মোবাইল সেট কারসাজি: ঠকছেন গ্রাহক, ‘উদাসীন’ বিটিআরসি

বছরের পর বছর অবৈধ আর নকল মোবাইল হ্যান্ডসেটে বাজার সয়লাব থাকলেও তা ঠেকাতে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ।

শামীম আহমেদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2015, 09:37 AM
Updated : 11 April 2015, 12:37 PM

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি বছর তিনেক আগে কিছু উদ্যোগ নিলেও তা এখনো পরিকল্পনাতেই আটকে আছে।

এতে কম টাকায় নামি-দামি ব্রান্ডের সিল লাগানো সেট কিনে ঠকছেন গ্রাহকরা। অন্যদিকে অবৈধ মোবাইল সেট সনাক্তকরণের কোনো সুযোগ না থাকায় তা বেছে নিচ্ছেন অপরাধীরা।

এ থেকে মুক্তির জন্য সেট আমদানিতে শুল্ক কমানোর পাশাপাশি নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজারে যেসব মোবাইল হ্যান্ডসেট আছে সেগুলোর প্রতি তিনটিতে একটিই নকল বা অবৈধ বলছেন ব্যবসায়ীরা।

তাদের হিসাবে প্রতি বছর এক কোটির বেশি অবৈধ ও নকল মোবাইল হ্যান্ডসেট বাজার আসছে। এগুলোর বাজার মূল্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা, আর এর পুরোটাই যাচ্ছে গ্রাহকের পকেট থেকে।

মোবাইল ফোন বিজনেসম্যান এসোসিয়েশনের সভাপতি নিজামউদ্দিন জিটু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বছরের পর বছর ধরে মোবাইল হ্যান্ডসেটের এই কারসাজি চলে আসছে।

“তারপরেও মূল চক্র সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। আর তল্লাশির নামে হয়রানি পোহাতে হয় সাধারণ ব্যবসায়ীদের।”

যেভাবে আসছে নকল ও অবৈধ হ্যান্ডসেট

ব্যবসায়ীরা জানান, নামি কোম্পানির দামি হ্যান্ডসেট আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলে সেই কাগজ দেখিয়ে চীন বা অন্য দেশ থেকে নিম্নমানের সেট আমদানি করা হয়। এর সঙ্গেই চলে আসে কয়েক হাজার নকল সেট।

নিয়ম অনুযায়ী হ্যান্ডসেট আমদানির আগে বিটিআরসির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। এজন্য মোবাইল হ্যান্ডসেটের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুপমেন্ট আইডেনটিটি (আইএমইআই) নম্বর এবং যে হ্যান্ডসেট আমদানি করা হবে তার নমুনা  বিটিআরসিতে জমা দিতে হয়।

এসব যাচাই করে বিটিআরসি স্পেকট্রাম বিভাগ আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকে।

আইএমইআই নম্বর হলো ১৫ ডিজিটের একটি স্বতন্ত্র সংখ্যা যা বৈধ মোবাইল ফোনে থাকে। একটি মোবাইল ফোনের কি-প্যাডে *#০৬# পরপর চাপলে ওই মোবাইল ফোনের বিশেষ এই সনাক্তকরণ নম্বরটি পর্দায় ভেসে উঠে, যা নকল হ্যান্ডসেটে থাকে না।

কম দামি হ্যান্ডসেটের জন্য বিদেশ থেকে বিভিন্ন নামি-দামি ব্র্যান্ডের স্টিকার ও ট্যাগ আমদানি করা হয় বলে জানান কয়েক ব্যবসায়ী।

বিশেষ ধরনের নেগেটিভ পেপারে লাগানো এই স্টিকারে হাত বুলিয়ে বা খালি চোখে দেখে বোঝা যায় না এগুলো নকল।

আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি হওয়ায় ছয়-সাত মাস ব্যবহারেও এসব নকল স্টিকারের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয় না। তবে মূল সেট নিম্নমানের হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ঠকতে হয় ক্রেতাদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কয়েক মাস ব্যবহারের পর বেকায়দায় পড়েন ক্রেতা।

ব্যবসায়ীরা জানান, নকল হ্যান্ডসেটের আমদানি মূল্য এক থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে হলেও ভালো ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগিয়ে তা বিক্রি করা হয় ৫ থেকে ২৫ হাজার টাকায়।

স্টেডিয়াম মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, বেশি লাভের আশায় নকল হ্যান্ডসেট বিক্রি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কম দাম দেখে ক্রেতারা এসব কিনে নেন। তবে ওয়ারেন্টি না থাকায় পরে বিপদে পড়েন তারা।

মোবাইল ফোন বিজনেসম্যান এসোসিয়েশনের সভাপতি জিটু  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জাল ছাড়পত্র ব্যবহার করে এসব নকল ও অবৈধ হ্যান্ডসেট বাজারে আনা হয়।

তিনি জানান, ২০১৪ সালে দুই কোটি ২০ লাখ মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানি করা হয়। তার মধ্যে ৪১ লাখ ছিল স্মার্টফোন। এগুলোর বাজার মূল্য ছিল সাত হাজার কোটি টাকার বেশি।

মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিশাল একটি অংশ ফিচার ফোন ব্যবহার করে থাকেন। এই ফিচার ফোনে ২০১২ সাল থেকে বাংলা কিপ্যাড ছাড়া আমদানি নিষিদ্ধ রয়েছে।

