২ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৪০% মোটরবাইকে: জরিপ

দেশে সবশেষ দুই মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ১২ জন নিহত হয়েছেন; যাদের মধ্যে শিক্ষার্থীই বেশি বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2022, 06:04 PM
Updated : 5 March 2022, 06:04 PM

শনিবার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৮৪৮টি সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসব দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। দুই চাকার এ বাহনে নিহত হয়েছেন মোট ৪০৩ জন। আর হতাহতের ঘটনা জন্ম দিয়েছে এমন দুর্ঘট্নাগুলোতে সবচেয়ে বেশি যুক্ত রয়েছে ট্রাক।

প্রতিবেদন বলছে, ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ সংশ্লিষ্ট মোট ২৮ দশমিক ৬০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। পেশাগত দিক থেকে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছেন শিক্ষার্থীরা, মোট ১২৯ জন শিক্ষার্থী সড়কে নিহত হয়েছেন।

এ সময়ে ১২টি নৌ দুর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত হয়েছেন। ২৬টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হয়েছেন।

সাতটি দৈনিক পত্রিকা, পাঁচটি অনলাইন পত্রিকা এবং কয়েকটি টিভি চ্যানেলের তথ্যের ভিত্তিতে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনটি করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাক ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে।

“পথচারী নিহতের মাত্রাও চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে। পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলে না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলে। ফলে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।“

নিহতদের মধ্যে ৭৩৯ জন পুরুষ

দেশে গত দুই মাসে ৮৪৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১০১২ জন নিহত এবং ১১৪৬ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে নারী ১৪৩ জন ও শিশু ১৩০টি। বাকি ৭৩৯ জন বিভিন্ন বয়সী পুরুষ।

এসময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৪০৩ জন নিহত হয়েছেন। আর সড়ক-মহাসড়কে তিন চাকার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান) যানবাহন দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১৮১ জন, যা মোট নিহতের ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিভিন্ন যানবাহনের চাপায় নিহত হয়েছেন ২০২ জন পথচারী, যা মোট নিহতের ১৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

দুর্ঘটনায় বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ১৪৭ জন।

অপরদিকে নিহতদের মধ্যে ৬৬ জন বাসযাত্রী, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরির ৫৭ জন যাত্রী, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্সের ২৫ জন, স্থানীয়ভাবে তৈরি নসিমন-ভটভটির যাত্রী ৪৮ জন এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যানের যাত্রী ও বাইসাইকেলের আরোহী ৩০ জন।

মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেশি

দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৫৩টি (৪১.৬২%) ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে। এর বাইরে ২৯৫টি আঞ্চলিক সড়কে, ১৪৩টি গ্রামীণ সড়কে, ৪৬টি শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ১১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৭৯টি (৪৪.৬৯%) দুর্ঘটনা ঘটেছে নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে। ১৯৯টি ঘটনা ঘটেছে পথচারীকে চাপা বা ধাক্কা দেয়ার। ১৫১টি মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৯৩টি যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ২৬টি অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

এসব দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মোট সংখ্যা ১ হাজার ৪৩৭টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৩৭৫টি, বিভিন্ন ধরনের ট্রাক, লরি ও কাভার্ড ভ্যান ৩৬৩টি, থ্রি হুইলার ২০২টি, বাস ১৬৮টি, পিকআপ ৭৯টি, ট্রলি ২৮, ট্রাক্টর ৪৫, মাইক্রোবাস ২১, প্রাইভেটকার ২৬টি, এ্যাম্বুলেন্স ৮টি, নসিমন-ভটভটির মতো স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৮১টি, প্যাডেল রিকশা-ভ্যান ও সাইকেল ৩১টি।

চট্টগ্রাম বিভাগে প্রাণহানি বেশি

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানি সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে- ২৩১ জন। মোট নিহতের ২২ দশমিক ৮২ শতাংশ আর মোট দুর্ঘটনার ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ হয়েছে ওই বিভাগে।

ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনার হার চট্টগ্রামের চাইতে বেশি; মোট দুর্ঘটনার ২৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে প্রাণহানি কিছুটা কম ২২ দশমিক ৭২ শতাংশ।

সবচেয়ে কম প্রাণহানি হয়েছে সিলেট বিভাগে, ৪২ জন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন, ৪৮ জন। সবচেয়ে কম সাতক্ষীরা জেলায়, ২ জন। রাজধানী ঢাকায় ২১টি দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত হয়েছেন।

সড়কে বেশি প্রাণ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন ছাত্রসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১২৯ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছের।

বাকি নিহতদের মধ্যে ওষুধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর বিক্রয় প্রতিনিধি ৫৪ জন, ব্যবসায়ী ৪৬ জন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ২৭ জন, ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ২৩ জন, পোশাক শ্রমিক ১৯ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৮ জন, পুলিশ সদস্য ১১ জন, ব্যাংকের কর্মী ১১ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৮ জন ও ৬ জন সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষেরা রয়েছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ ‘দৃশ্যমান নয়’ মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনার কারণে।“

এ অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে পর্যবেক্ষণে তুলে ধরা হয়েছে।