এক বৈঠক ঘিরে সন্দেহ অভিজিতের বাবার

বই মেলায় একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে অংশ নেওয়া অপরিচিত যুবকরাই অভিজিৎ রায়কে খুন করতে তার পিছু নিয়েছিল বলে নিজের সন্দেহের কথা জানিয়েছেন তার বাবা অধ্যাপক অজয় রায়।

শামীমা বিনতে রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2015, 03:19 PM
Updated : 12 March 2015, 05:38 PM

ওই বৈঠকটি আয়োজন করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ কৌশল বিভাগের শিক্ষক ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। বুয়েটে পড়াশোনা করা অভিজিৎও বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করতেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বই মেলার ভেতরে ওই বৈঠক বা আড্ডা থেকে বেরিয়ে আসার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে হামলার শিকার হন অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। 

হামলাকারীদের চাপাতির আঘাতে মারা যান মুক্তমনা ব্লগ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা লেখক-ব্লগার অভিজিৎ। মাথায় জখম হওয়ার পাশাপাশি চাপাতির আঘাতে একটি আঙুল হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছেন ব্লগার বন্যা।

অভিজিৎ ও বন্যা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। লেখালেখির কারণে জঙ্গিবাদীদের হুমকি মাথায় নিয়েই বাংলাদেশে এসেছিলেন অভিজিৎ, এবারের একুশের বই মেলায় তার দুটি বই প্রকাশ উপলক্ষে।

ওই দিনের বৈঠকে ‘কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথির’ অংশ না নেওয়ার বিষয়টিও অভিজিতের স্ত্রী বন্যার মনেও সন্দেহের উদ্রেক করেছে বলে বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানান অজয় রায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক বলেন, সন্দেহ হওয়ার কারণে ফারসীমের মোবাইল নম্বরে কল করলেও তা বন্ধ পান তিনি।

তবে ফারসীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ওই আড্ডায় থাকা ব্যক্তিদের অধিকাংশ তার এবং অভিজিতেরও পরিচিত এবং অভিজিতের সঙ্গে কথা বলেই ওই বৈঠক আয়োজন করেন তিনি।

অজয় রায় বলেন, “ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী নামে বুয়েটের ওই শিক্ষক সেদিন তাদেরকে (অভিজিৎ-বন্যা) একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে ডাকে। বন্যা-গুল্লু (পিতার কাছে অভিজিতের ডাকনাম) তাকে ভালো করে চেনে।”

হামলায় আহত পুত্রবধূ বন্যার কাছে বিষয়টি জেনেছেন অজয় রায়। তিনি নিজের ডায়েরিতে সেদিনের (২৬ ফেব্রুয়ারি) পৃষ্ঠায় লিখে রাখা ফারসীমের নাম ও ফোন নম্বরটিও দেখান।

বুয়েট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো অভিজিৎ লেখালেখির কারণে ফেইসবুকে শফিউর রহমান ফারাবীসহ বিভিন্ন জনের হুমকি পাওয়ায় ছেলে দেশে ফেরার পর তাকে নিয়ে উদ্বেগ ছিল অধ্যাপক অজয় রায়ের। তবে খুন হতে পারেন অভিজিৎ, তা ধারণায় ছিল না বাবার।

অজয় রায় বলেন, “সে (ফারসীম) বলেছিল, বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা নিয়ে কিছু তরুণের সঙ্গে আলোচনার আয়োজনের কথা। সেখানে আসিফ আর নিত্য নামে অভিজিত-বন্যার দুজনের পরিচিত লোক থাকার কথা ছিল।

“কিন্তু তারা তো আসেইনি, বরং ওই আলোচনায় অভিজিতের অপরিচিত কিছু ছেলেপেলে ছিল বলে বন্যা আমাকে জানিয়েছে। ওই অপরিচিতরাই অভিজিতের জন্য কাল হল।”

বন্যাকে উদ্ধৃত করে অজয় রায় বলেন, শুদ্ধস্বরের (অভিজিতের বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান) একটি অনুষ্ঠান থেকে সন্ধ্যা ৭টায় ফারসীম আয়োজিত ওই বৈঠকে গিয়েছিলেন অভিজিৎ ও বন্যা।

তবে ফারসীমকে সন্দেহ না করলেও ওই বৈঠকে থাকা ব্যক্তিদের বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ অজয় রায়ের। 

“আমার মনে হয়, মান্নান খুব ইনোসেন্টলি কাজটা করেছে। ও যে এটার মধ্যে ইনভলবড, তা না। কিন্তু সে অনেক লোকজন ডেকেছে, অনেকে এসেছে শুনে। এই যে আননোন কতগুলো ছেলে বসে আছে ওখানে।”

