সুবহানের ফাঁসির রায় হত্যাযজ্ঞে

মুক্তিযুদ্ধকালে পাবনায় রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আবদুস সুবহান; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার ফাঁসির রায় এসেছে নিরপরাধ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর দায়ে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Feb 2015, 02:16 PM
Updated : 18 Feb 2015, 05:13 PM

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, আব্দুস সুবহান ও তার সহযোগীরা ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে সাধারণ মানুষদের টেনে হিঁচড়ে বের করে তলোয়ারের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এ নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা ‘বিশ্বাস করা কঠিন’।

মৃত্যুদণ্ডই তার অপরাধের ‘যোগ্য শাস্তি’ উল্লেখ করে আমৃত্যু ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে তার দণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

প্রসিকিউশনের আনা ১ নম্বর অভিযোগে ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে বের করে ২০ জনকে হত্যা; ৪ নম্বর অভিযোগে সাহাপুর গ্রামে ছয়জনকে হত্যা এবং ৬ নম্বর অভিযোগে সুজানগর থানার ১৫টি কয়েকশ মানুষকে হত্যার দায়ে সুবহানকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে।

২ নম্বর অভিযোগে পাকশী ইউনিয়নের যুক্তিতলা গ্রামে পাঁচজনকে হত্যা এবং ৭ নম্বর অভিযোগে সদর থানার ভাড়ারা ও দেবোত্তর গ্রামে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে দেওয়া হয় আমৃত্যু কারাদণ্ড।

এছাড়া ৩ নম্বর অভিযোগে ঈশ্বরদীর অরণখোলা গ্রামে কয়েকজনকে অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় সুবহানকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হওয়ায় আজহারকে আর জেল খাটতে হবে না। তিনি ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সুযোগ পাবেন।  

৫, ৮ ও ৯ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউসন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে সুবহানকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

প্রাণদণ্ড

অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল বিকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর সহায়তায় জ্বালাও-পোড়াও, গোলাবর্ষণ করে হত্যাকাণ্ড চালাতে চালাতে পাবনা শহরে প্রবেশ করে। এ অবস্থায় জীবন বাঁচানোর জন্য  মোতালেব আহমেদ খান, নাজমুল হক খান, আ.ত.ম শহিদুজ্জামান নাসিম, মোয়াজ্জেম হোসেন, আজিজুল হক, বাবর আলী সরদার, আজহারউদ্দিন, রফিক পাটোয়ারী ও বারেক খলিফাসহ প্রায় দুইশ’ নিরস্ত্র লোক ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়।

ওই রাতে মওলানা সুবহান তার সহযোগীদের নিয়ে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ সমর্থক মোয়াজ্জেম হোসেনকে সনাক্ত করে তাকে মসজিদ থেকে বের করে পার্শ্ববর্তী ঈশ্বরদী রেলওয়ে কয়লার ডিপোতে নিয়ে ছুরি, চাকু ও তরবারি দিয়ে আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাবনা শহরের দিকে চলে যায়।

পরদিন ১৮ এপ্রিল আসামি সুবহান আবারও ওই মসজিদে এসে সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের মধ্যে থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থক মোতালেব আহমেদ খান ও তার ছেলে নাজমুল হক খানকে মসজিদ থেকে পাশের ঈশ্বরদী রেলওয়ে কয়লার ডিপোতে নিয়ে ছুরি, চাকু ও তরবারি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। এরপর ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া অন্তত ২০ জনকে সুবহানের নির্দেশে রেলওয়ে কয়লার ডিপো ও আশেপাশে হত্যা করা হয়।

আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে অপহরণ,  নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(এইচ) ধারায় সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ২ মে আসামি আবদুস সুবহানের নেতৃত্বে খোদাবক্স খান, স্থানীয় বিহারী ও পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী থানার সাহাপুর গ্রামে হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালায়।

ওইদিন ফজরের নামাজের পর মওলানা সুবহানের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনারা সাহাপুরের হারু ব্যাপারীর বাড়ির সামনের রাস্তায় চাঁদ আলী প্রামাণিক, আকতার প্রামাণিক, আনার প্রামাণিক ও হামেজ উদ্দিন প্রামাণিককে গুলি করে হত্যা করে। রজব আলী বিশ্বাসের বাড়ির পাশে বাঁশবাগানে গুলি করে হত্যা করা হয় রজব আলীসহ তার বন্ধু শামসুল হককে। এছাড়াও সাহাপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী সরদারসহ অনেককে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে। ওইসময় ১০/১৫টি বাড়িঘরের মালামাল লুট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

আসামির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ)  ধারায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ১২ মে সুজানগর থানার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের মোমরাজপুর, কুড়িপাড়া, তারাবাড়িয়া, ফকিৎপুর, সাতবাড়িয়া, কন্দর্পপুর, সিন্দুরপুর, নিশ্চিন্তপুর, গুপিনপুর, হরিরামপুর, শ্যামনগর, নাড়–হাটি, সিংহনগর, ভাটপাড়া ও গুপিনপুর গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, হিন্দু সম্প্রদায় ও স্বাধীনতাকামী নিরীহ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর তাণ্ডব চালায় সুবহান ও তার লোকেরা। তার নেতৃত্বে আনুমানিক তিনশ পাকিস্তানি সেনা সেদিন অন্তত চারশ লোককে অপহরণের পর হত্যা করে। বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় লোকজন পরে পদ্মার তীর থেকে আহতদের উদ্ধার করে। নিহত অনেকের লাশ গণকবর দেওয়া হয়। মাওলানা সুবহান ও পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে সাতবাড়িয়া এলাকার হাজার হাজার নিরীহ জনতা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।

এ ঘটনায় আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে খুন ও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) (এইচ) ধারায় তার ফাঁসির রায় এসেছে।

 

আমৃত্যু কারাদণ্ড

অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ঈশ্বরদী থানার পাকশী ইউনিয়নের যুক্তিতলা, বাঘাইর ও গোপালপুর গ্রামে আবদুস সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বিহারীরা সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট করে এবং পুড়িয়ে দেয়। বাঘইর গ্রামের আইজউদ্দিনের বাড়ি থেকে তার স্ত্রী তুলু খাতুন, ছেলে ইসরাইল ও ভাই তাইজউদ্দিনকে অপহরণ করা হয়।

এরপর সুবহান ও তার লোকেরা যুক্তিতলা গ্রামের জয়েনউদ্দিন মেম্বার, আহসান আলী ইঞ্জিনিয়ার, রুস্তম আলী, হারেছ উদ্দিন প্রামাণিক ও ইসমাইল হোসেনকে ধরে নিয়ে যুক্তিতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে লাইন ধরে দাঁড় করায়। পাকিস্তানি সেনারা তাদের ওপর গুলি করলে জয়েনউদ্দিন মেম্বার, আহসান আলী ইঞ্জিনিয়ার, ইসমাইল হোসেন, হারেছউদ্দিন ও তাইজউদ্দিন নিহত হন।

এসব হত্যাকাণ্ডে আসামির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) ধারায় তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ৭: ১৯৭১ সালের ২০ মে সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা পাবনা সদরের ভাড়ারা গ্রামের আব্দুল জব্বার, সিরাজ শেখ, নুরুল ইসলাম শেখ, রুস্তম শেখ ও আব্দুল মজিদুল শেখ, তালেব শেখ, আকবর শেখ, হারুন-অর-রশিদ, মানিক খাঁ, উটকেন শেখ, কাদের শেখ, খেদন শেখ, কাদের শেখ, গেদন সরদার, দেলবার শেখ, ইয়াদ আলী সরদার, হাকিম সরদার ও সিরাজুদ্দিন শেখকে তাদের বাড়ি ও গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ করে ভাড়ারা স্কুল মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে সুবহানের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনারা মজিদুল হককে গুলি করে হত্যা করে। ভাড়ারা গ্রামের কালি কমল পালকে তার নিজের বাড়িতে হত্যা করা হয়। অপহৃত অন্যদের পাবনা শহরের নূরপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানো আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। পরদিন আটঘরিয়ার দেবত্তোর বাজারে ১০ জনের ওপর  গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করা হয়।

এসব হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ)  ধারায় সুবহানকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

 

পাঁচ বছর সাজা

অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার সহযোগীদের নিয়ে ঈশ্বরদীর অরণখোলা গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ নির্যাতন চালান সুবহান। এ সময় ঘরবাড়িতে লুটপাট করে আগুন দেওয়া হয়।

১৬ মে সুবহান তার সহযোগী স্থানীয় বিহারীদের নিয়ে অরণখোলা গরুরহাট থেকে জয়নুদ্দিন ও আনসার কমান্ডার আলাউদ্দিন মিয়াকে অপহরণ করে জেলা পরিষদ ডাক বাংলোতে নিয়ে তিনদিন আটকে রেখে নির্যাতন করে।

অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সুবহানকে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ)  ধারায় পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৫, ৮ ও ৯ নম্বর অভিযোগ থেকে সুবহানকে খালাস দিয়েছে আদালত।