কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় লেখা শেষ

জামায়াতে ইসলামী নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেয়া আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা শেষ হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2013, 01:47 PM
Updated : 24 Nov 2013, 04:14 PM

মৃত্যুদণ্ডাদেশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা তার রায় জমা দিয়েছেন বলে রোববার আদালত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।  

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটরদের সমন্বয়ক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা শেষ হয়েছে।”

এর মাধ্যমে উন্মুক্ত আদালতে রায় ঘোষণার ৬৮ দিন পর এই রায় লেখা শেষ হল।

কাদের মোল্লার রায় প্রদানকারী ৫ বিচারপতির বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি নেতৃত্ব দিলেও মূল রায়টি লিখেছেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

এই রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও আলাদা মতামত দিয়েছেন বিচারপতি এসকে সিনহা। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মূল রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

একাধিক বিচারক রায় লিখলে লেখা শেষ হওয়ার পর নিয়ম অনসারে প্রধান বিচারপতি তা একত্রিত করেন। এরপর চূড়ান্ত অনুলিপিতে সব বিচারকের স্বাক্ষর নিয়ে তা প্রকাশ করা হয়।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া এই রায়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশের পক্ষে ছিলেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। 

বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা এই রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে পাঁচটি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।   

যে একটি অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়েছিল বিচারিক আদালত, আপিলের রায়ে তাতে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়। অন্য যে চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের শাস্তিই বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

রায়ে দেখা যায়, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিল চলতে পারে বলে একমত হয়েছেন বেঞ্চের পাঁচ বিচারক। আপিল মঞ্জুর হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।

রায়ে বলা হয়, ষষ্ঠ অভিযোগে ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল। মৃত্যু পর্যন্ত তাকে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।

ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৬ মার্চ কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় যান। সেখানে কাদের মোল্লার নির্দেশে লস্করের স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা করা হয়। এক মেয়ে হন ধর্ষণের শিকার।

চতুর্থ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া খালাসের রায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাতিল করে আপিল বিভাগ। ওই অপরাধে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর কাদের মোল্লা রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি এবং ঘাটারচরে শতাধিক গ্রামবাসীকে হত্যা করেন।

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দণ্ড বহালের পক্ষেও ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আপিল বিভাগের রায় হয়।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম অভিযোগ, ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল তার নির্দেশে মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

দ্বিতীয় অভিযোগ অনুযায়ী, ২৭ মার্চ কাদের মোল্লা সহযোগীদের নিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে তাদের মিরপুরের বাসায় গিয়ে হত্যা করেন।

কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে একাত্তরের ২৯ মার্চ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে আরামবাগ থেকে তুলে নিয়ে জল্লাদখানা পাম্পহাউসে নিয়ে জবাই করে হত্যা করেন বলে তৃতীয় অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, তিনি একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নিয়ে মিরপুরের আলোকদী গ্রামে যান এবং রাজাকার সদস্যদের নিয়ে গণহত্যা চালান। ওই ঘটনায় নিহত হন ৩৪৪ জনের বেশি।

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে কাদের মোল্লার ১৫ বছর করে কারাদণ্ডের রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। পঞ্চমটিতে হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়। এই দুটি দণ্ডই আপিল বিভাগ বহাল রাখে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে কাদের মোল্লার মামলায়ই প্রথম চূড়ান্ত রায় হয়, যেখানে সর্বোচ্চ আদালত বিচারিক আদালতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের পর সংশোধিত আপিল আইনের আওতায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় হয় ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিত এই যুদ্ধাপরাধীর।

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে ২৬ মার্চ মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা এবং এক মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে যারা অসন্তোষ জানিয়েছিল, আপিল বিভাগের রায়ে তারা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এটাই একাত্তরে নৃশংসতার যথার্থ রায়।

অন্যদিকে রায় প্রত্যাখ্যান করে ওইদিনই মিছিল থেকে বিভিন্ন স্থানে বোমাবাজি ও গাড়িতে আগুন দেয় জামায়াতকর্মীরা, দলটি সারাদেশে হরতালও ডাকে।