“তারপর করল কী, ফারসীম ওর সঙ্গে আলোচনা-টালোচনা করে ওরা গুল্লুকে এসকর্ট করে যেখানে স্পটটা (হত্যা) হয়েছে ওই গেইট দিয়ে বেরিয়েছে। তখন বলল যে চলেন অভিজিৎদা আমরা চা খাই; ওই ছেলেগুলো, আননোন ছেলেগুলো। ইতোমধ্যে ফারসীম মান্নান নিজের কাজে চলে গেছে।”

তখন অভিজিৎ-বন্যার সঙ্গে অপরিচিত ওই যুবকরা ছাড়া পরিচিত আর কেউ ছিল না বলে বন্যার কাছে জেনেছেন অজয় রায়।

তিনি আরও বলেন, আসিফ ওই বৈঠকে আমন্ত্রিত ছিলেন বলে অভিজিৎকে বলা হয়েছিল। পরে বন্যা হাসপাতালে আসিফকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। 

সেদিন অভিজিৎ ও বন্যা চা খায়নি বলে জেনেছেন অজয় রায়।

প্রত্যক্ষদর্শী এক দোকানির বর্ণনা অনুযায়ী, অভিজিতের ওপর হামলাকারী ছিল দুজন। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও আহত হন বন্যা। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তা ফেলে দিয়ে দুই হামলাকারী দুই দিকে চলে যায়।

অজয় রায় বলেন, “আমাকে একজন বলেছে আমি নিজে জানি না। ওখানে নাকি একটা চায়ের দোকান ছিল। সেখানে নাকি ওরা, ওই যে মেরেছে দুজন দাঁড়িয়েছিল। দোকানদার জিজ্ঞেস করেছে- স্যার আপনাদেরকে কি চা দেব? তারা বলে যে, না চা আমরা পরে খাব।

“ওই দোকানদার বলেছে, ওই যুবকদের বয়স ২৫/২৬ বছর হবে। উচ্চতা অভিজিতের মতোই। বেশ ‍সুঠাম দেহ তাদের।”

“অভিজিৎ তার দলবল নিয়ে এখান (ঘটনাস্থল) দিয়ে যাবে। এই খবর নিশ্চয় ভেতর থেকে দেওয়া হয়,” ধারণা অজয় রায়ের।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী গোয়েন্দা পুলিশ এখনও খুনিদের শনাক্ত করতে পারেনি। ফারাবী শফিউরকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তারা।

ওই বৈঠকের বিষয়ে ফারসীম মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেদিন যে সাত/আট জন ছিলেন, তাদের দুজন বাদে আর সবাই তার চেনা।

“দাদাও তো ( অভিজিৎ রায়) চিনতেন এদের সবাইকে। আর দাদার সাথে কথা বলেই আমি ফেইসবুকে ইভেন্ট দিয়েছিলাম। তো এটা তো সবাই জানে।”

“সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বইমেলায় শুদ্ধস্বরের স্টলের কাছে ওই আড্ডায় অচেনা কারও থাকার সম্ভাবনা হাইলি আনলাইকলি,” বলেন তিনি।

ফারসীমের বক্তব্য অনুযায়ী সেখানে ছিলেন, বুয়েটের সাবেক ছাত্র ও বিজ্ঞান সাময়িকী ‘জিরো টু ইনফিনিটি’র সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, লেখক আব্দুল গাফফার রনি, হিমাংশু কর, সালিম অর্ণব, ফারহানা মান্নান, অনু তারেক।

ফারসীম বলেন, “আব্দুল গাফফার রনির সাথে দুজন ছিল, যাদের একজন মধ্যবয়সী, কেবল এদেরই আমি চিনি না। বাকিদের বলতে পারি আমি চিনি।”

বিজ্ঞান লেখকদের বই প্রকাশ উপলক্ষে ওই আড্ডার আয়োজন হয়েছিল বলে জানান তিনি। “আর দাদা (অভিজিৎ) তো ২০১২ সালেও বিজ্ঞান আড্ডায় এসেছিলেন, এই বইমেলার সময়ই।”

আসিফের না আসার বিষয়ে ফারসীম বলেন, “উনি তো ইনভাইটেড ছিলেন। এখন কেন আসেন নাই, তা তো জানি না। আর নিত্য কে, তা আমি জানি না।”

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ফয়সাল আতিক)

[সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচিত অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার বাবা অজয় রায়ের একটি সাক্ষাৎকার ভিডিওসহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আসছে অচিরেই]