ভরা বর্ষায় হাকালুকির জলস্তম্ভ ভাবাচ্ছে আবহাওয়াবিদদেরও

হাওর থেকে জলরাশি ঘূর্ণায়মান বায়ুর টানে হাতির শুঁড়ের মত এগিয়ে যাচ্ছে মেঘের দিকে- এমন দৃশ্য রোমাঞ্চিত করেছে সবাইকে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2022, 05:25 AM
Updated : 26 July 2022, 05:25 AM

মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর থেকে আকাশে উঠে যাওয়া এক জলস্তম্ভের ছবি আর ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার খোরাক যোগাচ্ছে।

ভরা বর্ষায় টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বয়ে গেছে তাপপ্রবাহ। তেমন বৃষ্টিও নেই। এমন গরমের সময়ে হাওর থেকে জলরাশি ঘূর্ণায়মান বায়ুর টানে হাতির শুঁড়ের মত এগিয়ে যাচ্ছে মেঘের দিকে- এমন দৃশ্য রোমাঞ্চিত করছে সবাইকে।

ওই জলস্তম্ভ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন আবহাওয়াবিদরাও। তারা বলছেন, শনিবার বিকালে হাকালুকি হাওরে মানুষ যা দেখেছে, তা আসলে একটি টর্নেডো।

স্থলভাগের টর্নেডো যখন জলরাশিকে স্পর্শ করে, তখন প্রবল ঘূর্ণিবায়ুর টানে ফানেলাকৃতি নিয়ে পানি উঠে যায় মেঘের দিকে, যা অনেকটা হাতির শুঁড়ের মত দেখায়। ইংরেজিতে একে বলে ‘ওয়াটারস্পাউট’। হাকালুকিতেও স্বল্প সময়ের জন্য এমন একটি ওয়াটারস্পাউটের দেখা মিলেছে।

স্থলভাগে টর্নেডো হলে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে অভাবনীয় ক্ষতি করে যায়। হাকালুকির ওই টর্নেডো জলের ওপর থাকায় উদ্বেগের চেয়ে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে বেশি, কারণ বাংলাদেশে কোনো ‘ওয়াটারস্পাউট’ ছবি বা ভিডিওতে ধরা পড়ল এই প্রথম।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, নির্জন হাওরে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটে থাকলেও তার রেকর্ড নেই। এখন পর্যটকের আনাগোনা বাড়ায় এবং হাতে হাতে মোবাইল ফোন থাকায় বিষয়টি সামনে আসছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, “শনিবার হাকালুকি হাওরে যেটা হয়েছে, সেটা টর্নেডো।… অনেক সময় স্থানীয়ভাবে বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা উপরের দিকে উঠে যায়; আশপাশের ঠাণ্ডা বাতাস তখন দ্রুত বেগে ওই খালি স্থানের দিকে ছুটতে থাকে। তখন টর্নেডোর সৃষ্টি হয়। আর সেই টর্নেডো জলের স্পর্শে এলে তৈরি হয় ফানেল ক্লাউড।”

এ আবহাওয়াবিদ জানান, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় হাকালুকি হাওরের ওই টর্নেডোতে ক্ষয়ক্ষতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এরকম ওয়াটারস্পাউট তৈরি হলে পানিসহ আশপাশে যা থাকে, সব ঊর্ধ্বমুখী হয়। সেই হাতির শুঁড় হয়ত বেশ খানিকটা পথ পানির ওপর দিয়ে এগিয়েও যায় টর্নেডোর টানে। কিছু সময় পরে হয়ত জলস্তম্ভ ভেঙে পড়ে।

ওই ঘূর্ণিচক্রের মধ্যে বাতাস গরম থাকে বলে আশপাশের বৃষ্টির পানিও তুলনামুলক গরম থাকতে পারে। ওয়াটারস্পাউটের সঙ্গে উপরে উঠে যাওয়া মাছ বা অন্য যে কোনো বস্তু তখন নিচে পড়তে পারে।

এরকম টর্নেডোর সময় কী ঘটে তার বিবরণ এসেছে ‘এটমোস্ফেরিক কন্ডিশনস অ্যাসোসিয়েটেড উইথ আ টর্নেডো অ্যাট দ্য এন্ড সাউথইস্ট মুনসুন ২০০১ ইন বাংলাদেশ- এ কেইস স্টাডি’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রবন্ধে। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আবহাওয়াবিদ সমরেন্দ্র কর্মকার, এস এম কামরুল হাসান ও মোহন কুমার দাশ।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার স্মরণ করিয়ে দিলেন ২০০১, ২০১৩ ও ২০১৬ সালে টর্নেডোতে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির কথা।

