স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন ১০ ব্যক্তি, এক প্রতিষ্ঠান

জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী, শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং চিকিৎসক কনক কান্তি বড়ুয়াসহ ১০ ব্যক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে স্বাধীনতা পুরস্কার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2022, 06:56 AM
Updated : 15 March 2022, 06:50 PM

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মঙ্গলবার এক আদেশে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই বেসামরিক পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের নাম প্রকাশ করে। তাদের ছয়জনই মরণোত্তর এ সম্মাননা পাচ্ছেন।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী, শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (বীর বিক্রম) ছাড়াও মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস এবং সিরাজুল হক মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন। একই ক্যাটাগরিতে এ সম্মাননা পাচ্ছেন আব্দুল জলিল ও সিরাজ উদ্দীন আহমেদ।

চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া এবং অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম পাচ্ছেন এ সম্মাননা।

সাহিত্যে মো. আমির হামজা এবং স্থাপত্যে স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেনকে মরণোত্তর এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।

আর প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবার স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, অসামান্য আত্মত্যাগ ও অসাধারণ অবদানের জন্য যারা চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও জনকল্যাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাদের সম্মান জানাতে সরকার ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি বছর এ পুরস্কার দিয়ে আসছে।

পুরস্কারজয়ী প্রত্যেকে পাবেন ১৮ ক্যারেট মানের পঞ্চাশ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, পাঁচ লাখ টাকার চেক ও একটি সম্মাননাপত্র।

ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী

জাতির পিতার ভাগ্নে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ছিলেন গণপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, মুজিব বাহিনীর কোষাধ্যক্ষ এবং একজন ক্রীড়া সংগঠক।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মাদারীপুরের এমপি হন। পঞ্চম সংসদের সদস্য থাকাকালে ১৯৯১ সালে তার মৃত্যু হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় বোন ফাতেমা বেগমের ছেলে ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী। তার বড় ছেলে নূর ই আলম চৌধুরী মাদারীপুর-১ আসনের এবং ছোট ছেলে মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য।

খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম

ফরিদপুরের সন্তান খন্দকার নাজমুল হুদা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থাকা অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হন। তখন তাকে আরও অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার ও চাকরিচ্যুত করা হয়।

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেকসুর খালাস পান নাজমুল হুদা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য তিনি পরে বীর বিক্রম খেতাব পান। 

স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কর্নেল থাকা অবস্থায় নিহত হন।

আব্দুল জলিল

পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় বাঙালি স্বাধীনতাকর্মীদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছিলেন আব্দুল জলিল। পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২৯ নম্বর আসামি করা হয়। 

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জলিলও খালাস পান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাকে ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে রংপুরে একটি সাব সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিলের বাড়ি নরসিংদী। বর্তমানে তিনি ‘ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক।

সিরাজ উদ্দীন আহমেদ

বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ উদ্দীন আহমদের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। ১৯৭১ সালে বরগুনা জেলা সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়কারী ছিলেন তিনি।

সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা ১৯৭৫ সালে ছিলেন বরগুনা মহকুমার এসডিও। ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার খবর পেয়ে তিনি প্রতিবাদ করেন।

পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে এক ডজনের বেশি বই লিখেছেন তিনি।

মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস

বীর মুক্তিযোদ্ধা ছহিউদ্দিন বিশ্বাস মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং মেহেরপুর পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কুষ্টিয়া-৫ আসন থেকে এমপি হন ছহিউদ্দিন। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হন মেহেরপুর-১ আসন থেকে।

মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ১৯৯০ সালের ২১ মার্চ মারা যান। তার ছেলে ফরহাদ হোসেন বর্তমানে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।

সিরাজুল হক

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সিরাজুল হক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন। জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের এই সংগঠক সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৪ আসন থেকে এমপি হন তিনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান সিরাজুল হক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ছেলে আনিসুল হক এখন বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী।

মো. আমির হামজা

মাগুরার সন্তান আমির হামজা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গান, কবিতা দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। তিনি নিজে গান লিখতেন, নিজেই গাইতেন। তিনি গানের আসরে বসেই গান লিখে সুর দিতেন বলে মাগুরার সংস্কৃতিকর্মীরা তাকে ‘চারণ কবি’ নামেই চেনে। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া আমির হামজা গান গেয়েও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।

এ মুক্তিযোদ্ধার উল্লেখযোগ্য তিনটি গ্রন্থ হচ্ছে বাঘের থাবা, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি এবং একুশের পাঁচালি। তার গ্রন্থের অধিকাংশই স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা। ২০১৯ সালে মারা যান তিনি।

সৈয়দ মাইনুল হোসেন

মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্মৃতি ধরে রাখা জাতীয় স্মৃতি সৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন।

তার নকশা অনুযায়ী স্মৃতিসৌধের বেদীমূল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে সাতটি ত্রিকোণ কলাম, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ১৫০ ফুট উঁচু। এই সাতটি কলামে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাতটি পর্যায় সূচিত হয়েছে। আকার আকৃতিতে ভিন্নতা থাকায় একেক দিক থেকে স্মৃতিসৌধকে দেখায় একেক রকম।

১৯৭৬ সাল থেকে ২২ বছরের কর্মজীবনে সৈয়দ মাইনুল হোসেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নকশার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। এর মধ্যে ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (১৯৭৭), বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন (১৯৭৮), চট্টগ্রাম ইপিজেড কার্যালয় (১৯৮০), জাতীয় যাদুঘর (১৯৮২) ও উত্তরা মডেল টাউন (১৯৮৫) এর নকশাও রয়েছে।

২০১৪ সালে মারা যান তিনি।

ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া একজন নিউরো সার্জন। এই চিকিৎসা বিদ্যাপীঠের নিউরো সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সার্জারি বিভাগের ডিনের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন।

বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স (বিসিপিএস) এর সভাপতি এবং বাংলাদেশ মেডিকেলে অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) প্রথম সহ-সভাপতির দায়িত্বেও তিনি ছিলেন।

ডা. মো. কামরুল ইসলাম

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম একজন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ। একক চিকিৎসক হিসেবে দেশে এক হাজারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করার নজির রয়েছে তার।