কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় মঙ্গলবার

একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার চূড়ান্ত রায় জানা যাবে মঙ্গলবার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2013, 11:11 AM
Updated : 16 Sept 2013, 06:52 PM

সুপ্রিম কোর্টের কার্য তালিকার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট শাখা সোমবার বিকালে এ তথ্য জানায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিউশনের সমন্বয়ক এমকে রহমানও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সন্ধ্যায় আপিল বিভাগের মঙ্গলবারের কার্যতালিকায় শীর্ষেই দেখা যায় কাদের মোল্লার রায় সংক্রান্ত আপিল।

অর্থাৎ সকালে আপিল বিভাগের কার্যক্রমের শুরুতেই এই আপিলের রায় হবে।

রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আপিল শুনানি শেষে গত ২৩ জুলাই আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে সর্বোচ্চ আদালত। যুদ্ধাপরাধের কোনো মামলায় এই প্রথম আপিল শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায় আসতে যাচ্ছে।

একাত্তরে যুদ্ধপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার সাড়ে ৫ মাসেরও বেশি সময় পর সুপ্রিম কোর্টে দুই পক্ষের আপিল শুনানি শেষ হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৫ বিচারকের বেঞ্চ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।

আপিলে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। অন্যদিকে আসামিপক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।

২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

রায়ে বলা হয়, এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে আনা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং একটি রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেননি।

এর মধ্য দুটি অভিযোগে মিরপুরের আলোকদী গ্রামে গণহত্যা এবং অন্য এক ঘটনায় হযরত আলী লস্করকে তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা এবং লস্করের মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পরও কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়। আর দুটি অভিযোগে দেয়া হয় ১৫ বছর কারাদণ্ড।

ওই রায়ের পর কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে সারাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হলে সরকার আইন সংশোধন করে আপিলের ক্ষেত্রে প্রসিকিউশন ও আসামি- উভয় পক্ষের সমান সুযোগ তৈরি করে।

আগে প্রসিকিউশন শুধু খালাসের ক্ষেত্রে এবং আসামিপক্ষ সব ক্ষেত্রেই আপিল করার সুযোগ পেত।

আইন সংশোধনের পর রায়ের এক মাসের মধ্যে উভয়পক্ষই ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। আপিলে কাদের মোল্লা বেকসুর খালাস চান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণিত অভিযোগগুলোতে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ দণ্ডের পাশাপাশি খালাস পাওয়া অভিযোগে ন্যায় বিচার চায়।

আপিলের পর বেশ কিছু পদ্ধতিগত কাজ শেষে গত ১ এপ্রিল এই মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়। এর আগেই আপিল বিভাগে গঠন করা হয় দুটি বেঞ্চ।

এর একটিতে নেতৃত্ব থাকেন প্রধান বিচারপতি নিজেই, যে বেঞ্চে শুনানি হয় যুদ্ধাপরাধের আপিলের মামলা।

প্রথম দিকে ওই বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ছিলেন।

তবে বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া অবসরে যাওয়ায় জুন মাস থেকে ৫ বিচারপতি নিয়েই চলছে এই বেঞ্চ।

আইনে আপিল বিভাগে ৬০ দিনের মধ্যে এ ধরনের আপিল নিষ্পত্তির নির্দেশনামূলক বিধান কার্যকর হলে সিদ্দিকুর রহমান মিয়া পদে থাকাকালেই শেষ হয়ে যেতো কাদের মোল্লা ও সাঈদীর আপিল শুনানি।

এই বেঞ্চের দুইজন বিচারককে যুদ্ধাপরাধ মামলা থেকে নিবৃত্ত করতে আবেদন করেছিলেন কাদের মোল্লা। শুনানির এক পর্যায়ে এই বেঞ্চের বাকি চার বিচারকও ওই আবেদন শোনেন। তবে তারা আবেদনটি গ্রহণ করেনি।

উভয়পক্ষের আইনজীবীরা ৪০ দিনের মতো এ মামলায় নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। কিন্তু শুনানির এক পর্যায়ে কাদের মোল্লার আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক সংশোধিত আইন তার মক্কেলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই বিচারে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন উঠে।

এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তার জন্য গত ২০ জুন ৭ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন প্রধান বিচারপতি।

সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বক্তব্যের মাধ্যমে গত ৮ জুলাই অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য নেয়া শুরু হয়।

এরপর ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফের বক্তব্যের মাধ্যমে ২২ জুলাই অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য শেষ হয়।

অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে রফিক-উল হক, আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, আজমালুল হোসেন ও রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, সংশোধিত আইন কাদের মোল্লার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে বলে তারা মনে করেন।

তবে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফ বলেন, আইন সংশোধনের আগে কাদের মোল্লার রায় হওয়ায় সংশোধিত আইন কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

দণ্ড বাড়াতে প্রসিকিউশনকে আপিলের সুযোগ না দেয়ার পক্ষপাতি হলেও তিনি মনে করেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে কাদের মোল্লার যে আপিল রয়েছে, আদালত চাইলে তার ভিত্তিতেই দণ্ড বাড়াতে বা কমাতে পারে।

টিএইচ খানও বলেন, প্রসিকিউশনের আপিলের সুযোগ কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

অন্যদিকে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে বিভিন্নমুখী মত আসে অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্যে।

ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে কাদের মোল্লা ছাড়া সাঈদী ও কামরুজ্জামানের আপিল উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে।

সরকারের বর্তমান মেয়াদেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করার ব্যাপক জনদাবির মুখে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, বর্তমান মেয়াদেই রায় কার্যকর করার বিষয়ে তিনি আশাবাদী।