তবে চোরাই পথে যেসব মোবাইল ফোন আসতো তা এই সুবিধা ছাড়াই বাজারে চলে আসছে। অবৈধভাবে আসা এসব মোবাইল ফোনে বাংলা এসএমএস লেখা বা পড়ায় সমস্যায় পড়েন গ্রাহকরা।

শুধু ফিচার ফোন নয়, নকল স্মার্ট ফোনের বাজারও কম নয়। নামি-দামি ব্রান্ডের সিল লাগানো যা ‘মাস্টার কপি’ নামে পরিচিত চীনের তৈরি হ্যান্ডসেটগুলোর চাহিদাও বাজারে রয়েছে প্রচুর।

এসব মোবাইল কিনেও প্রতারণায় পড়ছেন গ্রাহকরা। যে কনফিগারেশন লেখা থাকে তার কোনটিই ঠিক থাকে না এসব সেটে।

বৈধভাবে আসা যে হ্যান্ডসেটের দাম ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা, সেই হ্যান্ডসেটের ‘মাস্টারকপি’ বা ক্লোনকপি পাওয়া যাচ্ছে মাত্র সাত থেকে আট হাজার টাকায়। আর নকল সেই সেট আনতে খরচ হয় মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।

বর্তমানে সারা দেশে ৩০  লাখ হ্যান্ডসেট ব্যবসায়ী আছেন  বলে জানান জিটু।

প্রতিটি সেট আমদানিতে তার মূল্যের ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও ৫ শতাংশ শুল্কসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রায় ২১ শতাংশ সরকারকে দিতে হয় বলে জানান হ্যান্ডসেট ব্যবসায়ীরা।

সরকারকে এ অর্থ ফাঁকি দিতেই অবৈধ উপায়ে সেট আনা হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

আইএমইআই নম্বরও মেলে বাজারে

রাজধানীর মোতালিব প্লাজাসহ কয়েকটি হ্যান্ডসেট বাজারে ৫০ থেকে ২০০ টাকায় আইএমইআই নম্বর বিক্রি হতে দেখা গেছে। এক আইএমইআই নম্বর বিক্রি করা হয় একাধিক গ্রাহককে।

কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, মোবাইল সেট আমদানির আগে আইএমইআই নম্বর দিয়ে বিটিআরসি থেকে ছাড়পত্র নেওয়া হয়। সেই আইএমইআই নম্বরও পরে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

কারো হ্যান্ডসেট চুরি হলে সেই সেটের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করা হলে তা আসল পরিচয় হারায়। ফলে কারো হ্যান্ডসেট হারিয়ে গেলে তা উদ্ধারে কূল-কিনারা করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।

উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ বিটিআরসি

নকল ও আইএমইআই নম্বর বিহীন মোবাইল ফোন সেট ঠেকাতে উদ্যোগেই ‘সীমাবদ্ধ’ হয়ে আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।

২০১২ সালের মার্চে ছয় মাসের মধ্যে নকল সেটের আইএমইআই নম্বর দেওয়ার জন্য অপারেটরদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

৫০ টাকার বিনিময়ে নকল সেটে আইএমইআই নম্বর দেওয়ার একটি পরিকল্পনাও(জেনুইন আইএমইআই ইমপ্ল্যান্ট প্রোগ্রাম) নিয়েছিল বিটিআরসি। এরপর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও ‘পরিকল্পনাতেই’ আটকে আছে এ উদ্যোগ।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আইএমইআই নম্বর বিহীন সেটই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বলছেন।

আর এ কারণে মোবাইল নম্বর থাকা সত্ত্বেও অপরাধীদের সনাক্ত করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া হারিয়ে গেলে বা ছিনতাই হলেও তা উদ্ধার করা যায় না।

এসব অপকর্ম রোধে অপারেটরদের ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্ট্রার (এনইআইআর) যন্ত্র স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছিল বিটিআরসি। তবে তারপরে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি।

এই সিস্টেম স্থাপন হলে ব্যবহারকারীরা আইএমইআই নম্বর বিহীন হ্যান্ডসেট দিয়ে সিম ব্যবহার করলে তা বন্ধ করে দেওয়া যায়। এছাড়া নম্বর যুক্ত কোনো হ্যান্ডসেট চুরি হলে তা সহজেই উদ্ধার করা যায়। সিম কার্ড বদলে ফেললেও একজন কলারকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়।

নিজামউদ্দিন জিটু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আইএমইআই প্রতিস্থাপন ও এনইআইআর উদ্যোগ নেওয়া হলে নকল হ্যান্ডসেট প্রতিরোধ করা সহজ হতো।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে এবং তার দপ্তরে গিয়েও এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে সংস্থার সহকারী পারিচালক (মিডিয়া উইং) জাকির হোসেন খান বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এনইআইআর যন্ত্র স্থাপনে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 

গত ফেব্রুয়ারি মাস শেষ নাগাদ দেশে ১২ কোটি ২৬ লাখ ৫৭ হাজার সিম থাকার কথা জানিয়েছিল বিটিআরসি ও অপারেটররা। তবে সেগুলোর মধ্যে ৮ কোটির মতো সিম সক্রিয় বলে তাদের ধারণা।