‘মানুষ পোড়ানো কোনো রাজনীতি হতে পারে না’

চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন বলেন, “রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে যে পোড়া রোগীগুলো আসে, এই ২০১৪, ২০১৫ তারপর এখনও। তাদের কাছে গেলে বোঝা যায় তাদের কী যন্ত্রণা।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2024, 10:51 AM
Updated : 3 Jan 2024, 10:51 AM

কলেজে পড়ুয়া তরুণটি মাদারীপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শীতের জ্যাকেট কিনতে। কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফেরার আগেই বাসে দেওয়া আগুনে দগ্ধ হতে হয় তাকে। বাড়ি ফেরা আর হয়নি। 

পুলিশের যে সদস্য পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন, ঘরে তার শিশু কন্যা বাবাকে খুঁজে ফিরে এখনও। 

রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষতিগ্রস্ত এমন অনেক মানুষের স্বজনরা রাজধানীতে এক কাতারে দাঁড়িয়েছিলেন বুধবার। বেলা ১১টার দিকে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট’ আয়োজিত মানববন্ধনে অংশ নেন তারা। 

‘বিএনপি-জামায়াত থামাও সহিংসতা, আমরা মানবতার পক্ষে’ প্রতিপাদ্যের মানববন্ধনে আন্দোলন কর্মসূচিতে আহত ও নিহতদের স্বজনদের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। এতে জোর দাবি উঠে, ‘মানুষ পোড়ানো কোনো রাজনীতি হতে পারে না।’ 

২০১৩ থেকে ২০১৫ এবং শেষ হওয়া বছরে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনাদলগুলোর সরকার পতনের আন্দোলনের সময়ে যে ‘অগ্নিসন্ত্রাস’ ঘটেছে তার ‘শেষ’ দেখার দাবিও উঠে কর্মসূচিতে। 

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের দিন পিটিয়ে হত্যার শিকার পুলিশ কনস্টেবল মো. আমিরুল ইসলামের স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, “ওই দৃশ্য ভোলা যায় না। মেয়ে তার বাবাকে খোঁজে। আমি তার প্রশ্নে উত্তর দিতে পারি না। 

“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার একটাই দাবি, আমার স্বামীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার চেয়ে কঠিনভাবে যাতে বিএনপি-জামায়াতকে শাস্তি দেওয়া হয়।” 

২০১৩ সালে শাহবাগে নিহত নাহিদের মা রুনি বেগম বলেন, “আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করত না। জ্যাকেট কিনতে মাদারীপুরের শিবচর থেকে ঢাকায় এসেছিল। সেই ছেলে আর বাড়ি ফিরে যেতে পারে নাই।  বিএনপি জামায়াতিরা বাসে পেট্রোল দিয়ে আমার ছেলেকে পোড়াইয়া হত্যা করেছিল।” 

গত ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেন শিকদার মোহাম্মদ। 

মানববন্ধনে এসে তিনি বলেন, “এই বার্ন ইউনিট না থাকলে ৭৫ শতাংশ মানুষ বাঁচত না। আল্লাহর কাছে দোয়া করি এই বার্ন ইউনিট করার জন্য আল্লাহ যেন শেখ হাসিনাকে অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখেন।”  

‘কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না' 

মানববন্ধনে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, “বিবেকের তাগিদে আমি আজকে এখানে এসেছি। আমি কাছ থেকে রোগীদের দেখি, তাদের যন্ত্রণা দেখে আমি আমার নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না। 

“আমি সারাজীবন পোড়া রোগী দেখে আসছি। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে যে পোড়া রোগীগুলো আসে, এই ২০১৪, ২০১৫ তারপর এখনও। তাদের কাছে গেলে বোঝা যায় তাদের কী যন্ত্রণা।” 

একজন মানুষের শ্বাসনালী যদি পুড়ে যায়, সে শ্বাস নিতে পারে না জানিয়ে তিনি বলেন, “মানুষকে যদি এই যন্ত্রণায় যদি আমরা ইচ্ছা করে ফেলে দেই, এর চেয়ে খারাপ কাজ আমার জানামতে নাই। আমরা প্রত্যেকে মারা যাব, কিন্তু একটা স্বাভাবিক মৃত্যু প্রত্যেকেই আশা করে।” 

তিনি বলেন, “আমি  নিজের চোখে দেখেছি, যাদের স্বামী বা সন্তান মারা গেছে, তারা বলেছে, ‘স্যার আমরা তো কোনো রাজনীতি করি না, কখন ইলেকশন তাও জানি না। তাহলে কেন আমাদের পোড়ানো হল?’ 

“তাদের কাছে আমার অনুরোধ, দয়া করে এই নৃসংশভাবে মানুষ পোড়াবেন না। গণতন্ত্র মানে মানুষ পোড়ানো না। আপনারা ভোটে আসুন, ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসুন। মানুষ পোড়ানো কোনো রাজনীতি হতে পারে না।” 

৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নাশকতাকারীদের ‘দাঁতভাঙা’ জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব কামরুল হাসান বলেন, “আপনারা দেখেছেন, কীভাবে ট্রেনে মায়ের কোলের শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। খুনের মাধ্যমে তাদের (বিএনপি) জন্ম, খুনের নেশায় তারা মত্ত।” 

সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, “২০১৪ সালের নির্বাচনপূর্ব সহিংসতায় ৩ হাজার মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল, ৪৭ জন মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২১ জন সদস্য নিহত হয়েছিলেন। 

“নির্বাচনে দায়িত্বরত ২৬ জন প্রিজাইডিং অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল। ৫ শতাধিক স্কুল ভস্মীভূত করা হয়েছিল এবং আরও অনেক নাশকতা চালানো হয়েছিল। আমরা দেখছি, সেটি অব্যাহত রয়েছে ২০২৩ সালেও। আমরা অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানবতার পক্ষে। আমরা ন্যায়বিচার চাই।” 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “৭ জানুয়ারি নির্বাচনে আমরা জনগণ ম্যান্ডেট দেব, যাতে মানবতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করে, যে দল-সংগঠন যারাই করে, তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হয়।” 

মানববন্ধনে অংশ নেওয়া সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে: বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিকজোট বাংলাদেশ, মুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্যমঞ্চ, পোশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ, সম্মিলিত শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্ট ট্রেড ইউনিয়ন,  বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ, বাংলাদেশ হিউমেন রাইটস ফাউন্ডেশন, সপ্তডিঙ্গা এনজিও, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, ওয়ান বাংলাদেশ।