রায় ঘোষণার পরই গণজাগরণ মঞ্চসহ যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবির আন্দোলনকারীরা এই রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোপূর্বে সংসদে বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধের রায় দ্রুত কার্যকরের কথা বলেছেন। তবে এরপরও ওই রায় প্রকাশ হতেই ২ মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়।

এই রায় দেয়ার পর প্রাথমিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও পরে বিএনপির হাই কমান্ডে থাকা আইনজীবীরা সংবাদ সম্মেলন করে কাদের মোল্লাকে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ দেয়ার দাবি জানান।

আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে থাকা কাদের মোল্লার সামনে এখন রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগই অবশিষ্ট রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ।

আপিল পর্যালোচনার কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি বললেও আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের দাবি, সংবিধান অনুযায়ী কাদের মোল্লাও সেই সুযোগ পাবেন।

পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল বিভাগে সেই আবেদন করবেন বলেও জানান জামায়াত নেতার আইনজীবীরা।

আপিল বিভাগের রায়ের পর কাদের মোল্লাকে কনডেমে সেলে নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। কারা কর্মকর্তারা জানান, কাদের মোল্লা ক্ষমার আবেদন না করলে অথবা রাষ্ট্রপতি তার আবেদন নাকচ হলে তার ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে একাত্তরে হত্যাকাণ্ডের একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত শুরু হয়।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায়ের পর আব্দুল কাদের মোল্লা (ফাইল ছবি)

গত বছরের ২৮ মে বিচার শুরু করে গত ৫ মে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে সাজার রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

গণজাগরণ আন্দোলনের সূচনার দিন ৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল। বিকালের এই জমায়েতই পরে লাখো মানুষের সমাবেশে পরিণত হয়।

সেদিন আদালত ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জামায়াত নেতার দেখানো ‘ভি’ বা বিজয় চিহ্ন খবরে প্রকাশিত  হওয়ার পর রাজধানীর তরুণরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে বিরল এক সমাবেশের সৃষ্টি করে।

দেশ-বিদেশে ‘বাংলা বসন্ত’ নামে পরিচিতি পাওয়া সর্বস্তরের মানুষের অভূতপূর্ব এই অহিংস সমাবেশ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার দাবি ওঠে।

তার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে প্রসিকিউশন ও আসামি উভয় পক্ষের আপিলের সমান সুযোগ তৈরি করা হয়। আগের আইনে শুধু আসামির খালাসের ক্ষেত্রেই প্রসিকিউশন আপিল করতে পারত।

আইন সংশোধনের পর প্রসিকিউশন সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করে। সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আপিল করেন কাদের মোল্লা।

গত ১ এপ্রিল আপিলের শুনানি শুরু হয়। তখন আসামি পক্ষ প্রশ্ন তোলে, কাদের মোল্লার রায়ের পর আইন সংশোধন হওয়ায় তার ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনের প্রয়োগ করা যাবে কি না।

এই বিষয়টির সুরাহায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবীর বক্তব্য শুনে আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত নেয়, কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সংশোধিত আইন কার্যকর হবে।

সাড়ে পাঁচ মাস শুনানির পর ১৭ সেপ্টেম্বর আসামি পক্ষের আপিল আবেদন খারিজ করে দিয়ে প্রসিকিউশনের আপিল আবেদন গ্রহণ করে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

মামলার ইতিবৃত্ত

মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়।

এছাড়া ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদেরের বিরুদ্ধে। এ মামলাতেই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই জামায়াতের এই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১১ সালের ১ নভেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

গতবছর ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় তার বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক।

দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। এর পক্ষকাল পর কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল।

কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আপিলের ক্ষেত্রে যে অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য শোনে আদালত, তারা হলেন- রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, টি এইচ খান, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আজমালুল হোসেন কিউসি ও এ এফ হাসান আরিফ।