তাদের শব্দে ফেরার গল্প

বড় হয়ে ‘কক্লিয়ার’ চিকিৎসক হতে চাওয়া রাইয়ান বলে, “আমি শুনতে পেতাম না। যে বাচ্চারা শুনতে পায় না, তাদের শুনতে হেল্প করতে চাই।”

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2024, 05:12 PM
Updated : 28 Feb 2024, 05:12 PM

জন্ম থেকেই শব্দ হলে সাড়া দিত না তাসমুম ইসলাম তুবা। যে কারণে কথাও বলতে পারত না। চিকিৎসার মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শোনার সক্ষমতা ফিরে পাওয়ায় সে যেমন নতুন ভুবনের দেখা পেয়েছে; তেমনি দূর হয়েছে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা। এখন সে অঙ্কন শিল্পী হতে চায়।

তার মতো জন্ম থেকে বধির যেসব শিশু চিকিৎসার পর শ্রবণ ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে তাদের নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেখা মেলে এ কিশোরীর। সেখানে তুবা শিল্পী হওয়ার লক্ষ্যের কথা বললেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।

অথচ মাগুরার ১৬ বছর বয়সী তুবা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কিছু শুনতেই পেতেন না। শব্দ হলেও অন্য বাচ্চাদের মত সাড়া না দেওয়ায় তার মা-বাবা বুঝতে পারেন, তিনি কানে শুনতে পান না। তার শোনার ক্ষমতা ফিরে আসতে শুরু করে পাঁচ বছর বয়সে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের পর। এক বছর পর বলতে শুরু করেন।

জন্ম থেকে বধির শিশুদের শ্রবণ ক্ষমতা ফেরানো এ চিকিৎসা পদ্ধতি ‘কক্লিয়ার’ (কানের অভ্যন্তর ভাগে) স্থাপন (ইমপ্লান্ট) সেবা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে এটি শুরু হয় ২০০৫ সালের দিকে।

বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, জাতীয় নাক, কান ও গলা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিএমএইচে ‘কক্লিয়ার’ স্থাপন করা হচ্ছে।

যেসব শিশুরা জন্ম থেকেই শুনতে পায় না তারা ৫ বছর বয়স পর্যন্ত কক্লিয়ার (কানের অভ্যন্তর ভাগে) সেবা পেয়ে থাকে। এ বয়সের পর এ চিকিৎসা নিলে তারা ঠিকঠাকভাবে শুনতে পাবে না। যে কারণে ওই বয়সের আগেই এ চিকিৎসা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়। সাধারণত অস্ত্রোপচারের তিন থেকে চার সপ্তাহ পর বিশেষায়িত এ যন্ত্রের সুইচ অন করা হয়, তখন থেকেই তারা শুনতে শুরু করে।

তখন একটি শিশুর প্রথম শব্দ শোনার অভিজ্ঞতা হয়। চিকিৎসকরা বলেন, জন্মের পর একটি বাচ্চাকে যেভাবে তৈরি করা হয়, তখন সেই শিশুকে সেভাবেই তৈরি করতে হবে। এরপর থেরাপি নিতে হয় দুই বছর পর্যন্ত।

‘কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট’ এর আওতায় একটি বৈদ্যুতিক মেডিকেল ডিভাইস বা যন্ত্র, যা মাঝারি থেকে গুরুতর শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া ব্যক্তিদের শোনার ক্ষমতা উন্নত করতে সহায়তা করে।

ব্যয়বহুল এ চিকিৎসায় দেশে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার কাছাকাছি লেগে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে ছয় হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার জন্য বড় ধরনের ভর্তুকি দেওয়া হয়। এসব হাসপাতালে ব্যক্তিগত খরচেও চিকিৎসা সেবা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

২০০৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দেড় হাজার শিশু ও ব্যক্তি এ চিকিৎসা পেয়েছেন, যাদের মধ্যে বেশির ভাগই সরকারি সেবার আওতায়। হাতেগোনা কয়েকজন নিজের খরচে এ সেবা নিয়েছেন।

বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের লেকচার হলে কক্লিয়ার স্থাপন করা শিশুদের নিয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ হাসপাতাল থেকে এখন পর্যন্ত ৭৯০ জন এ চিকিৎসা পেয়েছেন।

এদিনের অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক আয়োজনও ছিল, যেখানে এসব শিশু নৃত্য, সংগীত পরিবেশন করে। উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি।

শব্দহীন অভিজ্ঞতা

মাগুরার ১৬ বছর বয়সী তাসমুম ইসলাম তুবা শব্দ হওয়ার পর বাসার অন্য বাচ্চাদের মত সাড়া না দেওয়ায় তার মা-বাবা বুঝতে পারে, সে কানে শুনতে পায় না।

তার মা বর্না ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা দেখে সন্দেহ হয়। সন্দেহবশে এলাকাতেই টেস্ট করাই। টেস্টে ধরা পড়ল কানে সমস্যা। বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরির পর এর সন্ধান পেলাম।”

পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তুবার সার্জারি করা হয় ২০১২ সালে, তখন তার বয়স ৫ বছর। সার্জারি শেষে স্পিচ থেরাপি দেওয়ার এক বছর পর সে বলতে শুরু করে।

বর্না ইসলাম বলেন, “প্রথম প্রথম শব্দে ভয় পেত, চুপচাপ থাকত। এক সপ্তাহ পরে সব ঠিক হয়ে যায়।”

তুবার ছোট বোন তাসফিয়া ইসলাম তাইফারও একই অবস্থা। বর্না ইসলামের ধারণা ছিল তাইফার হয়ত এই সমস্যায় পড়তে হবে না। কিন্তু বড় মেয়ের চিকিৎসার সূত্রে তাদের হাসপাতালে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পর দেখা যায়, সেও শুনতে পায় না। পরে দুই বছর বয়সে তার অস্ত্রোপচার করানো হয়।

বর্না ইসলাম বলেন, “মনটা তখন আরও ভেঙে যায়। দুইটা মেয়েরই এমন হল। একটা ওভারকাম না হতেই, আরেকটার হল।”

শুনতে না পারার সমস্যার জন্য তাদের বিভিন্ন সামাজিক চাপের মধ্য দিয়েও যেতে হচ্ছে বললেন বর্না ইসলাম।

“সবাই চিকিৎসা না নিয়ে মেনে নিতে বলছিল। যুদ্ধ করে এতদূর এসেছি। স্কুল-মহল্লায় অনেক কটাক্ষও শুনতে হয়। বন্ধুরা বলে, ‘ওর মেশিন আছে ওর সাথে মেশা যাবে না’। আমার শ্বাশুড়িও অন্য নাতিদের সঙ্গে কথা বলতেছে, ‘ওদের বলে বুঝতে পারবি না’। শুনতে শুনতে এখন আর এসব গায়ে মাখাই না।”  

টাঙ্গাইলের নাগরপুর আটিয়া উলাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিউল বাশার সামীও জন্ম থেকেই কথা বলতে ও শুনতে পেত না। তবে চিকিৎসকরা এর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানাতে পারেননি।

সামিউলের বয়স এক বছর হলে তার বাবা-মা বুঝতে পারে তার ত্রুটির কথা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঘুমের ঘোরে বা জোরে শব্দ হলে চিৎকার করা স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও সামিউলের মধ্যে এ আচরণগুলো অনুপস্থিত ছিল।

তার বাবা আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যত জোরেই শব্দ হোক সে কোনো সাড়া দিত না। পরে আমরা পিজিতে এসে চিকিৎসা দেই। এরপর সে কথা বলতে পারে, শুনতে পারে।”

শামিউল যখন কথা বলতে ও শুনতে পারত না তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য তার মা-বাবাকে বিকল্প ব্যবস্থার চিন্তা করতে হয়েছিল। তখন তারা প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতেন ইশারায়।

আনোয়ার হোসেন বলেন, “সন্তানের সমস্যা হলে এটা কতবড় তা বাপ-মা হলেই বোঝা যায়। এটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।“

শামিউলরা তিন ভাই-বোন। এরমধ্যে তার সমস্যা থাকলেও বাকি দুজন সুস্থ। চিকিৎসা নিয়ে আড়াই বছর বয়সে সে সুস্থ হয়।

শামিউলের বাবা বলেন, “ডিভাইস দেওয়ার পর ডাক্তার বলল, ‘আপনার বাচ্চার আজকে নতুন জন্ম হয়েছে; জন্মের পর একটা বাচ্চাকে যেভাবে তৈরি করা হয় সেভাবে তৈরি করতে হবে।’ এরপর ৪ বছর ধরে ওকে কথা বলা শেখাতে হয়েছে।“

শুনতে পেয়ে স্বস্তিতে সামিউলও। প্রথম সে উচ্চারণ করেছিল ‘আব্বু’ শব্দ, তারপর ধীরে ধীরে পরিচয় হয় আরও শব্দের সঙ্গে।

সে বলল, “এখন সব বলতে পারি ভালো লাগে।”

সাধারণত যেসব শিশু জন্ম থেকেই শুনতে পায় না, তারা শুনতে না পারার জন্য বলতেও পারে না। এমনটা হয়েছিল গাজীপুরের হাফিজ জাহাঙ্গীর আলম দাখিল মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী হিজবুল্লাহর সঙ্গেও।

তার বাবা এমরান হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নিউমোনিয়া হলে তার দুটো কানই অকেজো হয়ে যায়।

বয়স ছয় মাস হওয়ার পরও সে কোনো শব্দে সাড়া না দেওয়ার ফলে তাদের ধারণা আরও পোক্ত হয়।

বাবার চাকরি সূত্রে হিজবুল্লারা তখন চট্টগ্রামের বাসিন্দা। তার এক বছর বয়সে চিকিৎসা শুরু হয় সেখানেই।