২০১৬ সালের ২১ অগাস্ট ফরিদপুর সদর উপজেলার বাখুন্ডা এলাকার জোবাইদা করিম জুট মিল টর্নেডোর কবলে পড়লে ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি প্রাণহানিও হয়।

সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, সমুদ্রের বায়ু উত্তর দিকে ধাবমান হয়, উত্তরে থাকে তাপ। উত্তর দিকে বেশি ঘটতে পারে এমন টর্নেডো। তবে হাকালুকি হাওরের মত ঘটনা কম হয়।

“হাকালুকির এ টর্নেডো যখন স্থল ভাগ থেকে ঘুরতে ঘুরতে পানির দিতে ধাবিত হয়, তখন পানিসহ ফানেলের মত উপরে উঠে যায়। এটা বিরল ঘটনা; তবে মাঝে মধ্যে ঘটে। বর্ষার শেষ সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। যখন বৃষ্টিপাত কম হয়, তখন হঠাৎ করে টর্নেডো হতে পারে। টর্নেডো যখন পানির উপর দিয়ে যায়, তখন এমন ঘটে।”

বায়ুমণ্ডলে বাতাসের তাপমাত্রা ভূমির উপরিভাগের তুলনায় কম থাকে। গরম আবহাওয়ায় ভূপৃষ্ঠের কাছের বাতাস দ্রুত উপরে উঠে গেলে আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শ পায়। তখন গরম বাতাস দ্রুত ঠাণ্ডা হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে সৃষ্টি হয় বজ্রমেঘ বা কিউমুলোনিম্বাস। কিউমুলোনিম্বাস হচ্ছে খাড়াভাবে সৃষ্টি হওয়া বিশাল আকৃতির পরিচালন মেঘ; যা থেকে শুধু বিদ্যুৎ চমকানো নয়, বজ্রপাত, ভারি বর্ষণ, শিলাবৃষ্টি, দমকা-ঝড়ো হাওয়া, এমনকি টর্নেডোও সৃষ্টি হতে পারে। সেই টর্নেডো যখন ফানেল আকারে ঘূর্ণায়মান মেঘের কুণ্ডলী নিয়ে ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে যায়, তখন ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার বা আরো বেশি বেগের ঝড় বয়ে যেতে পারে।

হাকালুকির ‘ওয়াটারস্পাউট’ নিয়ে ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, “বর্ষার সময়ে আমাদের এখানে টর্নেডো, ওয়াটারস্পাউট, এসব খুব একটা ঘটে না। এবার অনুকূল পরিবেশের কারণে এটা ঘটেছে।”

তিনি বলেন, “এ ধরনের টর্নেডোর সময় কিউমুলোনিম্বাস ক্লাউড হয়। ক্লাউডের একটি অংশ সারফেস টাচ্ করে। ল্যান্ডের কাছে থাকলে ল্যান্ড, পানিতে টাচ করলে আরও শক্তিশালী হয়। সারফেস থেকে পানি নিয়ে আরও স্ট্রং হয়। পানিতে হলে ওয়াটারস্পাউট বলে। হাকালুকিতে ঘটার কথা প্রথম জানলাম আমরা, পর্যবেক্ষণটা গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে হয়ে থাকলেও ছবি তুলতে পারেনি কেউ।”

হাকালুকির ওই টর্নেডো কত সময় স্থায়ী ছিল, আশপাশের কোন কোন এলাকায় বিস্তৃত ছিল, কতদূর সেটা এগিয়েছে- এসব তথ্য জানতে গবেষকরা কাজ শুরু করবেন শিগগিরই।

এক্ষেত্রে আবহাওয়া অধিদপ্তরের মৌলভীবাজার রেডার অবাজারভেশন সেন্টারে তথ্য উপাত্ত পেলে আরও উন্নত গবেষণা সম্ভব হবে বলে মনে করেন মোহন কুমার দাশ।

২০০১ সালে নালমনিরহাট ও নীলফামারীতে, ২০১৩ সালের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবং ২০১৬ সালে ফরিদপুরের টর্নেডোয় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

তবে স্মরণকালের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভয়াবহ টর্নেডো হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ২৬ এপ্রিল। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় সেই টর্নেডোতে এক হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ যায়।