ইভিএমে উচ্ছ্বাসই বেশি

চার নগরবাসীর অধিকাংশের কাছে যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট দেয়ার আধুনিক পদ্ধতি সহজ মনে হলেও কেউ কেউ বিভ্রান্তিতেও পড়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2013, 00:08 AM
Updated : 15 June 2013, 00:19 AM

এবারই প্রথম ইভিএমে ভোট দিচ্ছেন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে নগরবাসী। তবে এই চার নগরে সনাতন ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণ হলেও একটি করে ওয়ার্ডের কয়েকটি করে কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হচ্ছে।

শনিবার এই চার সিটি কর্পোরেশনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে, যা চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।

ইভিএমের আওতায় না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন রাজশাহীর সাত নম্বর ওয়ার্ডের রিমু পারভিন ও হীরা আক্তার।

রাজশাহী কলেজের স্নাতকের ছাত্রী রিমু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইভিএমে ভোট দেয়াই অনেক সহজ। আমরা সব কেন্দ্রেই ইভিএমে ভোট দিতে চাই।”

সিলেটে ইভিএমে ভোট দেয়ার পর গৃহকর্মী, গৃহিনী, দিনমজুর, স্বল্পশিক্ষিত বেশ কয়েকজনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও মন ‘খচখচ’ করার কথা জানান বেতারের সাবেক এক কর্মকর্তা।

সিলেট নগরীর ২ নম্বর ওয়ার্ডের মদন মোহন কলেজে কেন্দ্রে জীবনে দ্বিতীয়বার ভোট দিয়ে গৃহকর্মী মরিয়ম বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এত সহজে ভোট দেয়া যায় আগে ভাবিনি, এক টিপে কাজ শেষ। ভোট দিতে আইলাম আর গেলাম। ভালোই তো।”

মরিয়মের সঙ্গে থাকা পঞ্চাষোর্ধ্ব গৃহপরিচারিকা কল্পনা বেগম বলেন, “জীবনে ৫-১০ বার ভোট দেয়ার কথা ছিলো, কিন্তু দিতে পারিনি। কারণ দিনভর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।”

তবে এবার ইভিএমে দ্রুত ভোটগ্রহণ হওয়ায় ভোট দিতে পেরেছেন বলে জানান কল্পনা।

বৃদ্ধ দিনমজুর সতীন্দ্র কর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনোবার এত দ্রুত ভোট দিতে পারিনি। ভোটও দিলাম, এখন দিনভর কাজও করতে পারবো। সবই হইলো।”

সিলেট নগরীতে ২ নম্বর ওয়ার্ডের তিনটি কেন্দ্রে যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ চলছে।

তবে সিলেট বেতারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনসুর আলী ভোট দেয়ার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্রেনিং নিলাম, এরপরও কেমন জানি মনে হয়েছে। ভোট দেয়ার পরও মনটা খচখচ করছে।”

তার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শুনেছি, এটা দিয়ে ভোট গণনার সময় ম্যানিপুলেট করা যায়। অপারেটর ভোটকে ডিলেট করে দিতে পারে।”

এই বিষয়ে রসময় মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোট দিতে আসা লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র শিক্ষার্থী আব্দুল আজিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি অন্তত সেটা মনে করি না। ইভিএমের বিরুদ্ধে অনেকেই কথা বলছে। কিন্তু কেউই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করছে না।

“না করার কারণে বলা যায়, তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।”

একই কেন্দ্রের ভোটার দীপক কুমার বিশ্বাস বলেন, “দেশে তো এখন প্রযুক্তির জয়জয়কার। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই মোবাইল ব্যবহার করছে। এতে মানুষের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে ইভিএমে হবে কেন?”

বরিশালে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি কমার্স কলেজ ও বরিশাল জিলা স্কুল কেন্দ্রে ইভিএমে ১ হাজার ১৮১ জন ভোটারের ভোটগ্রহণ হচ্ছে।

ইভিএম পদ্ধতি সম্পর্কে ভোটারদের সচেতনতা তৈরির জন্য আগেই মাইকিং ও প্রচারপত্র বিলি হয়েছে। এছাড়া ভোট কক্ষে ঢোকার আগেও ভোটারদের ইভিএমে ভোট দেয়ার পদ্ধতি আবারো দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে।

কমার্স কলেজ কেন্দ্রে সর্বপ্রথম ভোট দেয়া মাহমুদা সাংবাদিকদের বলেন, “ইভিএমে ভোট অনেক সহজ ও দ্রুত মনে হয়েছে।”

এই কেন্দ্রে ভোট শুরুর ১৫ মিনিট আগে বৃষ্টি হলেও ভোট দেয়ার জন্য বৃষ্টিতে ভিজেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে ভোটারদের।

লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা আলেকান্দা পশ্চিম এলাকা থেকে আসা বিলকিস আক্তার (৬০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলন, “অনেকবার ভোট দিয়েছি। কিন্তু এভাবে কখনো ভোট দিইনি। বুক ধুক ধুক করছে।”

মা ও চাচির সঙ্গে এসে জীবনে প্রথম ভোট এবং তা ইভিএমে দিয়ে নূসরাত নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করলেও তার মা মাতোয়ারা বেগমের সংশয় কাটছে না।

“এর আগে প্রতীক দেখে সিল মেরেছি, এবার বোতাম টিপে দিলাম। জানি না ঠিক জায়গায় পড়ছে কি না,” বলেন তিনি।

খুলনার খালিশপুরে আট নম্বর ওয়ার্ডের পাঁচটি কেন্দ্রে ২১টি বুথে ৬ হাজার ২৩৭ জনের ভোট নেয়া হচ্ছে ইভিএমে।

ক্রিসেন্ট মাধ্যমিক স্কুল কেন্দ্রের কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নুরুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোটাররা বেশ উৎসাহের সঙ্গেই ভোট দিচ্ছেন। কোনো সমস্যা হয়নি।”

ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মো. শামীম নামে এক ব্যক্তি বলেন, “সহজ মনে হলো। বোতাম টিপলাম আর ভোট দেয়া হয়ে গেলো।”

দৌলতপুর জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে নারীদের ভোট দিতে সমস্যায় পড়তে দেখা যায়।

কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মহসিন মিয়া বলেন, “অনেকে কিছুটা সমস্যায় পড়লেও আমরা তাদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছি। অনেকে ভুল করলে তারা আরেকবার ভোট দেয়ার সুযোগও পাচ্ছেন।”

রাজশাহীর সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে গৃহিনী তাহেরা খাতুন (৩৬) বলেন, “কাগজ-মাগজের ঝামেলা নাই, ইভিএম অনেক ভালো। আমরা সব সময় এটাই চাই।”

ওই কেন্দ্রের প্রিজাইজিং কর্মকর্তা মোহা. জোহরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইভিএম-এ ভোট দেয়া নিয়ে ভোটারদের কোনো অভিযোগ নেই।

রাজশাহীতে আট নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ছাড়াও লক্ষীপুর বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হচ্ছে। এই তিন কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ৬ হাজার ৮২৫ জন।

নগরীর ১০ তলা মোড়ের বাসিন্দা মনিরা বেগম (৩৬) ল্যাবরেটরি হাই স্কুল কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট দিয়ে বলেন, “কোনো ঝামেলা হয়নি।”

৬০ বছর বয়সী আয়েশা বেগম জানান, তিনি আগেই ভোট দেয়ার পদ্ধতি শিখে নিয়েছিলেন।

এই কেন্দ্রের আরেক ভোটার রোকেয়া রহমান বলেন, “লাইফের সব চেয় কম সময়ে ভোট দিতে পেরেছি। একটু ভয় ছিল কিন্তু মার্কা দেখেই টিপে দিয়েছি।”

তবে লক্ষীপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ৮০ বছর বয়সী মো. আজগর হোসেন।

“এটা বদারেশন। ভোট দিয়ে কিছু্ই বোঝা গেল না। কোথায় যে ভোট গেল।”

ইভিএমে ভোট নেয়া রাজশাহীর তিনটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, তেমন ভিড় নেই। তাড়াতাড়ি ভোট নেয়ার ভোটারদের লাইনেও দাঁড়াতে হয়নি।
শনিবার সকাল ৮টা থেকে রাজশাহীর সিটি মেয়র নির্বাচনে রাসিকের ১৩৭টি কেন্দ্র ভোট শুরু হয়েছে। বিকাল ৪টা পর্ন্ত রাজশাহীর ২ লাখ ৮৬ হাজার ৯১৭ জন ভোটার ভোট দিয়ে নতুন মেয়র নির্বাচন করবেন।
এরার ভোটারদের মধ্যে এক লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৫ জন পুরুষ এবং এক লাখ ৪৩ হাজার ৫২২ জন নারী।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনে ৩০টি ওয়ার্ডে ১৩৭টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে, যাতে ৮৭১টি ভোটকক্ষ রয়েছে।
মেয়র পদে তিন জন, সাধারণ ওয়ার্ডে ১৫৫ জন ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৬৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবার।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মহানগরের সাধারণ সম্পাদক লিটন তালা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক বুলবুল আনারস প্রতীক নিয়ে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হাবিবুর রহমান (চশমা) প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

ভোটারদের মতো এই নির্বাচনের প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ইভিএম নিয়ে ইতিবাচক সাড়া দেখা গেছে।  

সিলেটের কাউন্সিলর প্রার্থী প্রদীপ ভট্টাচার্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষ সহজেই এতে ভোট দিচ্ছে। এতে কারচুপির সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।”

আরেক প্রার্থী বিক্রয় কর সম্রাট বলেন, “সব নতুনকেই তো স্বাগত জানাতে হবে।”

তবে কাউন্সিলর প্রার্থী মো. রাজিব মিয়া বলেন, “ওই যন্ত্রের মধ্যে একটা সিমকার্ডের মতো কার্ড আছে। সেটা বদলাইয়া ফালাইলে তো ফল বদলাইয়া যাইবো।”

সিলেট জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইভিএমে ভালোভাবেই মানুষ ভোট দিচ্ছে।

ইভিএমের কেন্দ্র পরিদর্শনের পর জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম জানান, ভোট নষ্ট হয়ে গেছে বলে কোনো ভোটারের অভিযোগ তিনি পাননি।

(এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য পাঠিয়েছেন কামাল হোসেন তালুকদার, মামুনুর রশীদ, আশিক হোসেন, শহীদুল ইসলাম, সুলাইমান নিলয়, সালাউদ্দিন ওয়াহিদ; ছবি তুলেছেন মুস্তাফিজ মামুন ও আসাদ রতন)