‘বাস্তবতায়’ গুমরে মরে নূর হোসেনের ভাইয়ের ক্ষোভ

মন থেকে সায় মেলে না, তবু ‘বাস্তবতা’- আলী হোসেন তাই মেনে নেন নিজের দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে এইচ এম এরশাদের জোট; চেপে রাখেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ভাই নূর হোসেনের আত্মাহুতির কথা।

আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2012, 11:58 AM
Updated : 10 Nov 2015, 03:59 AM

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নূর হোসেনের আত্মত্যাগের ২৫ বছরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ভাই হারানোর সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং নিজের পরিবারের সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরেন আলী হোসেন।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে রাজধানীর কেন্দ্র তৎকালীন জিরো পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন নূর হোসেন। বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’- স্লোগান লিখে রাজপথে নেমেছিলেন যুবলীগের এই কর্মী।

নূর হোসেনের আত্মত্যাগে আন্দোলন হয় তীব্র, তার ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে পতন ঘটে এরশাদের। তারপর থেকে প্রতি বছরের ১০ নভেম্বর পালিত হচ্ছে নূর হোসেন দিবস, জিরো পয়েন্টের নামও করা হয়েছে নূর হোসেন চত্বর।

পতিত সামরিক শাসক এরশাদকে আওয়ামী লীগের জোটে রাখার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কিছু সময় চুপ থাকেন আলী হোসেন।

তারপর বলতে থাকেন- “এরশাদ সাহেব কয়েকবার আমার বাবার কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন, কিন্তু তবুও আমি তাকে বিশ্বাস করি না।”

“তার (এরশাদ) বিচার আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। সে যা করেছে তার জন্য তার ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। তাহলে এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত।”

আবেগাপ্লুত এই কণ্ঠ পরক্ষণেই ফিরে আসে ‘বাস্তবতায়’- “এরশাদ অন্যায় করেছে, তার কারণেই আমি আমার ভাই হারিয়েছি। কিন্তু এটাও সত্য, এই সরকার (আওয়ামী লীগ) আমাদের জন্য যা করেছে তা না করলে আমাদের না খেয়ে মরতে হত। তাই খারাপ লাগলেও দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে এরশাদের মহাজোটে থাকার বিষয়টা মেনে নিয়েছি।”

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান আলী হোসেন। এখনো তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

সরকার পরিবারের কোনো খোঁজ খবর রাখে কি না- জানতে চাইলে আলী হোসেন বলেন, ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার শহীদ পরিবার হিসেবে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পাশে ৫ কাঠার একটি জমি দিয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলই খোঁজ নেয়।

“এমনকি এরশাদও কয়েকবার বাসায় এসেছে।” তবে জামায়াতে ইসলামী কখনো খোঁজ-খবর নেয়নি, এজন্য অসন্তুষ্টিও নেই নূর হোসেনের ভাইয়ের।

“আমার ভাই সারা জীবন রাজাকারদের ঘৃণা করেছে। এই কারণেই হয়ত আল্লাহর রহমতে যুদ্ধাপরাধী এ দলটি (জামাত) আসেনি।”

শেখ হাসিনা কখনো পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন কি না- জানতে চাইলে আলী হোসেন বলেন, “৯১ সালের দিকে একবার বাবাকে ডেকেছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করতেন, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না ইত্যাদি। এছাড়াও আমার কাছেও বিভিন্ন সময় খোঁজ খবর নেন।”

“তার (শেখ হাসিনা) একটা অভ্যাস, নিজের হাতে রান্না করে আশে পাশের সবাইকে খাওয়ানো। সে হিসেবে আমিও কয়েকবার তার হাতের রান্না খেয়েছি,” যোগ করেন তিনি।

আলী হোসেনের আড়াই বছরের ছোট ছিলেন নূর হোসেন। তাই ভাইয়ের সঙ্গে ছেলেবেলার স্মৃতি প্রায়ই নাড়া দেয় আলী হোসেনকে।

“পরিবারে আমরা চার ভাই ও এক বোন। বাবা অটোরিকশা চালাতেন। পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোডে একটি এক কামরার বাসায় কোনো রকমে গাদাগাদি হয়ে থাকতাম।”

বাবার সামর্থ্য না থাকায় পড়াশোনা এসএসসি পর্যন্ত এগিয়ে নিতে পারেননি আলী হোসেন। তবে শহীদ ভাই নিজের চেষ্টায় উচ্চ মাধ্যমিকের বৈতরণীও পার হয় বলে জানান তিনি।

“নূর সব সময়ই একটু অন্যরকম ছিল।”

“ওই সময় নূর ছিল ২০/২২ বছরের যুবক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করত, রাজনীতিও করত। সে ছোট থেকেই দেশ নিয়ে ভাবত। আমরা অত বুঝতাম না। নূর বলত গণতন্ত্রের কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা।”

“আমাদের পরিবারের দারিদ্র্য নিয়েও সে ভাবত। স্বপ্ন দেখত, একদিন আমাদের অবস্থারও পরিবর্তন হবে। আজ আমরা সবগুলো ভাইবোন স্বাবলম্বী হয়েছি। আমার ভাইটা দেখে যেতে পারল না,” কণ্ঠ ধরে আসে আলী হোসেনের।

পুরান ঢাকার সেই পাট চুকিয়ে এখন মিরপুরে ২ নম্বর সেকশনে একটি বাসায় থাকেন আলী হোসেন। বাবা মারা গেছেন, মা থাকেন আরেক ভাইয়ের বাসায়। সরকারের দেয়া জমিতে বাড়ি তুলতে পারলে পরিবারের সবাই আবার এক সঙ্গে থাকবেন বলে আশা করেন তিনি।

রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো চাওয়া আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার ভাই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে শহীদ হয়েছেন। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দাবি, আপনারা ক্ষমতা নয় বরং গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি করুন।”