশবাসীর উদ্দেশে তারবার্তা পাঠিয়ে যান তিনি, স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হয় ইপিআরের ওয়্যারলেস বার্তায়। 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাংলাদেশে প্রতিরোধ শুরুর খবর আসতে থাকে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদের বরাত দিয়ে ২৭ মার্চ বিবিসি জানায়, শেখ মুজিবুর রহমান গোপন বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন। 

সেই মরণপণ লড়াই চলে পরের নয়টি মাস। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ধরা দেয় বিজয়। বাঙালির আত্মত্যাগ পরিণতি পায় বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের এক নতুন রাষ্ট্রের অবয়বে। 

তারপর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে ফেরার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা আসে স্বাধীনতার; পরম শ্রদ্ধায় তাকে জাতির পিতা হিসেবে বরণ করে নেয় নতুন দেশ।

স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ষড়যন্ত্রের জালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটে। এরপর বাংলাদেশের উল্টোযাত্রা শুরু হলেও কয়েক দশক বাদে ক্ষমতায় ফিরে বাংলাদেশকে পথে ফেরানোর দায়িত্ব নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ। 

উচ্চ প্রবৃদ্ধি, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠা, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা, নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা সূচকে অগ্রগতির চমক দেখিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। 

স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি 

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় থাকবে আলোকসজ্জা।

এর আগে ২৫ মার্চের কাল রাত স্মরণে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে নানা আয়োজনে সমবেত হয় হাজারো মানুষ। 

আগের কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লালযাত্রার’ মধ্য দিয়ে ২৫ মার্চ স্মরণ করেছে নাট্যসংগঠন প্রাচ্যনাট। 

সোমবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর থেকে ফুলার রোডের স্মৃতি চিরন্তন চত্বর পর্যন্ত হাতে হাত মিলিয়ে, কণ্ঠে দেশের গান তুলে এ আয়োজনে শামিল হন নাট্যকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।  স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে সব শহীদদের প্রতি সম্মানার্থে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এবারের লালযাত্রা। 

মঙ্গলবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকাসহ দেশজুড়ে প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। 

এরপর মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। 

বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। 

এ উপলক্ষে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা এবং ঢাকা শহরের ভবনগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। 

মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। 

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ভবন, দলীয় কার্যালয় এবং সারা দেশে দলের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করবে আওয়ামী লীগ।

ভোর ৫টা ৫৬ মিনিটে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। 

সকাল ৭টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হবে। 

বেলা ১১টায় দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একটি প্রতিনিধি দল টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। পরে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। 

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পরদিন ২৭ মার্চ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বেলা ১১টায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ ভবনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। 

সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি এবং এরপর চন্দ্রিমা উদ্যানে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে বিএনপি। 

মঙ্গলবার ভোর ৬ টায় দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও সকাল সাড়ে ৮টায় সাভার স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ।