আইভী কাউকে ‘বাঁচাতে’ চাইছেন: শামীম ওসমান

চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় কথিত ‘গডফাদারদের’ ওপর দোষ চাপিয়ে নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2014, 09:15 AM
Updated : 12 August 2014, 12:21 PM

সাতজনের ‘শরীরে ইট বেঁধে পেট কেটে’ নদীতে ফেলে দেয়ার পর সবগুলো লাশ একসঙ্গে কীভাবে ভেসে উঠল- তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী এই নেতা মনে করছেন, ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।

আর সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেন ‘কোনো না কোনোভাবে’ ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলেও তার বিশ্বাস।

সাত খুনের ঘটনায় মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সামনে এসে এসব বিষয়ে কথা বলেন শামীম।

গ্রেপ্তার হওয়া র‌্যাব সদস্যরা দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়ার পরও আইভী ‘গডফাদাররা জড়িত’ বলে মন্তব্য করায় তিনি বলেন,  “১৬৪ ধারায় জবানবন্দির পরও যখন তিনি এ কথা বলছেন, এজন্য আমার মনে হচ্ছে সে কাউকে না কাউকে সেইফ করতে চাইছে।”

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান আলী মোল্লার কক্ষে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা এই জিজ্ঞাসাবাদ চলে।

শাহজাহান মোল্লা পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্থানীয় একজন সাংসদ ও একজন সাক্ষী’ হিসাবে শামীমের জবানবন্দি নিয়েছেন তারা। জিজ্ঞাসাবাদে শামীম সহযোগিতা করেছেন এবং বিভিন্ন ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম গত ২৭ এপ্রিল অপহৃত হন। পরে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

অপহরণের ঘটনার পরপরই নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করা হয়। নূর হোসেন র‌্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন বলে নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন।

শুরুতে অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিলেও অপহৃতদের লাশ উদ্ধারের পর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান নূর হোসেন। পরে দুই সহযোগীসহ তিনি পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হন।

নূর হোসেন পালিয়ে যাওয়ার আগে সাংসদ শামীমের সঙ্গে টেলিফোনে তার কথোপকথনের একটি অডিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে নূর হোসেনের সঙ্গে ওই ফোনালাপের কথা স্বীকারও করেন শামীম।

‘নূর হোসেনকে পদ দিয়েছেন আইভী’

সোমবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকেও ওই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত কমিটি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জের ‘গডফাদাররাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে’ সাত খুনে জড়িত।

এই ‘গডফাদার’ কারা জানতে চাইলে আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জে কারা ‘গডফাদার’ তা দেশের সবাই জানে। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে বলার কিছু নেই।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শামীম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, “উনি এবার আমার নাম উচ্চারণ করেন নাই। প্রথম প্রথম আমার নাম বলতেন। এখন গডফাদার বলছেন। আগামীতে গডফাদারও বলবেন না।”

মেয়রকে একজন ‘করাপটেড মেয়ে মানুষ’ আখ্যায়িত করে এই সংসদ সদস্য বলেন, “আমি ওকে এতো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনাও করি না।”

নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সন্তান শামীম বলেন, “সে (আইভী) যদি আমাকে বা আমাদেরকে গডফাদার বুঝিয়ে থাকে, তাহলে তার উচিৎ ছিল তদন্তকারীদের কাছে তথ্যপ্রমাণ হাজির করা।”

এই সাংসদ দাবি করেন, নূর হোসেন তার দলের লোক হলেও ‘তার লোক’ নন। বরং মেয়র আইভীই ওই কাউন্সিলরকে ‘বড় বড় পদে’ বসিয়ে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন বলে তার অভিযোগ।

“নূর হোসেনকে আমার লোক সাজাতে চেয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করেন, সে কাকে সেইফ করতে চাইছে।”

শামীম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, আইভী যে ‘দুর্নীতিবাজ’- তা তিনি ‘যে কোনো সময়’ প্রমাণ করে দিতে পারেন।

‘নূর হোসেন জড়িত’

গণমাধ্যমে আসা অডিও টেপের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শামীম স্বীকার করেন, টেলিফোনে নূর হোসেনের সঙ্গে ওই কথোপকথনে তার কণ্ঠই শোনা গেছে। তবে ওই অডিও প্রকাশ করা হয়েছে আংশিকভাবে। 

“সে বলেছে, ‘আপনি আমার বাপ লাগেন, আমি লেখাপড়া করি নাই, আমারে মাফ করেন ভাই।’ … তার কথাতেই প্রমাণ হয়, আমি তাকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেই নাই।

“আমি পরে কিছু কথা বলেছিলাম, আমি তাকে সারেন্ডার করতে বলেছিলাম, সেগুলো ক্লিপে নাই।”

সাত খুনের ঘটনায় নূর হোসেন জড়িত বলে মনে করেন কি না- এমন প্রশ্নে শামীম ওসমান বলেন,  “আমার মনে হয়, কোনো না কোনোভাবে সে ইনভলভড, আগে হোক বা পরে।”

তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিৎ মন্তব্য করে এই সাংসদ বলেন, “আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে আজকেই নূর হোসেনকে দেশে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতাম।”

‘রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা’

কমিটির জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন দলের এই সাংসদ বলেন,  “ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যেই মন্তব্য করেছিলাম, সর্ষের মধ্যে ভুত আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই একজন কর্মকর্তা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। আমরা কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।”

ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে তিনি কীভাবে এতোটা নিশ্চিত হলেন জানতে চাইলে শামীম বলেন, “এক ঘণ্টা না, আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে জানতে পেরেছি র‌্যাব তাদের তুলে নিয়ে গেছে। ওটা আমার নির্বাচনী এলাকা। আমার নির্বাচনী এলাকার পাগলও আমি চিনি। আর সাধারণ মানুষ কিন্তু এলাকার নেতাকেই আগে খবর দেয়। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে গেছে তখন তারা তো আমার কাছেই আসবে।”

তিনি বলেন, আগামী দিনে যাতে বিচার বহির্ভূত হত্যা আর না হয় সেজন্য কমিটিকে কিছু পরামর্শও তিনি দিয়েছেন।

সাতজনের ‘শরীরে ইট বেঁধে পেট কেটে’ নদীতে ফেলে দেয়ার পর সবগুলো লাশ একসঙ্গে কীভাবে ভেসে উঠল- তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন শামীম।

তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাষ্ট্রকে ‘অস্থিতিশীল করার কোনো চেষ্টা’ থাকতে পারে।

সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে নিজেদের ‘দোষ স্বীকার’ করে আদালতে তারা জবানবন্দিও দেন।

এই খুনের ঘটনা আগে থেকেই জানতেন বলে সে সময় র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

‘ত্বকী হত্যারও তদন্ত হোক’

নারায়ণগঞ্জে সত্যিই কোনো গডফাদার আছে কি-না এমন প্রশ্নে শামীম ওসমান বলেন, “ভাই মানুষ মারল র‌্যাবে যাইয়া, লোক মরল আমার, আর গডফাদার হইলাম আমরা।”

গডফাদার শব্দটির অর্থ জানেন না দাবি করে এই সাংসদ বলেন, “শব্দটা তৈরি করেছিল একটা পত্রিকা। … গডফাদার আছে কি নেই, আপনারাই তার বড় সাক্ষী।”

তিনি দাবি করেন,  সারা দেশের মানুষ যতোটা নিরাপদ, নারায়ণগঞ্জের মানুষও ততোটাই নিরাপদ।

“নারায়ণগঞ্জ দেশের অনেক জায়গার চেয়ে শান্তিপূর্ণ এলাকা।  আর কিলিং তো ওয়াশিংটন ডিসিতেও হয়।”

মেয়র আইভী এর আগে ত্বকী হত্যার ঘটনাতেও তাকে জড়াতে চেয়েছে মন্তব্য করে শামীম বলেন, “আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আজ হাই কোর্টের কাছে আবেদন করছি, এই ঘটনার মতো ত্বকীর ঘটনারও তদন্ত করা হোক।”

রানা ও আরিফের মতো কর্মকর্তারাই ত্বকী হত্যার তদন্ত করেছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “একজন দুর্নীতিবাজ দিয়ে তদন্ত কীভাবে সুষ্ঠু হয়- তা আমার প্রশ্ন।”

‘সত্য ঘটনা উদঘাটন হবে’

শামীম ওসমানকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান আলী মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, “বিষয়টি সেনসেটিভ। ওই ঘটনা আমাদের সবাইকে নাড়া দিয়েছে। তদন্ত এগিয়ে যাচ্ছে।  যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা কাজ শেষ করব।  সত্য ঘটনা উদঘাটন করে প্রতিবেদন দেব।”

আড়াই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদে শামীম সহযোগিতা করেছেন কি না জানতে চাইলে কমিটির প্রধান বলেন, “সহযোগিতা করেছেন, আমরা সন্তুষ্ট।”

শাহজাহান মোল্লা বলেন , “আপনাদের মনে রাখতে হবে তিনি একজন সংসদ সদস্য। এলাকার অনেক খুঁটিনাটি উনি জানেন। এ কারণে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, পরামর্শ নেয়া হয়েছে।”

সাত খুনের ঘটনায় শামীম ওসমানের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব বলেন, “এটাও আমাদের তদন্তের একটি অংশ।”

সাত খুনের ঘটনায় র্যর‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তে হাই কোর্টের নির্দেশে গত ৭ মে এই তদন্ত কমিটি করে সরকার।

নারায়ণগঞ্জের অপহরণ ও হত্যার সঙ্গে প্রশাসনের কোনো সদস্য বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা বা সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না- গণতদন্তের মাধ্যমে তা উদঘাটন করবে কমিটি।

অপহৃত ব্যক্তিদের জীবিত উদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো অবহেলা বা গাফিলতি ছিল কি না- কমিটিকে তাও খতিয়ে দেখতে বলেছে আদালত।

এই তদন্ত কমিটি এ পর্যন্ত ৩৫০ জনের বেশি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যাদের মধ্যে র্যর‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তারাও আছেন।

আগামী ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আদালতে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কথা রয়েছে এই তদন্ত কমিটির। ইতোমধ্যে কমিটি হাই কোর্টে কয়েক দফা অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে বলেছে, ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত সেটা তারা জানতে পেরেছেন। কি কারণে তারা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, এখন তা জানতে তদন্ত চলছে।