এমরান হোসেন বলেন, “শুধু বোবা মানুষের মত চেঁচামেচি করত তখন। ভয়ে ছিলাম সে কি কানে শুনতে পাবে না? বিভিন্ন ডাক্তার দেখানোর পর তারাও বলত, কান নষ্ট হয়ে গেছে; ঠিক না হলে কথাও বলতে পারবে না।

“তারা ইন্ডিয়ায় গিয়ে চিকিৎসা করানোর কথা বলছিলেন। খরচ হবে ১২-১৩ লাখ টাকা। যেটা জোগাড় করা আমাদের জন্য অসম্ভব।”

২০১৯ সালে শিশুটির তিন বছর বয়সে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে সরকার থেকে মেশিন বরাদ্দ পায় তারা। অস্ত্রোপচারের এক মাস পর সে সাড়া দিতে শুরু করে।

“পেছন থেকে ডাকলে সে তাকাত, তখন বুঝতে পারলাম সে শুনতে পাচ্ছে। আগে থালা দিয়ে জোরে বাড়ি দিতাম, জোরে ডাকতাম, ঘুমের মধ্যে জোরে শব্দ হলেও শুনতে পেত না,” পুরোনো স্মৃতি তুলে ধরেন এমরান।

হিজবুল্লাহ প্রথম কথা বলতে শুরু করে ৩ বছর ৬ মাস বয়সে। মুখে বুলি ফোটাতেও কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি তাদের।

এমরান বলেন, “নতুন বাচ্চার মত শব্দ তুলে দিতে হয়েছে তার মুখে। তবে সে এখন পুরোপুরি সুস্থ। সবকিছু একা একা পারছে। কিন্তু তাকে এই মেশিন সারাজীবনই বহন করতে হবে, নাহলে সে আর শুনতে পাবে না।”

নরসিংদীর ক্লেবার্ড কিন্ডারগার্ডেনের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইয়ান বিন ফয়সাল জন্মের ৮ থেকে ৯ মাস বয়সে যখন ডাকলে সাড়া দিত না, শব্দ হলে তাকাত না তখন তার বাবা-মা বুঝতে পারে সে শুনতে পায় না।

তার এক বছর বয়সে নরসিংদীতে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ দেখানো হলে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসার কথা বলেন।

পরে এখানে দুই বছর বয়সে তার অস্ত্রোপচার করানো হয়। এর তিন মাস পর সে বলতে শুরু করে।

রাইয়ানের মা ফাতেমা জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেড় বছর থেকেই ওরে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। কী করা যায় শোনানোর জন্য, সে চেষ্টা চলত। কথা শুনতে শুরু করার পর কেমন যে লাগছে আমাদের তা বলে বোঝানো যাবে না।”

তবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার পর যে যন্ত্রগুলো দেওয়া হয় সেগুলো কোনো কারণে অকেজো হয়ে গেলে, তা কিনতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় অভিভাবকরা সেগুলোরও সরকারি তদারকির দাবি জানিয়েছেন।

পাপিয়া আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবার তো মেশিনগুলো কেনার মত সক্ষমতা থাকে না। ১২-১৩ লাখ টাকা লাগে কিনতে, কিনতে না পারলে তো অপারেশন করে লাভ নেই। আমরা যখন কিনতে যাব তখন যেন সাশ্রয়ী মূল্যে কিনতে পারি, সবজায়গায় যেন পাওয়া যায়- সরকার থেকে এ তদারকিটা চাই।”

এ বিষয়ে অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, “মেশিনটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে কস্ট শেয়ারের একটা ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু পুরোটাই সরকার দিলে ডিভাইসের ব্যাপারে যত্ন থাকবে না। যার একেবারেই নেই, আর্থিক অবস্থা বিবেচানায় তার সঙ্গে সরকার অবশ্যই থাকবে।”

দুচোখে স্বপ্ন তাদের

এসব শিশুরা নিয়তির সঙ্গে লড়ে স্বাভাবিক মানুষের মতই বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সামিউল বলে, “বড় হয়ে আমি পুলিশ অফিসার হতে চাই। আর প্রধানমন্ত্রী নানুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

রাইয়ান বিন ফয়সাল বড় হয়ে কক্লিয়ার চিকিৎসক হতে চায়। সে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “আমি শুনতে পেতাম না। যে বাচ্চারা শুনতে পায় না, তাদের শুনতে হেল্প করতে চাই।”

তাসমুম ইসলাম তুবার শখ ছবি আঁকা। সে ছোট থেকেই শিখে আসছে আঁকা, বড় হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায় চারুকলায়।

তুবা বলে, “যাতে ভাল হতে পারি। ছবি এঁকে পুরস্কারও পেতে চাই।”

তার বোন তাসফিয়া ইসলাম তাইফা বড় হয়ে কম্পিউটারের অফিস দিতে চায়। যেখানে অনেকে কাজ করতে পারবে।

তাইফা বলে, “আমি কাজ করব না। আমার অফিসে সবাই চাকরি করবে।”